ছোট থেকেই শ্রাবণীর মাইনাস পাওয়ারের চশমা। কিন্তু চশমা পরতে ভাল লাগত না তাঁর। আপত্তি ছিল কন্ট্যাক্ট লেন্সেও। শেষমেশ তাই বিয়ের আগে ল্যাসিক সার্জারি করিয়ে নেন তিনি। ভারী চশমাকে বিদায় দিয়ে এ যেন এক নতুন জীবন। কিন্তু মাস দুয়েক পর থেকেই শুরু হল চোখে ব্যথা। সঙ্গে ঝাপসা দেখা, চোখ থেকে জল পড়া ইত্যাদি নানা উপসর্গ। চিকিৎসক জানালেন, ল্যাসিক সার্জারির ফলেই এই সমস্যা। ফুলে উঠেছে কর্নিয়া। ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম ‘একট্যাসিয়া’। কর্নিয়া প্রতিস্থাপন ছাড়া নিরাময়ের আশা নেই।
এই ল্যাসিক সার্জারি করিয়েই খালি চোখে দিব্যি দেখছিলেন বহুজাতিক সংস্থার কর্মী সঞ্জয়। কিন্তু সম্প্রতি এক দুর্ঘটনায় চোখে আঘাত লাগে তাঁর। ধরা পড়ে দুর্ঘটনাজনিত ছানি। অস্ত্রোপচারের পর দেখা গেল তাঁর চোখের পাওয়ারে অবিশ্বাস্য রকম হেরফের হচ্ছে। ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম ‘রিফ্র্যাকটিভ সারপ্রাইজ’। এ ক্ষেত্রেও দায়ী সেই ল্যাসিক সার্জারি।
দৃষ্টিশক্তি নিরাময়ে হালের অন্যতম জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি ল্যাসিকের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ নতুন নয়। এই ধরনের সার্জারি কতটা নিরাপদ, সেই প্রশ্নেও দ্বিধাবিভক্ত চিকিৎসক মহল। একাংশ মনে করছেন ল্যাসিক সম্পূর্ণ নিরাপদ। চিকিৎসকদের অন্য অংশ কিন্তু গোড়াতেই গলদ দেখছেন।
নয়া প্রজন্মের একটা অংশ তবু ল্যাসিকেই ঝুঁকছে। তাঁদের যুক্তি, চশমা পরলে দেখতে ভাল লাগে না। কন্ট্যাক্ট লেন্সও বিস্তর ঝক্কির। আবার পেশাগত কারণেও অনেকে চশমা-লেন্স ছাড়তে চাইছেন। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাই বাড়ছে ল্যাসিক সার্জারি সেন্টার। এমনকী এই ধরনের বেশ কিছু সেন্টারে অভি়জ্ঞ সার্জন নেই বলেও অভিযোগ। আর এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন চিকিৎসকদের একাংশ। তাঁদের কথায়, মানুষের মধ্যে এই ‘সুন্দর’ হতে চাওয়ার প্রবণতা থেকেই সমস্যা বাড়ছে।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের রিজিওনাল ইনস্টিটিউট ফর অপথ্যালমোলজির সহ-অধিকর্তা হিমাদ্রি দত্ত বলেন, ‘‘সকলের চোখ এই সার্জারির উপযুক্ত নয়। চিকিৎসকের দায়িত্ব রোগীকে সেটা বোঝানো। কেউ যদি সেটা না করেন, তাতে রোগীর ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি। বিজ্ঞান এবং বাণিজ্য দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।’’
এই ল্যাসিক সার্জারি আসলে কী?
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, চোখের সামনে দিকে গোল কাচের মতো উত্তল অংশের নাম কর্নিয়া। আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণের ৬০% হয় এর উপর। তাই কর্নিয়ার গঠনগত সমস্যার ফলে যাঁদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ তাঁদের ক্ষেত্রে কর্নিয়ার সামান্য অংশ অস্ত্রোপচার করে বাদ দিয়ে মোটা টিস্যুকে পাতলা করে কর্নিয়ার তল ঠিক করে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতির নাম হল ‘লেজার অ্যাসিস্টেড ইন-সিটু কেরাটোমিলিউসিস’, সংক্ষেপে ল্যাসিক।
কিন্তু এতে ঝুঁকি কোথায়? চক্ষু চিকিৎসক সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, যে-হেতু ল্যাসিক সার্জারিতে কর্নিয়া থেকে টিস্যু কেটে বাদ দিতে হয়, তাই পরবর্তী সময়ে কর্নিয়ার অন্য অস্ত্রোপচারে সমস্যা হতে পারে। তাতে অনেকাংশেই দৃষ্টি হারানোর ঝুঁকি থেকে যায়। তা ছাড়া ল্যাসিক করালে অনেক ক্ষেত্রেই চোখের বায়োমেট্রিতে ভুলের সম্ভাবনা থেকে যায়। গর্ভবতী বা চোখের কোনও অসুখ থাকলেও এই সার্জারি এড়ানোর কথা বলছেন অনেকে।
হিমাদ্রিবাবু অবশ্য জানান, ল্যাসিক যে হেতু এ দেশে প্রায় নতুন একটি চিকিৎসাপদ্ধতি, তাই এর ফলাফল নিয়ে ধন্দ থাকছেই। সার্জারি ঠিকমতো না হলে পরে সমস্যা তৈরি হওয়ার কথা মেনে নিয়েই তাঁর পরামর্শ — ‘‘কাটাছেঁড়া করার দরকারটা কী? চশমাই তো সব চেয়ে ভাল।’’
আর চিকিৎসার নামে অসাধু ব্যবসার সম্ভাবনা! চিকিৎসদের একাংশ কিন্তু এই অভিযোগ মানতে নারাজ। চক্ষু চিকিৎসক অয়ন মোহান্ত যেমন জানালেন, ‘‘এক যুগেরও বেশি সময় এ দেশে ল্যাসিক হচ্ছে। কর্নিয়ার মাপ নেওয়া থেকে শুরু করে, চোখের পাওয়ার ও রেটিনা পরীক্ষা পর্যন্ত সব নিশ্চিত হওয়ার পরেই ল্যাসিক করা হয়।’’ একই মত চিকিৎসক পার্থ বিশ্বাসেরও। বললেন, ‘‘ল্যাসিক সার্জারি নিরাপদ।’’ তবে ঠিকমতো পরীক্ষা না করে সার্জারি করলে তার ফল যে মারাত্মক হতে পারে, মানছেন তাঁরাও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy