Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Laxmi Puja

লক্ষ্মী মেয়ে বলে কি কিছু হয়?

পঁচিশ বা তিরিশে যখন তারা বিয়ের পিঁড়িতে বসে, তখন তারা না অনাঘ্রাতা না কুমারী। নিজের বসন্তের আহ্লাদে তারা আহ্লাদিত।

দেশজ গন্ধ মাখা লক্ষ্মীর দিন আর নেই। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

দেশজ গন্ধ মাখা লক্ষ্মীর দিন আর নেই। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৮ ১৭:৪৯
Share: Save:

হোয়াটসঅ্যাপের স্বর্গ গ্রুপের তাজা খবর, মর্ত্যে ‘লক্ষ্মী মেয়ে’ বলে আর কিছু থাকছে না। নারদ যদিও চ্যাটে বলে চলেছেন,

‘‘লজ্জা আদি গুণ রমণীর ভূষণ/নারী সবে সেই লজ্জা দিচ্ছে বিসর্জন/সন্ধ্যাকালে সন্ধ্যাবাতি নাহি হয় জ্বালা/ভালেতে সিঁদুর দিতে হয়েছে ভোলা।’’

লক্ষ্মী কিন্তু চ্যালেঞ্জটা নিয়ে ফেলেছেন। এতকাল যাদের ‘অলক্ষ্মী’ বলে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন, তাদের স্ট্যাটাস বদলে দিলেন তিনি।

পাঁচালীর মতো দেশজ গন্ধ মাখা লক্ষ্মীর দিন আর নেই। পঁচিশ বা তিরিশে যখন তারা বিয়ের পিঁড়িতে বসে, তখন তারা না অনাঘ্রাতা না কুমারী। নিজের বসন্তের আহ্লাদে তারা আহ্লাদিত। সৎ পাত্রে পড়ার আগেই তাদের নিজেদের অর্থে তারা কিনে ফেলে ফ্ল্যাট, গাড়ি, বিজনেস ক্লাসে বিদেশ। এই হয়ে ওঠায় কিন্তু সরস্বতীর খানিক অবদান আছে। তবে লক্ষ্মীর চেনা চেহারাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তারা মেতে উঠেছে অন্যরকম লক্ষ্মী হওয়ার সাধনায়।

যাদবপুরের কমপারেটিভের সুমেধা যেমন বলল, ‘‘আজকের লক্ষ্মী গাঁজাও খাবে, ফার্স্ট ক্লাসও পাবে, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে চাকরিও করবে, হঠাৎ ছুটিতে ইউরোপ যাবে। শুধুই জ্ঞানচর্চা নয়, চাই অ্যাপ্রিসিয়েশন, যার অন্য নাম টাকা রোজগার।’’

আর্থিক স্বচ্ছলতার দিকটা বুঝে নিয়ে আজকের মেয়েরা লক্ষ্মীর লীলায় মজেছে।

কিন্তু লক্ষ্মী নিজেই বা কেমন?

‘‘লক্ষ্মী মানে শ্রী, লক্ষ্মী মানে সুরুচি। লক্ষ্মী সম্পদ আর সৌন্দর্যের দেবী। বৈদিক যুগে মহাশক্তি হিসাবে তাঁকে পুজো করা হত। তবে পরবর্তীকালে ধনশক্তির মূর্তি নারায়ণের সঙ্গে তাঁকে জুড়ে দেওয়া হয়,’’ বলেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। লক্ষ্মীদেবী থেকেই ‘লক্ষ্মী মেয়ে’-র চেহারা তৈরি হয়। স্বামীর আস্থা অর্জন করে সংসার গুছিয়ে তোলার দায়িত্ব, পিতৃতন্ত্র ‘লক্ষ্মী মেয়ে’-র উপর চাপিয়ে দেয়।

বাঙালি পুরুষ বরাবরই ফর্সা, গোলগাল ‘লক্ষ্মীমন্ত’ মেয়ে দেখলেই সিঁদুর পরিয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে আসত। বাড়ির কত্তামশাই আবার লক্ষ্মী জেনুইন কিনা নিশ্চিত করার জন্য মেয়েদের গোড়ালির গড়নটাও চেক করে নিতেন। আর বাইরে ঘুরতেফিরতে সরস্বতীর সঙ্গে ফ্লার্ট করে কেটে যেত বাঙালি পুরুষের বসন্ত।

আরও পড়ুন: খালি গায়েই রূপ খুলবে জামদানির সাজে​

পাঁচালীর গল্পে রাজা অলক্ষ্মীর মূর্তি আনার পরেই ভাগ্যলক্ষ্মী, ধনলক্ষ্মী সকলেই রাজাকে ত্যাগ করেছিলেন। রাজা বিরক্ত হয়ে জঙ্গলে রানিকে রেখে এলে রানি কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে লক্ষ্মীপুজো করে অলক্ষ্মী বিদায় করেন। মজার কথা, পুজোয় মেয়েদের ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে ছুঁৎমার্গ থাকলেও পাঁচালী কিন্তু মেয়েরাই পড়ত। তাদের কানে যেন বেদবাক্যের মতো বাজতে থাকে....বাইরে বেরনো, পরপুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব, নভেল পড়া— সবই ‘অলক্ষ্মী’র পরিচয়। সংসার যাবে রসাতলে। মগজ ধোলাইয়ের কাজটা যদিও টেকেনি।

আরও পড়ুন: পুজোর পর এ সব উপায়ে চা খেয়ে ঝরিয়ে ফেলুন বাড়তি মেদ​

৮৭ বছরের শিলা ঘোষ তো পড়তেন লক্ষ্মীর পাঁচালী। কিন্তু ছেলের হঠাৎ মৃত্যুতে পাঁপড় বিক্রি করতে শুরু করেন তিনি। এখন মাসে তাঁর ১২০০ টাকা রোজগার। ‘‘কোনওদিন কাজ থামাব না। লক্ষ্মী আমার ঘরেই আছেন,’’ বললেন তিনি।

এই চাপিয়ে দেওয়ার খেলা থেকে সরে এসে আজকে মেয়েরা উল্টো রাস্তায় হাঁটা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কের সিইও নয়না লাল কিদওয়াই ভারতের তিরিশ জন মহিলা সিইও-কে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন, অধিকাংশ মহিলাই নিজ ক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়েছেন তাঁদের বাবার প্রভাবে, উৎসাহে। নয়না একটু অন্যরকম করে ভাবতে চান।

‘‘আজকের লক্ষ্মীর কিন্তু সবটাই বাইরের দুনিয়ায় দিয়ে দিলে চলবে না। সে যেখানে থাকবে সেই বাড়ির গন্ধে, হাওয়ায় যেন তার ছোঁয়া থাকে, ঠিক যেমন করে একজন পুরুষকেও বাড়ির দায়িত্ব নিয়ে চলতে হবে।’’

নারী-পুরুষের ভাগাভাগির কথা বলতে গিয়ে নয়না অবশ্য মনে করিয়ে দিলেন যে আজকের লক্ষ্মীরা যতই বহির্মুখী হোন না কেন, তাঁদের মধ্যে এখনও বাড়ি ফেলে আসার জন্য এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করে।‘‘প্লিজ এই গিল্টটা ভুলে যেতে হবে। আর প্রচুর কাজ করতে হবে। কাজেই সমৃদ্ধি।’’ হেসে বললেন নয়না।
সৌন্দর্য চেনা চোখে আজ আর লক্ষ্মীমেয়েকে চেনা যায় না। বেশ কয়েক বছর আগে অ্যাসিড হামলায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল রূপার মুখ। এখন রমরম করে চলছে তাঁর বুটিকের ব্যবসা। ‘‘সৌন্দর্য নয়, বাণিজ্যেই তো লক্ষ্মীর বাস,’’ বললেন রূপা। অ্যাসিডে কেবল মুখ পুড়েছে, পোড়েনি জীবন।
নরওয়ের কনস্যুল জেনারেল নয়নতারা পাল চৌধুরী অবশ্য লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী কোনও ধারণাকেই মানতে চান না।‘‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে মা রাস্তায় তার বাবা‌-মায়ের সঙ্গে খিচুড়ি রান্না করে যেমন দিয়েছেন, আবার আমাদের মানুষও করেছেন। আমি দু’টো দেখেই বড় হয়েছি। আসলে লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী বলে কিছু নেই। মেয়েদের যে হোমমেকারের ভূমিকায় থাকতেই হবে এমন তো নয়। কাজ নিয়ে আমি ব্যস্ত। বিয়েই করা হল না। তাই বলে কি আমার সংসার নেই? পরের দিনের রান্না থেকে বাজার বা বণিক সভার কোনও দায়িত্ব, চা বাগান সামলানো, সব এই মাথা থেকেই তো বেরোচ্ছে! নিজের পারিবারিক ঐতিহ্য, শিক্ষা, বিশ্বাস, ধারণা— কোনওকিছুই অন্য কারও জন্য যে বদলায় না সেই তো সফল লক্ষ্মী,’’ সাফ জানালেন নয়নতারা।

সৃজনশীলতা, আত্মবিশ্বাস, নিজের জীবনটাকে চালিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার মধ্যেই আজকের লক্ষ্মীরা আছে।

‘‘ক্রিকেট খেলতে গিয়ে কখনও তো মনে হয়নি এটা পুরুষদের খেলা। জীবনের লড়াইয়ে লক্ষ্মী মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই আমি। একজন পুরুষকেও লক্ষ্মী ছেলে নয়, লক্ষ্মী মানুষ হিসেবে দেখা উচিত,’’ বললেন ঝুলন গোস্বামী।

লক্ষ্মী আসলে কতগুলো গুণ। ‘‘দাম্পত্য, সংসার, সন্তানের বাইরে আজ লক্ষ্মীকে দেখা যায়। কাজ আর জীবন, এই দু’টো ক্ষেত্রে কতটা নিজের বেস্ট দিতে পারছি তার উপরেই লক্ষ্মীর রেটিং হয় কিন্তু। যে মেয়েরা সাফল্য, ব্যর্থতা, সব কিছুর মধ্যে দিয়েও নিজের অস্তিত্বকে কখনও কম্প্রোমাইজ করে না তারাই লক্ষ্মী,’’ যোগ করলেন নয়নতারা পাল চৌধুরী।

স্ট্যাটাস বদলে দিয়ে লক্ষ্মী নিজেই গেলেন বদলে।
আইফোন কানে ল্যাপটপ মুখে ক্রুজের বুকিং সারছেন। হেভিওয়েটের চাকরি সামলাতে সামলাতে কভার টেবিল বিএমডব্লিউ বুক করছেন। ইচ্ছা হলে চলছে অ্যাপ-এর আলগা প্রেম। ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটাচ্ছেন স্বামী আর সন্তানের সঙ্গে।
ভেসে উঠল ফাইনাল স্ট্যাটাস!

রিসোর্সফুল লক্ষ্মী রকস্!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Laxmi Puja 2018 Laxmi Puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE