সুদীপ রাহা
স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে রাজ্য যথেষ্ট গর্বিত। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী থেকে আমলা পর্যন্ত সকলেই বিভিন্ন সময়ে এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। তবে প্রকৃত পরিস্থিতি যে কতটা ঘুণ ধরা, শহরের এক নামী হাসপাতালে সাম্প্রতিক একটি মৃত্যুর ঘটনা তা আরও এক বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। মৃতের পরিবারের অভিযোগপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এখন নড়েচড়ে বসেছে ঠিকই, তবে তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। প্রাণের বিনিময়ে ১৭ বছরের এক কিশোর জানিয়ে গিয়েছে, রাজ্যের স্বাস্থ্য-পরিস্থিতি নিয়ে গর্বের ভিত কত নড়বড়ে।
গত ১৫ অগস্ট আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় দমদমের বেদিয়াপাড়ার বাসিন্দা, ১৭ বছরের সুদীপ রাহা। ইমার্জেন্সির চিকিৎসকেরা আর একটু সহৃদয় হলে ছেলের এই পরিণতি হত না জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন সুদীপের বাবা প্রদীপবাবু। প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার মাধ্যমে সেই চিঠি যায় স্বাস্থ্য ভবনে। চিঠির উপরে সেই শীর্ষ কর্তা লিখে দেন, প্রাথমিক ভাবে অভিযোগের চিঠিটি পড়ে তাঁর মনে হয়েছে হাসপাতালের গাফিলতি রয়েছে।
এতেই ম্যাজিকের মতো কাজ হয়। গোড়ায় যে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ তাঁদের অভিযোগকে আমলই দিতে চাইছিলেন না, তাঁরাই নড়েচড়ে বসেন। নড়েচড়ে বসে স্বাস্থ্য ভবনও। একই মৃত্যুর তদন্তে নজিরবিহীন ভাবে দু’টি তদন্ত কমিটি গড়া হয়। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট পেশ করেছেন তাঁরা। রিপোর্টে ধরা পড়েছে, সময় মতো ওই কিশোরের চিকিৎসাই শুরু হয়নি। এক বিভাগ থেকে আর এক বিভাগে ঘুরেছে তার পরিবার। যার জেরেই ওই মৃত্যু। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের তরফে আরও সহানুভূতি প্রয়োজন ছিল বলে মন্তব্য করেছেন তদন্তকারীরা।
ঠিক কী ঘটেছিল সুদীপের ক্ষেত্রে? প্রদীপবাবু জানিয়েছেন, বেশ কয়েক দিন ধরেই জ্বর হয়েছিল ছেলের। প্রায় বেহুঁশ অবস্থায় ১৫ অগস্ট রাতে তাকে আর জি করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ইমার্জেন্সিতে তখন ডিউটিতে ছিলেন এক হাউসস্টাফ। অভিযোগ, তিনি রোগীকে পরীক্ষা না করে শুরুতেই ইসিজি, এক্স-রে করিয়ে আনতে বলেন। প্রদীপবাবুর কথায়, “ওই মহিলা চিকিৎসক আমাদের কোনও কথায় পাত্তাই দিচ্ছিলেন না। বলছিলেন, পরীক্ষার রিপোর্ট না দেখে কোনও চিকিৎসাই শুরু হবে না। আমরা তখন দিশাহারা অবস্থায় ছোটাছুটি করছি। আর দেখছি, ছেলেটা ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছে।”
প্রদীপবাবু জানিয়েছেন, তখন ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। কোনও ট্রলি নেই। এক্স-রে করানোর ঘরটা ইমার্জেন্সি থেকে বেশ কিছুটা দূরে। অন্য কোনও পথ না থাকায় ছেলেকে পাঁজাকোলা করেই তাঁরা এক্স-রের ঘরে নিয়ে যান।
১৭ বছর বয়সী একটি ছেলেকে পাঁজাকোলা করে বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে দৌড়নো খুব সহজ নয়। তা সত্ত্বেও সেখানে পৌঁছনোর পরে হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। কোনও মতে এক্স-রে হয়। আবার ওই অবস্থায় ছুটতে ছুটতে ছেলেকে নিয়ে ইমার্জেন্সিতে ফেরেন তাঁরা। তাঁর কথায়, “ওই বৃষ্টির মধ্যে রুগ্ণ ছেলেটাকে সামলাব, নাকি এক্স-রে প্লেট সামলাব? বৃষ্টির জলে প্লেটটা সামান্য ভিজে গিয়েছিল। সেটা নিয়ে চিকিৎসকের হাতে দিতেই চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। বললেন, যে ভাবে হোক প্লেট শুকনো করে আনতে হবে। আমি তখন হন্যে হয়ে খুঁজছি কোথায় একটা পাখার তলায় একটু দাঁড়ানোর সুযোগ পাব, প্লেটটা শুকিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে যেতে পারব।” এ ভাবেই ঘণ্টা দেড়েক মতো কেটে যায়। ততক্ষণে অবশ্য সুদীপের মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরোতে শুরু করেছে। তখন সম্বিত ফেরে ডাক্তারদের। ভর্তি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু কার্যত চিকিৎসার কোনও সুযোগ না দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হয় ওই কিশোরের।
অভিযোগ, ঘটনার পরেই হাসপাতালে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সুদীপের পরিজনেরা। কিন্তু তাঁদের কথায় কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। তবে পরিস্থিতি বদলে যায় নবান্ন থেকে স্বাস্থ্য ভবন হয়ে ওই অভিযোগের চিঠি হাসপাতালে এসে পৌঁছনোর পরে। তড়িঘড়ি হাসপাতালের তরফে চার সদস্যের এবং স্বাস্থ্য ভবনের তরফে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।
এ দিন ছেলের মৃত্যুর প্রসঙ্গে প্রদীপবাবু বলেন, “আমার ছেলেটা তো অসময়ে চলে গেল। কিন্তু প্রতি দিন কত হাসপাতালে এমন কত ছেলে চলে যাচ্ছে, তার খবর অনেকেই রাখেন না। কেন হাসপাতালে একটা ট্রলিও পাওয়া যাবে না, কেন এক জন ডাক্তার রিপোর্ট পাওয়ার আগে রোগীকে ছুঁয়েও দেখবেন না, কেন রোগীর বড়ির লোকজনের সঙ্গে কুকুর-বেড়ালের মতো ব্যবহার করা হবে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরগুলো এ বার রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের দেওয়ার সময় এসেছে।”
তদন্তকারী দলের এক সদস্য বলেন, “আমরা যতটুকু বুঝেছি, তাতে ছেলেটির সেপ্টিসেমিয়া হয়েছিল। চিকিৎসা হলেই যে সে বেঁচে যেত, এমন না-ও হতে পারত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে চিকিৎসাটা সময় মতো শুরুই হয়নি। ওই হাউসস্টাফ সমস্যার গভীরতাটাই বুঝতে পারেননি। তাঁর উচিত ছিল কোনও সিনিয়র চিকিৎসকের সঙ্গে পারমর্শ করে যথাযথ পদক্ষেপ করা। তা না হওয়াতেই ছেলেটির মৃত্যু ত্বরান্বিত হল। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের।”
স্বাস্থ্যকর্তারা বিষয়টি নিয়ে এ দিন কোনও মন্তব্য করেননি। জানিয়েছেন, তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হওয়ার পরে যা বলার বলবেন। একই কথা বলেছেন হাসপাতালের সুপার দিব্যেন্দু গৌতমও। সেই ‘সিদ্ধান্ত’ কবে হবে, আপাতত সে দিকেই তাকিয়ে পুত্রহারা এক পরিবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy