Advertisement
১১ মে ২০২৪

হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া ব্যথা

ঘাড়ে ও পিঠের ব্যথায় আজকাল অনেকেই কাবু হচ্ছেন৷ বেশির ভাগ অফিস মানেই কম্পিউটারের সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে যাওয়া৷ তাতেই বিপত্তি। লিখেছেন অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞ দেবজিৎ ঘোষ।ঘাড়ে ও পিঠের ব্যথায় আজকাল অনেকেই কাবু হচ্ছেন৷ বেশির ভাগ অফিস মানেই কম্পিউটারের সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে যাওয়া৷ তাতেই বিপত্তি।

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:২৫
Share: Save:

স্পন্ডিলোসিস হল শিরদাঁড়ার হাড়ের সমস্যা। এককথায় বলতে গেলে, আমরা যখন জন্মাই তখন আমাদের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, হাড় বা হাড়ের সন্ধিস্থল বা বোন জয়েন্ট যেমন অবস্থায় থাকে, সেগুলো নিয়েই আমরা চলাফেরা করি। পরবর্তীকালে এগুলি ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে ক্ষয় হতে থাকে।

প্রথমেই বলে রাখি, স্পন্ডিলোসিস হওয়ার ক্ষেত্রে কোনও বয়সের সীমারেখা নেই। তবু সাধারণত ৩৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষদের এই সমস্যা শুরু হয়। আজকাল অবশ্য কিছু-কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা আমরা দেখি যেখানে ২৬/২৭ বছরের গৃহবধূ কিম্বা তরুণ কর্পোরেট এই সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। বিভিন্ন রকমের কাজের চাপ থেকে স্পন্ডিলোসিস হতে পারে। নিয়মিত একই ভাবে বসে বা দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ কাজ করার অভ্যাসের কারণেও স্পন্ডিলোসিস হতে পারে। ঘাড়ের দিকের অংশে এই রোগ হলে তাকে আমরা বলি, সার্ভাইক্যাল স্পন্ডিলোসিস। আবার শিরদাঁড়ার নীচের দিকের অংশে অর্থাৎ পিঠের নীচের দিকে হলে তাকে আমরা বলি লাম্বার স্পন্ডিলোসিস।

পুরুষ বা মহিলা উভয়ই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন৷ সাধারণত ঘাড় সামনে ঝুঁকিয়ে কাজ করতে হয় এমন সব পেশার মানুষদের এ রোগটি বেশী দেখা যায়। যেমন-চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করে এমন এক্সিকিউটিভ, কম্পিউটারে এক নাগাড়ে কাজ করে যাওয়া কর্পোরেট প্রভৃতি। ঘাড়ের ঝাঁকুনি হয় এমন কাজে নিযুক্তদের যেমন নর্তকী, গাড়ি-মোটরসাইকেল –সাইকেলে নিয়মিত যাতায়াতকারীদের এই রোগ হতে পারে।

ঘাড়ের ব্যথা অনেক সময় কাঁধ থেকে উপরের পিঠে, বুকে, মাথার পিছনে বা বাহু হয়ে হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই রোগের সবচেয়ে মারাত্মক দিক হল, স্পাইনাল কর্ডের উপর চাপ পড়া। এর ফলে হাত পায়ে দুর্বলতা, হাঁটতে অসুবিধা হতে পারে। পায়খানা প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই রোগের আক্রান্ত হলে ঘাড় নাড়াতে গেলে ব্যথা লাগে। ডানে-বায়ে ঘাড় ঘুরাতে সমস্যা হবে। ঘাড় শক্ত হয়ে যায়, ব্যথা হয়। হাতে, বাহুতে ঝিনঝিন বা সিরসির্, অবশ ভাব বা সূচ ফোটানোর মতো অনুভুতি হয়। কাজ করতে যন্ত্রণা হয়।

অনেকে এসে বলেন হাত তুলতে সমস্যা হচ্ছে বা হাত দিয়ে কাজ করতে পারছেন না। আবার অনেকের মাথা ঘোরে। তবে মাথা ঘোরার আরও অনেক কারণ থাকে। স্পন্ডিলোসিস তার মধ্যে একটি।

স্পন্ডিলোসিসের তিন ধরনের চিকিৎসা হয়ে থাকে। রোগীকে ব্যথা নিরাময়ের ওষুধ দেওয়া হয়।। এক্ষেত্রে আমরা নন-স্টেরয়েড পেইনকিলার দিয়ে থাকি। শুধু ওষুধ দেওয়াই নয়, ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি তাঁদের কাজ করার ভঙ্গিমাও পাল্টাতে বলি আমরা। কারন আগেই বলেছি, ঘাড় বা পিঠ বেঁকিয়ে দীর্ঘক্ষণ বসার অভ্যাস থেকেও এই রোগ জটিল হতে পারে। এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে এ ভাবে দীর্ঘক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা এড়াতে বলি। ঘাড় সোজা রেখে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। আমরা সব সময়ে ঘাড় সোজা ও পিঠ সোজা রেখে বসতে বলি। রোগীকে ফিজিওথেরাপির পরামর্শ দিই। নির্দিষ্ট কিছু ব্যায়াম আছে, যেগুলো স্পন্ডিলোসিসের সমস্যার সময়ে রোগীদের দেওয়া হয়। বিশেষত স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ। ব্যথা যেখানে হচ্ছে তার আশপাশের মাংসপেশিকে শক্ত রাখার জন্য বিশেষ ব্যায়াম দেখিয়ে দেওয়া হয় রোগীকে। বাড়াবাড়ি হলে রোগীকে বেল্ট, কলার ব্যবহার করতে বলি আমরা। সময় বিশেষে ট্র্যাকশানও দেওয়া হয়। এতেও না কমলে যদি উপায়ন্তর না থাকে সেক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের দিকে যাওয়া হয়।

এই রোগের থেকে দূরে থাকতে হলে স্ট্রেসফুল কাজ আমরা কমাতে বলি। শিরদাঁড়াকে ঠিকঠাক রাখতে হবে। ক্যারামের গুটি যেমন সাজানো হয় তেমনি আমাদের শিরদাঁড়া। ক্যারামের গুটিগুলি যেমন পরপর সমান্তরালভাবে না সাজিয়ে এলোমেলোভাবে সাজিয়ে রাখি সেটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেনা। শিরদাঁড়াও তাই। তা যদি এলোমেলোভাবে থাকে তত বেশি চাপ পড়বে। আমাদের শিরদাঁড়া যদি শুধু হাড় দিয়ে তৈরি হত তাহলে আমাদের সেই শিরদাঁড়া এ দিক ও দিক নড়াচড়া করে ঘাড় বা পিঠ বেকিয়ে কাজ করতে অসুবিধা হত। আমাদের শিরদাঁড়ায় পরপর বেশ কিছু ডিস্ক রয়েছে। ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে তো সব জিনিসেরই ক্ষয় হয়। তেমনি শিরদাঁড়ার এই ডিস্কও ব্যাতিক্রম নয়। ৩০-৩৫ বছরের পর এই ডিস্ক ক্রমশ নষ্ট হতে শুরু করে। তখন আশপাশের হাড়ের ওপরে মাংসপেশির ওপরে চাপ পড়তে থাকে। সেই কারনে আমরা সকলকে সোজা হয়ে বসা বা দাঁড়ানোর ওপরে জোর দিতে বলি।

কারও যদি মনে হয় হাতে পায়ে ব্যাথা, অবশ হয়ে যাওয়া বা ঝিনঝিন করছে তাহলে সেই সমস্যা পুষে রাখা উচিৎ হবেনা। এতে সমস্যা আরো বাড়বে। প্রথম অবস্থাতেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। হয়তো হাঁচি দিতে গিয়ে বাঁ-দিকে তাকালেন। আর ঘাড় আটকে গেল। অথবা একটানা কাজ করছেন, কিন্তু ঘাড়ে একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। থেকে থেকেই ঘাড়কে একটু নাড়িয়ে নিতে হচ্ছে। কিংবা ধরুন, মেয়েদের খোঁপার কাছটায় একটা চিনচিনে ভাব। খোঁপাটাকে অসম্ভব ভারী মনে হচ্ছে। এগুলো স্পন্ডিলোসিসের একেবারে প্রথম ধাপ। এই সময়ই ডাক্তার দেখান। এই লক্ষণগুলোকে অবহেলা করবেন না। অনেককে দেখি বারো-তেরো বছরের পুরনো ব্যথা নিয়ে আসেন। সেই ভুলটা অন্তত করবেন না। দেরি হলে, অপারেশন ছাড়া উপায় থাকবে না। মনে রাখবেন, স্পন্ডিলোসিস হল একটা লাইফস্টাইল ডিজিজ। তাই প্রথমেই আপনার জীবনযাত্রা ঠিক করতে হবে। রাতের ঘুম সবচেয়ে জরুরি। ছ’ঘণ্টা হোক কি আট ঘণ্টা, ঘুমোতে হবে রাতে। একটা ভুল ধারণা আছেযে, বালিশ ব্যবহার করা নিয়ে। কখনওই বালিশ ছাড়া ঘুমোবেন না। সব সময় নরম একটা বালিশ নিন। আর ঘুম থেকে ওঠার সময় সোজা উঠবেন না। পাশ ফিরে উঠুন। স্নান করা বা পুজোর সময় বসার জন্য একটা স্টুল ব্যবহার করুন। ইন্ডিয়ান টয়লেট ব্যবহার না-করাই ভাল। বাড়িতে ওয়েস্টার্ন টয়লেট না থাকলে, একটা প্লাস্টিকের কমোড কিনে নিতে পারেন। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। এক সঙ্গে বেড়াতে যান। বাচ্চার সঙ্গে খেলা করুন। কখনওই একটানা বসে টিভি দেখবেন না। ডাক্তারি ভাষায় বলে, স্পন্ডিলোসিস অনেকাংশে সাইকোসোমাটিক। ১৫ শতাংশই মানসিক। টেনশন খুব খারাপ রোগ। মন হাসিখুশি থাকলে, স্পন্ডিলোসিস সহজে হবে না। ছবি: প্রণব দেবনাথ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Health Back pain Spondylosis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE