প্রতীকী ছবি
বন্ধ্যাত্ব কখনওই একা নারীর ত্রুটি নয়। কিন্তু আমাদের প্যাট্রিয়ার্ক সমাজ বন্ধ্যাত্বের সব দায় নারীর উপর ন্যস্ত করে বসে আছে। তাই তো ইজাকুলেটরি ডিসফাংশন, সেক্সুয়াল ডিসফাংশন নিয়ে ভুগলে পরেও ঠুনকো পুরুষের দোহাই দিয়ে অনেকেই চিকিৎসা করা থেকে বিরত থাকেন। ফলে পুরুষ বন্ধ্যাত্বের হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সন্তানধারণের জন্য যেমন সুস্থ স্বাভাবিক ডিম্বাশয় প্রয়োজন যাতে তৈরি হতে পারে উৎকৃষ্ট ডিম্বাণু, ঠিক তেমনই প্রয়োজন সুস্থ-সবল-সচল শুক্রাণু। যদি শুক্রাণুর মান কোনও কারণে খারাপ হয় অথবা শুক্রাশয় থেকে শুক্রাণু নির্গমনের পথ সুগম না হয় তখন বন্ধ্যাত্ব আসতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানে এখন বহুল প্রচলিত বেশ কয়েকটি চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। যেমন আইইউআই (ইন্ট্রা ইউটেরাইন ইনসেমিনেশন), ডিআই (ডোনার ইনসেমিনেশন), ইকসি (ইন্ট্রা সাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইঞ্জেকশন) এবং টেসা (টেস্টিকুলার স্পার্ম অ্যাসপিরেশন)। এর মধ্যে ইকসি বা টেসাকে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় অসাধারণ এক বিপ্লব বলা যায়।
স্বাভাবিক ভাবে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন বা নিষেকের জন্য প্রয়োজন অন্তত ১৫ মিলিয়ন বা দেড় কোটি শুক্রাণু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র ২০১০-এর নির্দেশিকা অনুসারে এর মধ্যে খুব কম করে অন্তত ৪০ শতাংশ গতিশীল এবং ৪ শতাংশ সঠিক গঠনের শুক্রাণু হতে হবে। এ ছাড়া সংক্রমণ থাকা চলবে না যা শুক্রাণুর কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। যদি শুক্রাণু সংখ্যা, গতিশীলতা এবং সঠিক গঠন কম হয়ে যায় তখন সন্তানধারণের জন্য সাহায্য প্রয়োজন হয়।
শুক্রাণুর সংখ্যা যদি ৮০ লক্ষ থেকে এক কোটির মধ্যে হয়, গতিশীলতা ৩০ শতাংশ এবং সঠিক গঠন ৪ শতাংশ হলে সেই পরিস্থিতিতে আইইউআই চিকিৎসা করলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু শুক্রাণুর গুণমান যদি আরও কমে যায় তখন ইকসি পদ্ধতি ছাড়া সাফল্যের আর কোনও পথ খোলা থাকে না। এমন অনেকেই আছেন যাদের টেস্টিসে শুক্রাণুর অভাব নেই অথচ তাদের সিমেনে শুক্রাণু নেই। কারণ যে নল বাহিত হয়ে শুক্রাণু টেস্টিস থেকে আসে তাতে যদি জন্মগত প্রতিবন্ধকতা থাকে, হয়তো কোনও সংক্রমণের কারণে সেই নল রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে অথবা কোনও অস্ত্রোপচার করে নল বাদ গিয়েছে তখন শুক্রাণু নির্গমনের পথ পায় না। অনেকে আবার মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েও এই সমস্যায় ভোগেন। তখন টেসা পদ্ধতিতে টেস্টিস থেকে শুক্রাণু বার করে ইকসি করলে সুফল মেলে। অর্থাৎ স্পার্মটিকে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ডিম্বাণুর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিতে হয়। অনেক ম্লান মুখে হাসি ফোটাতে এই দুই পদ্ধতির জুড়ি মেলা ভার।
এই পন্থা উদ্ভাবন হয়েছিল বেলজিয়ামে এক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সেখানকার এক গবেষণাগারে এক তরুণ বিজ্ঞানী ভুল করে ডিম্বাণুর দেওয়াল ফুটো করে শুক্রাণু প্রবেশ করিয়ে দেন। এর আগে ডিম্বাণুর খোলসেই ফুটো করা হত। তরুণ গবেষকের সেই ভুল নতুন দিশা দেখাল। দেখা গেল, ভুল করে করলেও ডিম্বাণু ফার্টিলাইজ করে গিয়েছে। তাই একটি দুর্ঘটনা জন্ম দিল নতুন সম্ভাবনার যা ইকসি নামে আজ বহু ব্যবহৃত। ইকসি করতে গেলে প্রথমে শুক্রাণু সংগ্রহ করতে হবে যা টেসা বা টেসে পদ্ধতিতে করা হয়। তার পর সেই স্পার্মটিকে মাইক্রোস্কোপের সহায়তায় ডিম্বাণুর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়।
ইকসির পদ্ধতি অনেকটা আইভিএফ-এর মতো। ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বার করে তাতে শুক্রাণু প্রবেশ করিয়ে নিষেক ঘটিয়ে তৈরি হওয়া ভ্রূণকে গর্ভে স্থাপন করা হয়। নবজাতক সংক্রান্ত চিকিৎসায় যা এক নতুন যুগের সূচনা।
এই পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রি-ইমপ্ল্যান্টেশন জেনেটিক ডায়াগনসিস। ভ্রূণের থেকে একটি কোষ নিয়ে পরীক্ষা করে ভ্রূণের জিন বিশ্লেষণ করা হয়। ফলে ভ্রূণ জরায়ুতে প্রতিস্থাপনের আগেই জেনেটিক ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলে কাটিয়ে সুস্থ সবল নলজাতকের জন্ম হওয়া সম্ভব হয়েছে। যা সব মিলিয়ে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
লেখক বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy