Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
Lifestyle News

নিরুদার ঘুগনি খেয়ে মঞ্চে গাইলেন নচিকেতা

আশির দশকে বহরমপুরে অলিগলিতে এত রেস্তোরাঁ ছিল না। হাতেগোনা যে ক’টা ছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি ভিড় হত বহরমপুর গির্জার মোড়ে রাজা কৃষ্ণনাথ নন্দীর মূর্তির নীচে নিরুপদর ঘুগনির ঠেলাগাড়িতে।

গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

শুভাশিস সৈয়দ
বহরমপুর শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৬ ১২:২২
Share: Save:

আশির দশকে বহরমপুরে অলিগলিতে এত রেস্তোরাঁ ছিল না। হাতেগোনা যে ক’টা ছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি ভিড় হত বহরমপুর গির্জার মোড়ে রাজা কৃষ্ণনাথ নন্দীর মূর্তির নীচে নিরুপদর ঘুগনির ঠেলাগাড়িতে। মামুলি চলমান রেস্তোরাঁয় সন্ধ্যার পরে শালপাতার ঠোঙা হাতে উপচে পড়া ভিড় দেখে লোকজনে বলত, ‘মাদক মেশায় নাকি’। ওই রটনার জেরে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বহরমপুর থানাতেও নাকি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মালিক নিরুপদ ধরকে। পরে অবশ্য জানা যায়, সেই সময়ে পুলিশের পদস্থ এক আধিকারিকের স্ত্রী কোনও ভাবে নিরুপদ’র ঘুগনি খেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বায়না করেন যে কোনও উপায়ে ঘুগনির রেসিপি জানতে হবে। তখন ওই পদস্থ আধিকারিকের নির্দেশে নিরুপদকে থানায় নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করার অছিলায় জেনে নেওয়া হয় রেসিপি।

যাকে নিয়ে এত রটনা, তার স্বাদ চাখতে স্বাভাবিক ভাবেই বহরমপুরে এসে আবদার করে বসেন গায়ক নচিকেতা। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা রবীন্দ্রসদন থেকে মোটর বাইকে করে তড়িঘড়ি গির্জার মোড়ে পৌঁছে ভাঁড়ে ঘুগনি কিনে আনেন। গরম ঘুগনির স্বাদ-গন্ধে নচিকেতার মনপ্রাণ ভরে ওঠে। গান শুনে হাততালির ঝড় তোলে দর্শকরা। নিরুপদের ছেলে বিশ্বনাথ ধর জানান, নচিকেতা এর পরে যত বার বহরমপুরে গানের অনুষ্ঠান করতে এসেছেন, তত বারই তাঁর বাবার হাতে তৈরি ঘুগনি খেয়ে মঞ্চে উঠেছেন।

এখন বহরমপুরের বিভিন্ন প্রান্ত জুড়ে অত্যাধুনিক ঝাঁ-চকচকে রেস্তোরাঁ। তা সত্ত্বেও এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা রাত-বিরেতে টিউশন থেকে ফেরার পথে, বয়স্করা কর্মস্থল থেকে বাড়ির পথে সাইকেল-মোটর বাইক থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন ওই ঘুগনির টানে। সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে ঘুগনির বিকিকিনি।

গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

এক দিনের এই নামডাক নয়। পরিবার সূত্রে জানা যায়, বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র নিরুপদ ধর বাড়তি রোজগারের জন্য পড়াশোনা করার পাশাপাশি স্কুলে মটর সেদ্ধ মশলা দিয়ে মাখিয়ে বিক্রি করতেন। পরে অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা ছেড়ে দিলেও ছাড়তে পারলেন না মটর সিদ্ধর ব্যবসা। সেই মটর সিদ্ধ থেকে ঘুগনি বানানোর পরিকল্পনা নেন তিনি। বড় আকারের বেশ কয়েকটি হাঁড়িতে সাদা ঘুগনি, মাংসের ঘুগনি নিয়ে ঠেলাগাড়িতে সাজিয়ে িগর্জার মোড়ে বিক্রি শুরু করেন। পরে নাগরিকদের চাহিদা মেনে মেনু তালিকায় ঢুকে পড়ে আলুর দম, মেটে চচ্চড়ি, খাসির মাংস কষা। পিছন ফিরে ‌আর তাকাতে হয়নি। এক সময়ে টালির ছাউনি দেওয়া ইটের বাড়ি এখন দোতলা। পাঁচ ছেলেমেয়ের জন্য বুড়ো শিবতলা পাড়ায় দু’দুটো দোতলা বাড়ি। আরও কত কী। নিরুদার ঘুগনি এখন যেন ‘মিথ’। যার পিছনে রয়েছে অক্লান্ত পরিশ্রম।

প্রতি দিন প্রায় ১০ কিলো মটর সিদ্ধ করাটা ঘুগনির প্রথম ধাপ। ভোরবেলায় উনুনে আঁচ দেওয়া হয়। বেলা ১২টা পর্যন্ত চলে রসুইশালায় ঘুগনি রান্না। আগে বাটনাতে পেঁয়াজ-আদা-রসুন বেটে রাখা হত। এখন যুগের নিয়মে সেই কাজটা করে মিক্সি। কিন্তু তাতে স্বাদে কমতি হয় না এতটুকু। ঘুগনি তৈরির মশলা যোগান থেকে যাবতীয় কাজে সদাই ব্যস্ত স্ত্রী রাধারানিদেবী। চিরকাল অবশ্য পর্দার আড়ালে রয়ে গিয়েছেন তিনি।

বছর দু’য়েক আগে ক্যানসারে‌ আক্রান্ত হয়ে মারা যান নিরুপদ ধর। কিন্তু সে কথা বহরমপুরের অধিকাংশ নাগরিকের অজানা। কারণ তারও বেশ কয়েক বছর আগে থেকে হাঁটুর ব্যথায় কাহিল হয়ে পড়ার কারণে পেল্লাই সাইজের হাঁড়ি ভর্তি ঘুগনি নিয়ে ঠেলাগাড়ি ঠেলে যাতায়াত করা আর সম্ভব হয়ে উঠছিল না নিরুদার। মেজ ও সেজ ছেলে বিশ্বনাথ ও তারকনাথ ধর ঠেলাগাড়ি নিয়ে বসছিলেন গির্জার মোড়ে। এখনও তাঁরাই বসেন। শালপাতার বাটি ভরা ঘুগনিতে লেপে থাকে নিরুদার স্মৃতি।

আরও পড়ুন: সুধীরের ঘুগনির গন্ধে মাতোয়ারা শহর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Niruda's Ghugni Nachiketa Ghugni
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE