বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া বা অশান্তি মানেই, তার প্রভাব পড়বে সন্তানের উপর। বিশেষ করে পরীক্ষার সময়ে বাড়ির পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট ও মনোবিদেরা। এখন মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। এমন আরও অনেক বড় পরীক্ষাই আসবে। সব ক্ষেত্রেই বাড়ির পরিবেশের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। বাড়িতে অস্থিরতা বেশি থাকলে ছেলেমেয়েদের মনে নেতিবাচক ভাবনা আসতে পারে। যার প্রভাব পড়ে সন্তানের লেখাপড়ার উপরেও।
বাড়িতে অশান্তির পরিবেশ বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের অসহিষ্ণু করে তোলে। এমনটাই বলছেন পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ। তাঁর কথায়, “সন্তানের সঙ্গে বাবা ও মাকে আলাদা আলাদা ভাবে সংযোগ তৈরি করতে হবে। এটা খুব পরিকল্পিত আর সুষ্ঠু ভাবে করতে হবে। পরীক্ষার সময়টুকু অনেক ছেলেমেয়েই উদ্বেগে ভোগে, জেদ করে। এমন পরিস্থিতিতে বাবা-মাকে মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি সামলাতে হবে। প্রয়োজনের বেশি বকুনি বা অন্যের সঙ্গে তুলনা না টেনে বরং, পরীক্ষা ভাল হবে এই বলে সব সময়ে উৎসাহ দিতে হবে।”
মানুষের ধৈর্য, সময় কমেছে। অনেক পরিবারেই মা-বাবা দু’জনেই কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, সন্তানকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারেন না। অবসর সময়টুকুতেও তাঁরা মোবাইলে মগ্ন থাকেন। এই দিকটাও ভেবে দেখার পরামর্শ দিলেন পায়েল। পরিবারের সকলে মিলে একসঙ্গে সময় কাটানোর চল প্রায় উঠেই গিয়েছে। এরও প্রভাব কিন্তু পড়ে কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েদের মনে। একটানা পরীক্ষা, পড়ার চাপ, উদ্বেগ সব মিলেমিশে ছোটরা একটু অন্য দিকে, মন দিতেই চায়। আর সেই সময়টাতেই মোবাইল, ট্যাব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে পড়াশোনার ক্ষতি হয়। তাই এই সময়টাতে যদি বাবা-মা পাশে থাকতে পারেন, তা হলে তাদের মনোবল বাড়বে। পরীক্ষার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন, পর দিনের পরীক্ষার প্রস্ততি যদি তেমন না হয়, তা হলেও উৎসাহ দিন। অর্থাৎ, ইতিবাচক কথাবার্তা বলতেই হবে।
একই রকম ভাবনা মনোরোগ চিকিৎসক শর্মিলা সরকারেরও। তিনি বলেন, “পরীক্ষা ভাল দিতেই হবে, বেশি নম্বর পেতেই হবে, এই সব কথা বলবেন না। যদি দেখেন সন্তান পড়তে বসতে চাইছে না, টিভি দেখে নষ্ট করছে, তা হলে না বকে বরং ভাল ভাবে তাকে বলুন। বোঝান যে সে সব পারবেই, আর একটু পড়ে নিলে পরীক্ষা আরও ভাল হবে।” শর্মিলা জানাচ্ছেন, ছোটরা নিজেদের কোনও আবেগই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। হাসি, কান্নার মতো রাগ-হিংসাও স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। তাই শাসন করার আগে তার মন বুঝতে হবে। অনেক বাবা-মা তা পারেন না। ফলে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে চেঁচামেচি, ঝগড়া, অশান্তির পরিবেশ তৈরি হয়ে যায় বাড়িতে। ফলে ছোটদের মনে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়, তার রেশ বহুদিন ধরে থাকে। পড়াশোনার তো ক্ষতি হয়ই, পরবর্তী সময়ে গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে সম্পর্কের বাঁধনও আলগা হয়ে যায়। ভরসার জায়গাটাই নষ্ট হয়ে যায়।
আগে একাধিক সন্তান থাকত। এক জন নন-পারফর্মার হলেও, অন্য জন তা পুষিয়েই দিত, এখন একটি সন্তানের উপরেই প্রত্যাশার পাহাড় জমছে। ফেসবুক টুইটার হোয়াটসঅ্যাপের আস্ফালন তো আছেই। সব মিলে বাড়ির পরিবেশেও যেন এক প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা চলছে। বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে ছোটরা। মনোবিদ অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়ের মতে, এখন বোর্ডের পরীক্ষাতেও প্রথম হতেই হবে, তা হলেই টিভিতে ছেলেমেয়ের মুখ দেখা যাবে, এমন ভাবনাও রয়েছে অনেক বাবা-মায়েরই। ছেলেমেয়ের উপর তাই সীমাহীন চাপ। বাড়ির পরিবেশকে পড়াশোনার আদর্শ করে তুলতে গিয়ে, হাসি-মজা-কৌতুকই হারিয়ে যাচ্ছে। অনিন্দিতার কথায়, “যে ছাত্র বা ছাত্রীটি অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে এসে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে গল্পের বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে, তাকে যদি দম ফেলতে না দিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে পরের দিনের পরীক্ষার পড়া করতে জোর করে বসিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে পরীক্ষা তো ভাল হবেই না, যেটুকু তার আয়ত্তে ছিল তা-ও ভুলে যাবে।” কাজেই মাধ্যমিক মানেই ঘাড় গুঁজে কেবল পড়া নয়, অন্য কাজও করতে দিন। আপনারাও যোগ দিন। বাড়ির পরিবেশ আনন্দদায়ক হলেই ছোটরা চাপমুক্ত হয়ে পরীক্ষা দিতে পারবে।”