E-Paper

তেরো বছর বয়স নয় দুঃসহ

বয়ঃসন্ধিতে সন্তান আত্মসচেতন হয়ে ওঠে। নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়। কী ভাবে সামলাবেন? বেশি শাসন করলে কোনও বিপদ আসবে না তো?

চিরশ্রী মজুমদার 

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২৫ ০৮:১০

মাস ঘুরতে চলল, স্ন্যাকসের প্যাকেট চুরির অপবাদের জেরে অপমান আর অভিমানের বোঝা নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছে চোদ্দো বছরের কৃষ্ণেন্দু। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের অন্তর্দুনিয়ার হদিস বড়রা পুরোপুরি জানেন না। আমাদের অজ্ঞাতসারে, ওদের জীবনে অন্ধকার এলে, ওরা ভুল করলে বা ওদের সঙ্গে কোনও ভুল হলে, তার অভিঘাত কতখানি হতে পারে? এই সব সমস্যা সামলানোর উপায় কিন্তু সব সময় মারধর, শাস্তি দিয়ে আধিপত্য প্রকাশ নয়। ওরা যাতে জীবনের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা আপনাকে বলে, সাহায্য চায়, সেই রাস্তাটা খোলা রাখতে হবে। ধৈর্য ধরে ওদের কথা শুনতে হবে।

ওকে আশ্বস্ত রাখুন

বয়ঃসন্ধির সময়টায় ছেলেমেয়েরা বাবা-মার ছত্রচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে বাইরের পৃথিবীকে চিনতে শেখে। বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়, আত্মসচেতনতা আসে, স্বাতন্ত্র্য গড়ে উঠতে শুরু করে। বন্ধুদের প্রভাব পড়ে, সব কথা মা-বাবাকে না বলার প্রবণতাও দেখা দেয়। অথচ ভাল-মন্দের বোধ থাকে না। ফলে নানা ধাক্কা আসতে পারে, বাচ্চা অল্পে অস্থির হয়ে ওঠে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের কথায়, “সামান্য ভুল, ছোটখাটো অপরাধ কোন বাচ্চা-ই বা করে না? কিন্তু তাকে অপমান করে শাস্তি দেওয়ার বদলে, আচরণের পরিবর্তন করাই হবে লক্ষ্য। তাই বাচ্চারা ভুল করলে তা নিয়ে আলোচনা দরকার।” এ যুগে মন খারাপ, অপমান, হতাশা এড়ানোর উপায় নেই। ধরুন, অঙ্কে ব্যর্থতার জন্য শিক্ষক বকুনি দিলেন, সেই নিয়ে সহপাঠী বিদ্রুপ করে বসল। বোঝাতে হবে, যে এমন করল সেটা তার সমস্যা। সে কোনও হীনম্মন্যতা থেকে অপমান করে আত্মপ্রসাদ লাভ করল। যার জন্য সন্তানের এত কষ্ট হল, তার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলা, মা-বাবার দায়িত্ব।

কৃষ্ণেন্দুর মর্মান্তিক পরিণতির পরিপ্রেক্ষিতে মনে পড়ে যায়, বছর পনেরো আগে রৌভনজিৎ রাওলার ঘটনা। অভিযোগ উঠেছিল স্কুলের শিক্ষকের বেত্রাঘাতের কারণে দুষ্টু ছেলেটি চরম পদক্ষেপ করেছে। ডা. রামের মতে, একটা ঘটনাই দায়ী নয়, দেখা গিয়েছে অনেক কারণে আত্মহননের চিন্তা জাগে। যখন ক্রমাগত মনখারাপ হয়, সে বোঝে কোনও ভরসার জায়গা নেই, আশা নেই, কোণঠাসা বোধ করে, তখন হয়তো বেঁচে থাকাটাই বেশি যন্ত্রণার হয়। তবে মা-বাবাকেও তো জীবনযুদ্ধে যুঝতে হচ্ছে। অসুস্থতা, আর্থিক বা দাম্পত্যে অসুবিধায় পড়ে তাঁরা অনভিপ্রেত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলেন। তাই এমন সম্পর্ক গড়ুন যে শাসন করলেও তা সেই পর্যায়ে যাবে না যেখানে সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। ভুল করে এসে যেন বাবা-মাকে খুলে বলতে পারে। বারবার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালে কিন্তু সন্তান সমস্যায় পড়লেও আর বলবে না। সন্তান যদি দেখে, বাবা-মা তার সমস্যাটি পরিণত ভাবে সামলে দিলেন, তা হলে সে আশ্বস্ত, নিশ্চিন্ত থাকবে।

শাসন করুন, একান্তে

বাচ্চার স্বতন্ত্র সত্তা, নিজের বক্তব্য, আত্মমর্যাদার প্রকাশ হয় প্রাক্‌বয়ঃসন্ধিতেই। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের অভিজ্ঞতা, জেনারেশন আলফা-র ক্ষেত্রে সেটাই এগিয়ে এসেছে আট বছর বয়সে। এরা ‘পাবলিক শেমিং’ ঘোরতর অপছন্দ করে। তাই জনসমক্ষে না দুষে, প্রশ্ন না তুলে একান্তে কথা বলুন। একটি ঘটনার কথা মনে করালেন তিনি। “অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, বাড়ি থেকে হাতখরচে আপত্তি ছিল। স্কুল থেকে ফেরার পথে বন্ধুরাই রোজ খাওয়ায়, এক দিন সেই নিয়ে বুলিং হয়, ফুচকাওয়ালার সামনেই বন্ধুরা বলে, তুই খাস না। মনখারাপ নিয়ে বাড়ি ফেরে ও বড়দের ব্যস্ততার সুযোগে পাশের ঘরে আত্মহত্যা করে। কাজেই বাচ্চার মধ্যে বিষাদের লক্ষণ ফুটে উঠছে কি না নজর করা অত্যন্ত জরুরি। যেমন, মেজাজ পরিবর্তন, তীব্র প্রতিক্রিয়া দেওয়া, গুম হয়ে থাকা, কথা না মানা, যখন তখন চোখে জল চলে আসা, অসামাজিক হয়ে যাওয়া...”

পড়াশোনায় পিছিয়ে যাওয়া, যৌন হেনস্থা, কারও প্রতি আকৃষ্ট হওয়া, বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া, মোবাইলের চাহিদা— অনেক কিছুই এই কাঁচা বয়সের বিষাদের কারণ। অনেক সময়ে কারণ স্পষ্ট করে না। তার স্কুলে গিয়ে খোঁজ নেওয়া যায় সহপাঠী, শিক্ষিকাদের কাছে। স্কুলবাস বা পুলকারের চালক, হেল্পারদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখুন। পায়েল বলছেন, “বাচ্চারা খুব সংবেদনশীল। আগে কষ্ট ভাগ করে নেওয়ার লোক ছিল। এখন ছোট পরিবার, সমাজও অনেক পাল্টেছে। কাজেই মা-বাবাই খেয়াল রাখুন, সন্তান যাতে না ভাবে, ‘আমাকে তো কেউ বুঝলই না’।”

ওকে নিরাপদে রাখতে...

এই প্রতিকূল সমাজের উপযুক্ত করেই কিন্তু ছোটদের বড় করে তুলতে হবে। বাচ্চাদের বোঝান, বড়দেরও সব ইচ্ছে, চাহিদা মেটে না। অন্যায় দাবির ক্ষেত্রে ওদের ‘না’ বলুন, কেন ‘না’ বললেন, ব্যাখ্যা করে দিন। আপনার তত্ত্বাবধানেই হতাশার সঙ্গেও অভ্যস্ত হতে শিখুক, তা হলে নিজেই অন্ধকার কাটিয়ে ওঠার উপায় বার করে ফেলবে। মনের জোর বাড়বে, ভবিষ্যতে যে কোনও পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারবে।

আন্তর্জাল, সমাজমাধ্যম থেকেও ওরা অনেক কিছু অসময়ে জেনে যায়। অভিভাবক ভার্চুয়াল পৃথিবী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকুন। ডা. রাম বলছেন, “সন্তান হয়তো সব কিছু বলবে না, ফ্রেন্ডলিস্টেও রাখতে চাইবে না। তাই ওদের জীবন সম্পর্কে জানতে হলে ওর বন্ধুদের চিনেজেনে রাখুন। একটা মুশকিল হল, সময়াভাবে এখন অনেকেই সন্তানকে শুধু শৃঙ্খলা শেখাতে চান। কিন্তু ‘অভিভাবকত্ব’ শব্দটা অনেক বিস্তৃত। এর মানে সন্তানকে ন্যায়নীতি শেখানো, হাসিঠাট্টা করা, নিজের দুঃখ-যন্ত্রণা সম্পর্কেও তাকে অকপটে বলা যাতে সে অভিভাবকের অপারগতা সম্পর্কেও সংবেদনশীল থাকে। শৃঙ্খলা শেখানো আর বাচ্চাকে মানুষ করার মধ্যে এই ফারাকটা বুঝেই বয়ঃসন্ধির সন্তানকে সামলাতে হবে।”

শিশুর সম্মান, শিশুর প্রতি সমাজের আচরণ নিয়ে বিদেশে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। ভারত এ বিষয়ে অনেক পিছিয়ে। এখানেও অভিভাবককে মেনে নিতে হবে সন্তান একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ, তার আলাদা মন আছে, সেই মন খারাপ হবে, তখন মা-বাবাকে তার শুশ্রূষা করতে হবে। তা হলেই জটিলতার মেঘ কাটবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Adolescence

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy