পড়া না পারলে বেতের বা়ড়ি, মাত্রাছাড়া দুষ্টুমি করলে বিছুটি পাতা ঘষে দেওয়া, দস্যি ছেলেকে ‘সোজা’ করতে স্কেল দিয়ে পেটানো— এ সব তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, বলেন অনেকেই। সম্প্রতি ছোটবেলার স্মৃতিচারণে এমনই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন নেটফ্লিক্সে ‘ফ্যাবিউলাস লাইভস ভার্সেস বলিউড ওয়াইভস’ সিরিজ়ে পরিচিত হয়ে ওঠা শালিনী পাসি। পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই শালিনী নিজেও এখন মা। তিনিই একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ছোটবেলায় কোনও খারাপ কথা বললেই তাঁর মা মুখে লঙ্কার গুঁড়ো পুরে দিতেন। সেই ভয়ে কখনও আর বাজে কথা উচ্চারণ করেননি। বহু অভিভাবক মনে করেন, কড়া শাসনে না রাখলে ছেলেমেয়ে মানুষ হয় না। শাস্তিস্বরূপ কখনও খুন্তির ছেঁকা, কখনও দোতলার খোলা বারান্দা থেকে ঝুলিয়ে ফেলে দেওয়ার ভয় দেখানোর মতো কঠিন শাস্তিও নেমে আসে শিশুর উপরে।
কাকা, জেঠাদের অনেকেই বলবেন, এই সব শাস্তি পেয়েই তাঁরা বড় হয়েছেন। এ সব অতি সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু সত্যি তাই কি? মারধর, মুখে লঙ্কার গুঁড়ো পুরে দেওয়া, ভুলত্রুটি হলেই সন্তানের উপর কঠোর শাস্তির বিধানে ছেলেমেয়েদের আদৌ ভাল হয় কি?
সকলে কিন্তু মোটেই তেমনটা মনে করেন না। বরং এর উল্টো প্রভাব পড়তে পারে বলেই ধারণা অনেকের। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট মনে করেন, ‘‘ভয় দেখিয়ে অভিভাবকত্ব হয় না। বরং এই ভয়ই সন্তানের ব়ড় হওয়ার, এগিয়ে যাওয়ার সম্ভবনাকে নষ্ট করে দিতে পারে।’’ ভয় দেখিয়ে ছেলেমেয়েকে বড় করার ফলাফল মারাত্মক হতে পারে বলছেন মনোরোগ চিকিৎসক শর্মিলা সরকার। তিনি বলছেন, ‘‘উপর থেকে ফেলে দেওয়ার মতো ভয় দেখানো কখনও পোস্ট ট্রমাটিক ডিজ়অর্ডারের জন্ম দিতে পারে। তা ছাড়া, মুখে লঙ্কাগুঁড়ো পুরে দেওয়া, অন্ধকার ঘরে ভরে দিয়ে ভয় দেখানো শিশুর চরিত্র গঠনের পথেও অন্তরায় হতে পারে।’’
আরও পড়ুন:
শাসনের নামে কঠোর শাস্তির ফলাফল কী হতে পারে?
মন নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের কথায় শাসনের নামে কঠিন শাস্তির বিধান কখনও সন্তানের জন্য ভাল হতে পারে না। বরং সামান্য ভুল ত্রুটিতে শাস্তির খাঁড়া নেমে এলে সন্তান ভয় পেয়েই বাঁচতে শিখবে। ক্রমশ সে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে। আবার কখনও এই ভয় পেয়ে বাঁচার প্রভাব অন্যের উপরেও পড়তে পারে। হিংসাত্বক মনোভাব কাজ করতে পারে শিশুমনে।
ভবিষ্যৎ সম্ভবনা শুরুতেই শেষ হতে পারে
পড়াশোনায়, অঙ্কে ভুল করলে শিক্ষকের কাছে নয়তো অভিভাবকের কাছে প্রতিনিয়ত ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয় অনেক পড়ুয়াকেই। তাঁরা মনেই করেন, বকুনি বা ক্ষেত্র বিশেষে মারধরের ভয় না থাকলে সে পড়বে না বা অঙ্কও কষবে না। তবে পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, ‘‘এই মানসিকতাই পড়ুয়ার সম্ভবনাকে নষ্ট করে দিতে পারে। অঙ্কে কাঁচা, মাথায় বোধবুদ্ধি নয় এই ধরনের কথা শুনতে শুনতে তারা বিশ্বাসই করতে শুরু করে অঙ্কটা তার জন্য নয়। অঙ্কে ভীতি তৈরি হবে তার। অথচ এই কাজটি যদি তাকে ভাল করে বুঝিয়ে করানো হত, উৎসাহ দেওয়া হত, দেখা যেত পরীক্ষায় সে অনেক ভাল ফল করছে।’’
অবসাদ-উদ্বেগ: শাস্তির ভয় শিশুমনে অবসাদ তৈরি করতে পারে আবার একই কারণে কারও কারও মনে উদ্বেগও তৈরি হতে পারে। বাবামায়ের প্রত্যাশাপূরণের চাপ, চাহিদামতো ফল না পেলেই কড়া শাসন, শাস্তি পড়ুয়াদের মনে গভীর রেখাপাত করে। দিনের পর দিন জমতে থাকা এই ভয় তাকে মিথ্যে কথা বলার পথেও ঠেলে দিতে পারে।
চারিত্রিক সমস্যা: ক্রমাগত ভয় দেখানোয় সন্তানের মনে রাগ-ক্ষোভ জন্মাতে পারে। সেটা বড়দের উপর প্রকাশ করতে না পারলে তারা অন্য কারও উপর দেখাবে না তা কিন্তু নয়। শর্মিলা বলছেন, ‘‘কখনও কখনও শিশুরা বড়দের সঙ্গে পেরে না উঠলে সেই রাগ সমবয়সি কারও উপর দেখায়, পোষ্য বা পশুদের প্রতি নৃশংস হয়ে উঠতে পারে সে। সত্যি বললে শাস্তি পেতে হবে, এই ভয়ে সে কথা লুকোবে। শাস্তির ভয় সন্তারে চরিত্র গঠনের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে বাবা মায়েদের তা বুঝতে হবে।
অপরাধ প্রবণতা: শাস্তির ভয়ে ছোটদের মনে ‘ট্রমা’ বা ‘আতঙ্ক’ থেকে মানসিক সমস্যাও তৈরি হয়। অনেক সময় কিশোর-কিশোরীদের অপরাধপ্রবণতার মুখেও ঠেলে দেয় অতিরিক্ত শাসন। ছোটবেলায় বেল্ট দিয়ে মারা, খুন্তির ছেঁকা এই ধরনের শাস্তি অনেক সময়ে সন্তানের মনে অপরাধমনস্কতা তৈরি করে।
তা হলে কি শাসন করা যাবে না?
সন্তানকে শাসনের নাম কথায় কথায় বকুনি, গায়ে হাত তোলা এবং কঠিন শাস্তি দিয়ে তাকে সোজা করার মানসিকতার ঘোরতর বিরোধী পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট থেকে মনোরোগ চিকিৎসক। শালিনী পাসি জানিয়েছেন, তাঁর সন্তানের সঙ্গে কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই রয়েছে। তবে শর্মিলা বলছেন, অনেক সময়ে ছোটবেলায় শাস্তি পেতে অভ্যস্ত অভিভাবক পরবর্তীতে তাঁদের সন্তানের উপরও তা-ই প্রয়োগ করেন। পায়েল বলছেন, ‘‘বকুনি নয় বরং সন্তানকে শোধরাতে গেলে তাকে বোঝাতে হবে। যুক্তি দিয়ে বোঝানো দরকার। অভিভাবকের বোঝা দরকার বাজে কথা সে কেন বলছে, বা কেউ অন্য কাউকে মারধর করছে। বুঝিয়ে কাজ না হলে কথা বলা বন্ধ করে বা হাবেভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারেন অভিভাবকেরা। বকুনির চেয়ে নীরবতা অনেক সময়েই বেশি কার্যকর হয়।’’