Advertisement
E-Paper

প্রয়াত ভাস্কর উমা সিদ্ধান্ত, বয়স হয়েছিল ৯২ বছর, হতাশা, ক্রোধ, সাধারণের যাপন ধরা পড়েছিল কাজে

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার সময়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভাস্কর উমা সিদ্ধান্ত। বেশ কয়েক বছর ধরে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন উমা। বয়সজনিত নানা শারীরিক সমস্যায়ও ভুগছিলেন।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:৫৮
উমা সিদ্ধান্ত।

উমা সিদ্ধান্ত। ছবি: সংগৃহীত।

প্রয়াত হলেন ভাস্কর্য শিল্পী উমা সিদ্ধান্ত। মৃত্যুকালে শিল্পীর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টায় দক্ষিণ কলকাতায় নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বেশ কয়েক বছর ধরে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন উমা। বয়সজনিত নানা শারীরিক সমস্যায়ও ভুগছিলেন। স্মৃতির সমস্যা চলছিল। চলা-ফেরার পরিসরও হয়ে পড়েছিল সীমিত।

১৯৩৩ সালের ১১ জানুয়ারি বরাহনগরে বনহুগলিতে মামার বাড়িতে জন্ম হয় উমার। ছেলেবেলা থেকেই ছবি আঁকা, বাটিকের কাজ, চামড়ার কাজের দিকে ঝোঁক ছিল তাঁর। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মূর্তি তৈরির প্রতি ঝোঁক বাড়ে উমার। তবে দেবদেবীর মূর্তি নয়, চারপাশের মানুষজন, পশুপাখির ছোট ছোট অবয়ব গড়া দিয়ে ভাস্কর্যের হাতেখড়ি শুরু হয় উমার। নন্দলাল বসুর ছাত্র ফণীভূষণ দাসের কাছে তাঁর প্রথম শিল্পকলার পাঠ।

পছন্দের বিষয় ভাস্কর্য নিয়ে পড়বেন বলে সরকারি আর্ট কলেজে আবেদন করেন উমা। তখন আর্ট কলেজে মেয়েদের দেখা যেত কারুকলা শিক্ষা বিভাগগুলিতে। ভাস্কর্য বিভাগে এমনকি, পুরুষদের সংখ্যাও ছিল কম। সেই সময়ে উমার এই সিদ্ধান্ত আলোড়ন তৈরি করেছিল। তাঁর ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়েও কম জটিলতা হয়নি। যেহেতু ভাস্কর্য গড়তে শারীরিক শক্তির প্রয়োজন, তাই সেই কাজটা একজন মহিলা কতখানি সফল ভাবে করতে পারবেন, তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তোলেন সে সময়ে। তবুও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন উমা। জয় হয়েছিল তাঁরই। আর্ট কলেজের ভাস্কর্য বিভাগের প্রথম ছাত্রী হিসাবে উত্তীর্ণ হন উমা সিদ্ধান্ত। পরিশ্রমকে জয় করে তিনি হয়ে ওঠেন সফল ভাস্কর।

বসন্ত রায় রোডের বাড়িতে ছোট স্টুডিয়োতেই তাঁর কর্মজীবনের সূচনা হয়। হিন্দুস্তান রোডে উমার সুসজ্জিত বাড়িতে গেলে যেন চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বসন্ত রায় রোডের বাড়ি ছেড়ে তখন এই বাড়িতেই কাজ করতে শুরু করেন তিনি। বাড়ির প্রতিটি আনাচ-কানাচ জুড়ে শিল্পীর ছোট-বড়-মাঝারি ভাস্কর্য। ষাটের দশকে শিল্পীর কাজগুলি মূলত ছিল প্রাচীন ভারতীয় ভাস্কর্যের অনুসারী। শুধু ভাস্কর্য নয়, উমা ছবি এঁকেছেন, স্কেচ করেছেন, এমব্রয়ডারি করেছেন, এমনকি টেরাকোটার কাজ করেছেন। আবার ধাতব গয়না তৈরিতেও ছিলেন নিপুণা। জাপানি পুতুলের ধাঁচে পুতুলও বানিয়েছেন। সংসার, সন্তান, অধ্যাপনা, সামাজিক দায়বদ্ধতা সামলেও নিজের কাজের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালবাসা। সত্তরের দশক থেকে শিল্পীর কাজের ধরনেও খানিকটা বদল আসে। তাঁর ওই সময়ের কাজে পাশ্চাত্যের প্রভাব বেশ লক্ষ করা যায়।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ৩০তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (কিফ) প্রদর্শিত হয় উমা সিদ্ধান্তকে নিয়ে অবন্তী সিংহের নির্দেশনায় তৈরি তথ্যচিত্র ‘উমা’। আর একই মাসে আকৃতি আর্ট গ্যালারিতে শেষ বার প্রদর্শিত হয় উমার কাজ। দু’টি ঘিরেই উন্মাদনা দেখা গিয়েছিল শিল্প অনুরাগীদের মধ্যে। প্রায় দশ হাতে শিল্পের নানা ক্ষেত্রে নিজের দক্ষতার একের পর এক দৃষ্টান্ত গড়েছেন তিনি। সমাদৃত হয়েছেন, প্রশংসিত হয়েছেন দেশে ও বিদেশে।

মঙ্গলবার শিল্পীর পুত্র আশিস সিদ্ধান্ত বলেন, ‘‘মায়ের মতো কর্মঠ মহিলা আমি খুব কমই দেখেছি। বছর পাঁচেক আগে পর্যন্তও তিনি নিজের কাজ নিজেই করতে পছন্দ করতেন। ৮৫ বছর বয়সেও মাকে দেখেছি সিঁড়িতে উঠে নিজের হাতে তৈরি বিরাট মাপের ভাস্কর্যগুলি পরিষ্কার করতে। হাঁটুতে চার-পাঁচ বার অস্ত্রোপচার হয়, একটা হাতও ভেঙে গিয়েছিল। তবে মায়ের কাজে তার কোনও প্রতিফলন চোখে পড়ত না কখনওই। কাজকে মনে-প্রাণে ভাল না বাসলে বোধ হয় কাজের প্রতি এত নিষ্ঠা দেখানো সম্ভব নয়।’’

স্মৃতিভ্রংশ ও বার্ধক্যের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে কেটেছিল শেষ ক’টা বছর। ছেলে-বৌমা ছাড়া আর কাউকেই চিনতে পারতেন না। অথচ একটা সময়ে যে লাঠি ধরে তিনি হাঁটতেন, সেটিও সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন নিজের হাতে। বিপন্ন মানুষের হতাশা থেকে ক্রোধ, দুঃস্থ মানুষের রোজের জীবন ধরা পড়েছিল তাঁর শিল্পকর্মে। গর্ভবতী মহিলা থেকে আহত ষাঁড়, কে নেই তাঁর কাজে! মাতৃত্বের নানা রূপ ধরা পড়েছে তাঁর হাতের দক্ষতায়। উমা আজ নেই। তবু তাঁর নান্দনিক পরিমিতির ছোঁয়ায় তৈরি নানা সৃষ্টি থেকে যাবে চিরকাল।

Death News
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy