E-Paper

বিপদের জানলা খুলছে পাল্লা

সমাজমাধ্যমে পোস্ট করছেন খুঁটিনাটি, পারিবারিক ছবি-ভিডিয়ো, ব্যক্তিগত তথ্য। আপনাকে ও আপনার সন্তানকে কিন্তু তা বিপদে ফেলতে পারে।

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২৫ ০৮:৩৯

ঘোরা-বেড়ানো, খাওয়াদাওয়া, মন খারাপ থেকে সাফল্যের খবর সমাজমাধ্যমে বন্ধুবান্ধব, অপরিচিতের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ভাগ করে নিচ্ছেন অনেকেই। আমাদের এই ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে থাকা সমাজের আশপাশে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে একটা সমান্তরাল সমাজ, যেখানে রয়েছে বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, প্রশংসা, সমালোচনা সব। খেয়াল-বেখেয়ালে ক্রমশ সে সমাজের অংশ হয়ে পড়ছি আমরাও। তবে স্ক্রিনের ও পারে যে সমাজ, সেখানেও কিন্তু রয়েছে দুষ্কৃতীরা। সন্তান কী খেতে ভালবাসে, পুজোর ছুটিটা কোথায় কাটাচ্ছেন, সপ্তাহান্তে কোন অতিথির বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে গেলেন... সেই হদিস থাকছে তাদের কাছেও।

লুকিয়ে বিপদ

ঘটনা ১: সন্তানকে নতুন স্কুলে ভর্তি করেছেন। স্কুলড্রেসে গলায় আই কার্ড ঝুলিয়ে তার মিষ্টি একটা ছবি বাবা-মা সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন— এটা নতুন নয়। তার পরে বাচ্চার জন্মদিনের পার্টি, গ্র্যান্ডপেরেন্টস ডে, সন্তানের নাচ, গান, কবিতা বলার ছবি-ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে দিতেই থাকেন।

বিপদ সেখানেই। ব্যক্তির পোস্ট, টাইমলাইন থেকে তাঁর পরিবার, রোজকার রুটিন, কর্মক্ষেত্র, বাচ্চার স্কুল, এমনকি তার ক্লাস, রোল নম্বর, প্রিয় বন্ধু, ডাক নাম সব কিছু অপরাধীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর সে খুঁটিনাটি খবর তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন নিজেরাই। ডিজিটাল ফরেন্সিক অ্যান্ড ফিনানশিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেটর পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায় বলছেন, “সমাজমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যের সাহায্যে ফেক প্রোফাইল, ভুয়ো আইকার্ডের সাহায্যে স্কুল থেকে বাচ্চা চুরি, ডার্ক ওয়েবে তাদের দিয়ে অপরাধমূলক কাজ করানোর মতো ঘটনা বাড়ছে।” নিজের অভিজ্ঞতা থেকে পার্থপ্রতিম জানালেন, সম্প্রতি এক বাচ্চাকে স্কুল থেকে অপহরণ করা হয়েছে বলে ফোন আসে তার মা-বাবার কাছে। সেখানে ক্লাস, রোল নম্বর সবই ঠিকঠাক জানায় আততায়ীরা। ফোনে বাচ্চার সঙ্গে মা-বাবাকে কথাও বলানো হয়। পরে দেখা যায় বাচ্চা স্কুলেই রয়েছে। তদন্তে উঠে আসে সমাজমাধ্যমে বাচ্চার ছবি থেকে খুঁটিনাটি তথ্য জোগাড় করেছে অপরাধীরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা বাচ্চার ভিডিয়ো থেকে এআই মারফত বানানো হয়েছে তার কণ্ঠস্বর। পার্থপ্রতিম বলছেন, “এত কিছু একদিনে হঠাৎ করে ফেলা সম্ভব না। এর অর্থ বহুদিন ধরেই সমাজমাধ্যমে দম্পতিকে নজরে রেখেছিল অপরাধীরা। মা-বাবার দেদার পোস্টে বিপদ হতে পারত বাচ্চাটির।”

প্রশ্নের মুখে নিরাপত্তা

ঘটনা ২: ডে আউটিং থেকে দেশ-বিদেশের লম্বা সফর, সমাজমাধ্যমে তার আপডেট, যে কোনও অনুষ্ঠান থেকে লাইভ ভিডিয়ো, সোলো ট্রিপের ছবি... যাবতীয় তথ্য আমরা পোস্ট করতে থাকি।

এতে ব্যক্তির কারেন্ট লোকেশন কিন্তু অন্যদের কাছেও স্পষ্ট। তাতে যেমন তার নিজের বিপদ হতে পারে, তেমনই বাড়ি খালি কিংবা সেখানে বয়স্ক কেউ একা রয়েছেন, সে আন্দাজও পেয়ে যায় অপরাধীরা। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বাড়ির সদস্যদের অনুপস্থিতিতে চুরি, ডাকাতি কিংবা খুনের মতো ঘটনার সংখ্যা নেহাত কম নয়। আবার রাতবিরেতে কফি শপে ছবি পোস্ট করার পরে বাড়ি ফেরার সময়ে এক সমাজমাধ্যমের বন্ধুর হাতে হেনস্থা হতে হয়েছে, এমন ঘটনার সাক্ষীও হয়েছে এ শহর।

সমান্তরাল দুনিয়ার গোলকধাঁধা

লাইক, কমেন্ট, ভিউয়ার্সের নেশায় এখন মানুষ নিজের বিশেষ মুহূর্তগুলোকেই রোজকার জীবন বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছেন। প্রতি মাসে এক-দু’বার বেড়াতে যাওয়া, সপ্তাহে দু’বার রেস্তরাঁয় খাওয়া, নিত্যনতুন পোশাকে ছবি পোস্ট করতে গিয়ে হয়তো একজনকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তবু সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘পারফেক্ট লাইফ’ ট্যাগ টিকিয়ে রাখতে মরিয়া সে। এ বার সাধ্যের বাইরের সেই দেখনদারি বজায় রাখতে গিয়েও অনেক সময়েই ব্যক্তি পা দেন ভার্চুয়াল অপরাধ জগতের নানা ফাঁদে। সুহৃতা বলছেন, “সমাজমাধ্যম থেকে হওয়া নানা বিপদের পিছনে কিন্তু ব্যক্তির নিজের লোভও দায়ী। ভুয়ো লিঙ্কের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ‘একটার সঙ্গে অন্যটা ফ্রি’, স্বল্প মূল্যে দামি জিনিস এমন প্রলোভনের ফাঁদ পাতে জালিয়াতেরা।”

অন্দরের খবর

সমাজমাধ্যমে চোখ রাখলেই বোঝা যায় রিলস, ভিডিয়ো, সেলফি, ছবি দেওয়ার তাগিদে বাড়ির নানা কোণার খবর পোস্ট করে দেন ব্যক্তি নিজেই। টুকরো টুকরো সেই মুহূর্তগুলো জুড়লে একজনের গোটা জীবনটাই অন্যের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। সুহৃতা বলছেন, “বাস্তবে যেমন অপরিচিত লোককে আমরা খুঁটিনাটি জানাই না, তেমনই সমাজমাধ্যমে পাবলিক পোস্টেও এত ব্যক্তিগত তথ্য তুলে ধরা উচিত নয়।”

নিরাপদ ভবিষ্যতের খাতিরে

কিন্তু বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে বলে কি সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়তে হবে? পুরনো বন্ধু, দূরে থাকা কাছের মানুষ সকলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম তো এখন এই দুনিয়াই। পার্থপ্রতিম বলছেন, “সমাজমাধ্যম ব্যবহার শুরুর আগে কিছু নিয়ম ঠিক করে নিতে হবে। কতটা ব্যক্তিগত তথ্য অপরিচিতের সঙ্গে শেয়ার করবেন সেই লক্ষ্মণরেখা টানতে হবে নিজেকেই।”

  • বন্ধু তালিকায় নজর: সমাজমাধ্যমে যতটা সম্ভব অপরিচিত ব্যক্তিদের এড়িয়ে চলুন। নিজের প্রোফাইল লক করে রাখুন। বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণের আগে প্রেরক অ্যাকাউন্টের খুঁটিনাটি দেখে নিন। কিছু ফেক প্রোফাইল কিন্তু নাম বা টাইমলাইন দেখলেই বোঝা যায়, সেগুলো এড়িয়ে চলুন। কাছের বন্ধু কিংবা পরিচিতদের নিয়ে আলাদা কাস্টমাইজ়ড তালিকা বানাতে পারেন। সন্দেহজনক প্রোফাইল দ্রুত ব্লক ও রিপোর্ট করুন।
  • শেয়ারের আগে ভাবুন: নিজের ঠিকানা, ফোন নম্বর, কর্মক্ষেত্র, বাচ্চার স্কুল সংক্রান্ত তথ্য যেন প্রকাশ না পায়, সে দিকে নজর রাখুন। ব্যাঙ্ক-সহ অনেক জায়গাতেই সুরক্ষার খাতিরে জন্মতারিখ ব্যবহার করা হয়। সমাজমাধ্যমে থাকা ব্যক্তিগত তথ্য তাই ‘ওনলি মি’ করে রাখুন।
  • বাচ্চাদের জন্য: সন্তানের ছবি, বিশেষত স্কুল ড্রেসে আইডি কার্ড-সহ ছবি, তার পছন্দ-অপছন্দ যতটা সম্ভব কম শেয়ার করুন। ডাকনাম, প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে তার সময় কাটানোর খবরও সমাজমাধ্যমে না দেওয়াই ভাল। বাচ্চার ভিডিয়ো, বিশেষত যেখানে তার গলার স্বর স্পষ্ট, এমন কিছু শেয়ার করবেন না। সোশ্যাল মিডিয়ার ভাল-মন্দ, সেখানে দায়িত্বশীল হওয়ার কথা সন্তানকে বোঝান।
  • নিরাপত্তার স্বার্থে: ঘুরতে যাওয়ার আগে বা সেখান থেকে কোনও পোস্ট নয়। বরং বাড়ি ফিরে এসে পোস্ট করুন। পার্থপ্রতিম বলছেন, “ছেলে, মেয়ে দু’জনেরই বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও, এ কথা সত্যি এখনও ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বিপদই বেশি। তাই সোলো ট্রিপে গেলে বা শপিং মল, কফিশপে একা সময় কাটাতে চাইলে, নিজের সুরক্ষার স্বার্থে তখনই তা পোস্ট করবেন না। সপরিবার ঘুরতে বেরোলেও কোথায় যাচ্ছেন, কবে ফিরছেন, কোথায় রয়েছেন সে সব খবরও আড়ালে রাখুন।”

সমাজমাধ্যমে পোস্ট করা তথ্যের হাত ধরে বাস্তব জীবনে বিপদের ঝুঁকি যেমন রয়েছে, তেমনই তথ্য চুরি, আর্থিক স্ক্যাম-সহ আরও সমস্যা হতে পারে। এআই মারফত ছবি, ভিডিয়োর বিকৃতি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হ্যাক ইত্যাদির শিকারও হতে পারেন। তা ছাড়া, শুধু আপনি নন, আপনার জন্য বিপদে পড়তে পারে সমাজমাধ্যমে আপনার বন্ধু তালিকায় থাকা অন্য ব্যক্তিও। তাই শক্তিশালী পাসওয়ার্ড, টু স্টেপ অথেনটিকেশন ব্যবহার করুন, ভুয়ো সফটওয়্যার থেকে সাবধান থাকুন, কোনও লিঙ্কে ক্লিক করবেন না একেবারেই। আমরা যেমন স্মার্ট হচ্ছি, অপরাধজগৎ, অপরাধীরাও কিন্তু হচ্ছে। ডিজিটাল স্ক্যামের ঘটনা কিন্তু দিন দিন বেড়েই চলেছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Social Media Online Privacy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy