অর্ধসত্য কম বিপজ্জনক নয় মিথ্যের চেয়ে। কোনও ঘটনা ঘটলেই সমাজমাধ্যম অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে। তথ্যের বিস্ফোরণে গুলিয়ে যায় চিন্তাভাবনার দিশা। সমাজবিদদের মতে, প্রত্যেকের কাছে তাঁর নিজের মতটাই সত্য। সত্যের না হয় নানা ভার্শন থাকে, কিন্তু তথ্য? ঘটনাক্রম? সেটাও বিকৃত করার উদাহরণ দেখা যাচ্ছে সমাজমাধ্যমে। আর সেই ফেক নিউজ়ের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
আর জি করের ঘটনার সময়ে একটি ভয়েস নোট ভাইরাল হয়। পরে জানা যায় সবটাই ভুয়ো, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিছু দিন আগে একটি গাড়িতে আগুন লাগার ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে, যার জেরে আতঙ্ক ছড়ায়। ক্রমে জানা যায়, সেটি এ রাজ্যের ঘটনাই নয় এবং কয়েক বছরের পুরনো ভিডিয়ো। সম্প্রতি পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরেও এমন অনেক ফেক ছবি ও ভিডিয়ো ছড়িয়েছে। তার মধ্যে যেমন রয়েছে এআই জেনারেটেড ছবি, তেমন এক যুগলের ভিডিয়োও ছড়িয়ে যায়। পরে সেই দম্পতি জানান, তাঁদের ভিডিয়ো ব্যবহার করে বলা হচ্ছে তাঁরা এই সন্ত্রাসবাদী হামলার শিকার, যা আদৌ সত্যি নয়। তাঁরা পহেলগামেই যাননি।
প্রতিটি রাজনৈতিক দল একে অপরের আইটি সেলের দিকে যখন অভিযোগের আঙুল তোলে, তা বুঝিয়ে দেয় কারও বয়ানই সম্পূর্ণ সত্য নয়। বিকৃত তথ্য, ভুয়ো খবরের জেরে সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ক্ষতি হচ্ছে সমাজের। সমাজতত্ত্ববিদ সুহৃতা সাহা বলছিলেন, “একটা ঘটনা ঘটলে তার নানা রকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। সত্যিটা সকলের ক্ষেত্রে আলাদা।” সম্প্রতি পাঠ্যবই থেকে মোগল পিরিয়ড বাদ পড়ার কথা তুলে ধরলেন সুহৃতা। এতে একটা প্রজন্মের কাছে ভারতীয় ইতিহাসের একটা দিক সম্পূর্ণ অজানা থেকে যাবে। সত্য ও তথ্য চেপে দেওয়ার প্রবণতাও সমাজের জন্য কম ক্ষতিকর নয়, মত তাঁর।
সাইবার ক্রাইম বিভাগের স্পেশ্যাল পাবলিক প্রসিকিউটর বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, “ভার্চুয়াল দুনিয়ার পেনিট্রেটিং পাওয়ার খুব বেশি। সমাজমাধ্যমে সকলেই ভাইরাল হতে চায়, বেশি লাইক পেতে চায়। কিছু লেখার বা শেয়ার করার আগে যাচাই করে না, তা সত্যি না মিথ্যে। সমাজমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু মানুষের মধ্যে এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল ডিজ়অর্ডার চলে এসেছে।”
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার ভুয়ো খবর, ভিডিয়োর ঘটনা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তারকাদের ডিপফেক ছবি-ভিডিয়ো বানিয়ে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার নানা উদাহরণ সাম্প্রতিক কালে প্রকাশ্যে এসেছে। তা ছাড়া যে কোনও লোকের মুখে যে কোনও বক্তব্য বসিয়ে দেওয়া যায়। এই ধরনের ভুয়ো ভিডিয়োর মাধ্যমে খুব সহজেই সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানো যায়। ডিপফেক ভিডিয়ো ব্যবহার করে বিনিয়োগে জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। নামী ব্যবসায়ীর মুখে বসানো হয়েছে, কোথায় কী ভাবে বিনিয়োগ করলে লাভ হবে সেই সব তথ্য। তা দেখে অনেকেই সেই মতো পদক্ষেপ করে প্রতারিত হয়েছেন।
সরকার নির্বাচন, জম্মু ও কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল কিংবা পহেলগামের মতো বড় ঘটনা ঘটলে সমাজমাধ্যম অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের সময়ে কী ভাবে এক্স, ফেসবুক এবং ওয়টস্যাপ ইত্যাদি ব্যবহার করে মিথ্যে তথ্য প্রচার করা হয়েছিল, তা বিশদে ব্যাখ্যা করেছিলেন ইউটিউবার ধ্রুব রাঠী। ওয়টস্যাপ ইউনিভার্সিটি নামে একটি নতুন শব্দবন্ধের সঙ্গে আমরা সকলেই এখন পরিচিত।
ইন্টারনেটের ভুয়ো খবর, ছবি বন্ধের ক্ষেত্রে আইনের ভূমিকা কতটা? বিভাস চট্টোপাধ্যায় জানালেন, আইটি রুল ২০২১ বা তারও আগে থেকে ফেক নিউজ় নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধের চিন্তাভাবনা চলছে। কোনও লেখা, ছবি, ভিডিয়ো থেকে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানো, কারও ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত, যৌন হেনস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আইনি বিধিনিষেধ ছিল ইন্ডিয়ান পিনাল কোডে। বর্তমানে ভারতীয় ন্যায় সংহিতাতেও একই আইন রয়েছে। কিছু সেকশনের নম্বরে বদল ঘটেছে। ফেক নিউজ়ের কারণে কী ধরনের ঘটনা ঘটেছে, সেটির উপরে নির্ভর করে শাস্তির মাত্রা। অপরাধ প্রমাণিত হলে ন্যূনতম তিন বছর বা তার বেশি কারাদণ্ড হতে পারে।
“প্রিন্ট মিডিয়ার উপরে প্রেস কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু অনেক দিন পর্যন্ত অনলাইন পোর্টালের ক্ষেত্রে তেমন কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাই যে কোনও খবর চালিয়ে দেওয়া যেত। অনলাইন নিউজ় পোর্টালের উপরে এখন অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে,” বললেন বিভাস চট্টোপাধ্যায়। যে এআই দিয়ে ভুয়ো তথ্য প্রচারিত হচ্ছে, ফেক নিউজ় সরানোর হাতিয়ারও সেটিই। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ ডেটা ক্রমাগত জমা হচ্ছে যে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া বা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
শুধু সরকারি নয়, সামাজিক পর্যায়েও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। সমাজতত্ত্ববিদ সুহৃতার মতে, সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। “ভুয়ো খবর প্রচারের ক্ষেত্রে আমাদেরও দায় রয়েছে। যা দেখছি, শুনছি সবটা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যাবে না। যুক্তি খুঁজতে হবে, ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করতে হবে, প্রশ্ন তোলা দরকার,” মন্তব্য সুহৃতার। আর জি করের ঘটনার সময়ে নির্যাতিতার ছবি অনেকেই শেয়ার করেছিলেন, যা আইনবিরুদ্ধ। তেমন ভাবেই পহেলগামের সন্ত্রাসবাদী হামলা নিয়ে নানা পরস্পর বিরোধী তথ্য নজরে আসছে। তার মধ্যে অনেক তথ্যই এমন, যার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সংহতি বিঘ্নিত হতে পারে। কিন্তু তার পরেও দেদার শেয়ার, লাইক চলছে। সম্যক জ্ঞানের অভাব এবং ইন্টারনেটে নিজেকে জাহির করার প্রবণতাই এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সুহৃতা এবং বিভাস দু’জনেই।
কোনও কিছু পোস্ট, শেয়ার করার আগে তার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সমাজমাধ্যমের চেয়ে নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যমের উপরে আস্থা রাখতে হবে। সাম্প্রদায়িক হিংসা, ধর্মীয় ভেদাভেদ সংক্রান্ত কিছু পোস্ট করার আগে সচেতন হতে হবে। নয়তো নিজেদের রচিত চক্রব্যূহে নিজেরাই ঢুকে যাব।
মডেল: সৃজলা গুহ, দেবজ্যোতি চক্রবর্তী; মেকআপ: সৈকত নন্দী;
ছবি: চিরঞ্জীব বণিক; (দেবজ্যোতি), অমিত দাস (সৃজলা); পোশাক (দেবজ্যোতি): একচালা; লোকেশন: অঞ্জলি কুঞ্জ (বারুইপুর); ফুড পার্টনার: মিষ্টি ম্যাজিক
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)