Advertisement
E-Paper

সরকারি হাসপাতালে থেকেই ক্যানসার জয়! সেই কথাই শোনালেন অজয়

যে দিন প্রথম শুনলাম আমার ক্যানসার, খুব কষ্ট হয়েছিল। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, ক্যানসারের চিকিৎসা করাব সরকারি হাসপাতালে। লিখছেন অজয় গুপ্ত।ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, ক্যানসারের চিকিৎসা করাব ‘আমার ভারতবর্ষে’, অর্থাৎ সরকারি হাসপাতালে। কারণ দীর্ঘ চিকিৎসার খরচ টানার সামর্থ্য ছিল না। তার পর....।

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ ১১:২৩
ক্যানসারবিজয়ী অজয় গুপ্ত।

ক্যানসারবিজয়ী অজয় গুপ্ত।

প্রায় মাস দেড়েক ছোটাছুটি করার পরে এস-৪১১ ঠিকানাটা খুঁজে পেয়েছিলাম। ঘরের কোণ ঘেঁষা বিছানা, পাশেই রয়েছে ওষুধ এবং জরুরি জিনিস রাখার ছোট কাবার্ড। ৫ জুন, ২০০৯। ভ্যাপসা গরমে ভরসা বলতে, মাথার উপরে বনবন করে ঘুরতে থাকা পাখা। পুরনো দিনের বাড়ি, তার উপরে তিনতলা, ফলে খোলামেলা ঘরটা এক ঝলকে ভাল লেগে গেল। চিত্তরঞ্জন দাশের এই বাড়িতে‌ গত শতকের পঞ্চাশ সালে তৈরি হয়েছিল ‘চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতাল’।

নজর আটকাল পাশের শয্যায়। বড় বড় চোখে অস্বাভাবিক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে কঙ্কালসার এক বৃদ্ধ। ক্যাথিটারে রক্ত ভরা প্রস্রাব। চাদরের নীচ থেকে বেরিয়ে দু’টি পা। দু’পায়েরই বুড়ো আঙুল থেকে পরপর তিনটি করে কাটা। ঘুরে ঘুরে সে দিকেই নজর যাচ্ছিল।

লক্ষ করেছিলাম, ভিজিটিং আওয়ার্সে কেউ আসেননি ওঁর কাছে। ঘোর কাটল সিস্টারের ডাকে। রোজের প্রয়োজনীয় জিনিস আর ওষুধ, প্রেসক্রিপশনের থলিটা-সহ আমাকে রেখে একে একে নেমে গেল প্রিয় মুখগুলো। বোনের কান্নাভরা চোখ আর ভাইয়ের বিষণ্ণ চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, আমাকে বুঝি ধাপার মাঠে ফেলে গেল। বাজে চিন্তা কাটাতে করিডরে ঘুরে এলাম। দু’-এক জনের সঙ্গে গল্পে জানলাম তাঁদের ক্যানসার পর্বের ইতিহাস।

আরও পড়ুন: ক্যানসার চিকিৎসাকে নাগালে আনতে পারে ‘টিম ওয়ার্ক’

রাতের খাবার খাওয়ার পরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ‘বলো হরি হরি বোল, বলো হরি হরি বোল’— বার কয়েক কানে যেতে যখন ঘুম ভাঙল, বুঝলাম আমি এখনও বেঁচে আছি। চার দিকে চেয়ে দেখলাম, শূন্য দৃষ্টির সেই বৃদ্ধ হাত-পা ছুড়ে বিছানায় শুয়েই শ্মশানযাত্রা করছেন। আতঙ্ক চেপে বসল মনে। মাস কয়েক আগে জেনেছি, আমার কোলনের অর্ধেকটা জুড়ে অ্যাডিনো কার্সিনোমা বাসা বেঁধেছে। তারই অস্ত্রোপচার করতে ভর্তি হয়েছি আমার ভারতবর্ষে (যে পরিকাঠামোয় এ দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা করেন)।

সারা রাত ঘুম হল না। সকালে উঠে ভাবলাম, নাহ! অজয় গুপ্ত তো মরার আগেই মরে বসছে। ছেচল্লিশের দাঙ্গার পরে স্বভূমি ছেড়ে আসা সেই সিংহশাবক কি তবে ৬৩ বছর পরে ইঁদুর হয়ে গেল? অথচ শৈশব থেকেই সবেতে আমার অতিরিক্ত উৎসাহের কারণে পরিবারে ডাকাবুকো পরিচয় পেয়েছিলাম।

চোখ বন্ধ করলাম। বাংলাদেশ ছেড়ে কয়েকটা অমূল্য পোঁটলা আর আত্মীয়দের সঙ্গে ঠাঁই হয়েছিল দমদম স্টেশন সংলগ্ন হরকালী কলোনিতে। মাটিতে খড় বিছিয়ে ভাই-বোনেরা ঘুমোতাম। এতগুলো মুখের খাবার কী ভাবে জুটত জানি না, তবে ছোটরা না খেয়ে থাকতাম না। পাড়ার পুকুরে গরু-বাছুরের সঙ্গে ডুব মারতাম। চুলকানি হলে ফুটপাতে মিলত একটা ওষুধ, তাই লাগাতাম। অনেকটা হেঁটে আর কিছুটা বাসে চেপে স্কটিশ চার্চ স্কুলে পৌঁছতাম। সেই সব লড়াই কি কিছু কম কঠিন ছিল? প্রশ্ন করি নিজেকে। কলোনিতে গা ঘেঁষা প্রতিবেশী ছিলেন উকিল, ডাক্তার, মাস্টার, চোর আর মাতাল। ফলে, বিনোদনের অভাব হত না। যৌথ পরিবারে বড় হওয়া ভাই-বোনেদের ভালবাসা থেকেছে শ্মশানযাত্রা পর্যন্ত। কারণ পারিবারিক সম্পত্তি বলতে, পদবি আর কনস্টিপেশন।

আরও পড়ুন: সিওপিডি-তে মৃত্যু প্রতি ১০ সেকেন্ডে! বাঁচব কী ভাবে?

হাসিমুখে। ক্যানসারজয়ীদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান। —নিজস্ব চিত্র।

‘দাদু চা নেবে তো? গ্লাস দাও’— চোখ খুলে দেখি, খালি গায়ে বছর আষ্টেকের এক বালক কেটলি হাতে দাঁড়িয়ে। স্থির করলাম, হরকালী কলোনির সেই বালককে জাগিয়ে তুলতে হবে। ভাবলাম, ভিটেমাটি ছেড়ে আসার পরে প্রতি মুহূর্ত যে লড়াই করেছিলাম, এ-ও তো তেমনই লড়াই। তবে চারদিকে কেন এত আতঙ্ক? পরীক্ষা পাশের লড়াই, চাকরি পাওয়ার লড়াই, চাকরি হারানোর লড়াই— সবই সাহসের সঙ্গে মুখোমুখি করেছি। ৭০ দশকের গোড়ায় স্কুলে শিক্ষকতা ছেড়ে একটি সংবাদপত্রে যুক্ত হই। বছরখানেক পরে কলকাতায় সোভিয়েত কনস্যুলেটের তথ্য দফতরে যোগ দিই। ’৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে ১৭ বছরের কাজটা চলে যায়। ফের অনিশ্চিতের দৌড়। বিয়ে করিনি। তাই একটা পেটেরই চিন্তা ছিল‌। কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা আর বই সম্পাদনা শুরু করি। কারণ হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র কোনও কালেই নই।

যে দিন প্রথম শুনলাম আমার ক্যানসার, খুব কষ্ট হয়েছিল। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, ক্যানসারের চিকিৎসা করাব ‘আমার ভারতবর্ষে’, অর্থাৎ সরকারি হাসপাতালে। কারণ দীর্ঘ চিকিৎসার খরচ টানার সামর্থ্য ছিল না। তাই নিজেকে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারের নিরস্ত্র মেঘনাদ মনে করে ‘কোশাকুশি’ নিয়েই সশস্ত্র লক্ষ্মণরূপী ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইয়ের ছক কষতে লাগলাম। তবে মেঘনাদের মতো পরিণতি হবে, এমনটা ধরবেন না, আমিও ধরিনি। কারণ এখন তো ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে আমাদের সঙ্গে।

আমার আপত্তি রয়েছে, ক্যানসার সচেতনতার বিজ্ঞাপন নিয়ে। সর্বত্র বলা হয়, ‘ক্যানসার একটি মারণ রোগ’। কেন? মৃত্যুর একমাত্র কারণ জন্ম। ধ্রুব সত্য এটাই। দুর্ঘটনায় আর ক্যানসারে মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য যে, প্রথমটি আপনাকে সময় দিল না। দ্বিতীয়টি জানিয়ে দিল, আপনার হাতে সময় সীমিত। এই কঠিন সত্যটা যিনি মেনে নেবেন, তিনি অর্ধেক ক্যানসার জয় করে ফেলবেন। অহেতুক রোগীর কাছে ক্যানসার লুকোনোর একটা প্রবণতা রয়েছে এ দেশে। ২০০০ সালে পেটের ক্যানসারে ভুগে মারা যান দিদি। একই কারণে মৃত্যু হয়েছিল কাকিমার। কী অসুখ হয়েছে, না জেনে দু’জনেই পৃথিবী ছেড়েছিলেন। জানলে হয়ত ইতর বিশেষ হত না। কিন্তু আমার শেষ পরিণতিটা সবাই জানলেন, শুধু আমি বাদে! আমার কাছে এটা কেমন যেন ঠেকে।

যে দিন জেনেছিলাম, আমার ক্যানসার, সেই দিন থেকে সরকারি হাসপাতালে তার চিকিৎসার সুযোগ কতটা, সে জ্ঞান সঞ্চয়ে উঠে পড়ে লাগলাম। আত্মীয়-বন্ধুদের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও ঠিক করেছিলাম, চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালেই চিকিৎসা করাব। দশ বছর আগে আমার কোলনের সাড়ে তিন ফুট বাদ দিতে সেই অস্ত্রোপচারে খরচ হয়েছিল আড়াইশো টাকা! ১৭ দিনের হাসপাতাল বাস পর্বে মোট খরচ হয়েছিল সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা!

আরও পড়ুন: হার্টের অসুখ ঠেকাতে চান? ডায়েটে অবশ্যই রাখুন এই খাবার

এখন তো সরকারি হাসপাতালগুলিতে বিনামূল্যে ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসার অনেক সুযোগ হচ্ছে। চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে থাকাকালীন দেখেছি, সপ্তাহে এক দিন চিকিৎসকদের বোর্ড বসে। রোগীদের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয় সেখানে। প্রত্যেক চিকিৎসক, আপ্রাণ চেষ্টা করেন রোগীকে সুস্থ করার। ক্যানসার রোগী হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা, ঠান্ডা মাথায় ডাক্তারের প্রতি আস্থা রেখে নিজের চিকিৎসা সম্পর্কে জানুন। নিজেকে হাল্কা রাখতে নতুন উপায় উদ্ভাবন করা খুব জরুরি। অস্ত্রোপচারের পরে যখন কেমোথেরাপি নিতে হচ্ছিল, তখন বাইরে যাওয়ায় নিষেধ করেছিলেন ডাক্তারবাবুরা। এক দিন তাঁদেরই এক জনকে বললাম, “খুব বেড়াতে ভালবাসি। অনেক দিন কোথাও যাইনি। এত কষ্ট করে আপনারা বাঁচালেন, এ বার যদি দম বন্ধ হয়ে মরে যাই! তার চেয়ে ক’দিনের ছুটি দিন পুরী ঘুরে আসি।’’ হাসতে হাসতে সম্মতি দেন ডাক্তারবাবু।

প্রতি বার কেমোথেরাপি নেওয়ার পরে ৭০টি ক্যাপসুল খেতে হত। ছ’টি কেমোথেরাপি নিয়ে মোট ৪২০টি ক্যাপসুল খেয়েছিলাম। ওষুধের সতর্কবার্তায় ছিল, কনস্টিপেশন অথবা পাতলা পায়খানা, ধারাবাহিক ভাবে চলবে এমন। গত ১১ বছর ধরে সেই বার্তা বেইমানি করেনি। এ নিয়ে ভেঙে পড়ি না। বরং ক্যালেন্ডার দেখে ঝালিয়ে রাখি, কোন পর্বটা কবে থেকে শুরু হবে। এখন আশি বছর বয়স। গত দশ বছরে ধরে নিজের ইচ্ছেগুলো দ্রুত পূরণ করার চেষ্টা করছি। এই মুহূর্তে বিদ্যাসাগরের উপরে কাজ করছি। জানি দ্রুত শেষ করতে হবে। আড্ডা তো আছেই, গান শুনি, বইয়ের ভাণ্ডারে ডুবে যাই। আর ডাক্তারবাবুদের কথা মতো চলার চেষ্টা করি।

বিশ্বাস করুন, ক্যানসারের আতঙ্ক জয় করতে পারলে লড়াইটা অনেক সহজ হয়। কী কাজ বাকি আছে, তার তালিকা করে নিন। প্রতিদিন সকালে নিজেকে কথা দিন, সে দিন কোনটি করবেন। শরীর নিয়ে বাতিকগ্রস্ত হবেন না। হাসিখুশি থাকুন।

মুহূর্তগুলি প্রাণ ভরে উপভোগ করে নিন।

Cancer Govt Hospitals Health Tips Fitness Tips
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy