Advertisement
E-Paper

ক্যানসার চিকিৎসাকে নাগালে আনতে পারে ‘টিম ওয়ার্ক’

ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইটা ‘টিম ওয়ার্ক’ হওয়া উচিত। সেটার অভাবের কারণেই ততটা ভরসা পায় না রোগীর পরিবার।

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ ১০:৫১
অপেক্ষা হাসপাতালে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুরা। —নিজস্ব চিত্র।

অপেক্ষা হাসপাতালে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুরা। —নিজস্ব চিত্র।

বেশ কয়েক মাস ধরেই পায়ের বুড়ো আঙুলে একটা অদ্ভূত ব্যথা হত। ডাক্তার দেখানোর কথা মাথায় এলেও কাজের চাপে হয়ে উঠছিল না কর্মসূত্রে আগরতলার বাসিন্দা, মৎস্য দফতরের ওই পদস্থ কর্তার। এক দিন জোর করেই চিকিৎসকের কাছে গেলেন। বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে জানতে পারলেন, শরীরে বাসা বেঁধেছে কর্কট রোগ। আদতে কলকাতার বাসিন্দা ওই রোগীর পরিবার তখন ঠাকুরপুকুরের এক ক্যানসার হাসপাতালে বছর দেড়েক চিকিৎসা চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। কপর্দকহীন পরিবারের তিন নাবালক সন্তান যখন তাদের বাবাকে হারাল, তখনও এ শহর জানত ‘ক্যানসার, নো আনসার’।

আশির দশকের মাঝামাঝির সেই সময় আজ অনেকটাই বদলেছে। ক্যানসারকে পুরোপুরি বধ করতে না পারলেও আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র এখন তার সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে চলেছে। যদিও পরিবারের কেউ ক্যানসার আক্রান্ত শুনলে আজও মুম্বই, দক্ষিণ ভারতকেই ভরসা করেন ভুক্তভোগীদের একটা বড় অংশ। আর পরিবার আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল হলে চলে যায় বিদেশে। শহরের ক্যানসার চিকিৎসকেরা অবশ্য এর অন্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তাঁদের মতে, কিছু চিকিৎসক রোগ নির্ণয়ের অপারগতা ঢাকতে রোগীকে ভিন্ রাজ্যে যেতে উৎসাহিত করেন। অন্য কারণটি হল, এ রাজ্যে চিকিৎসা এখনও ব্যক্তিভিত্তিক। দক্ষিণ ভারত এবং মুম্বইয়ে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক। ফলে গল্পটা অনেকটা সেই এক গোছা কাঠিকে না ভাঙতে পারার মতোই। তাঁদের মতে, ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইটা ‘টিম ওয়ার্ক’ হওয়া উচিত। সেটার অভাবের কারণেই ততটা ভরসা পায় না রোগীর পরিবার।

তবে দেরিতে হলেও শহরের কয়েকটি জায়গায় একই ছাদের তলায় ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে। চিরাচরিত ‘ওপেন সার্জারি’-র পাশাপাশি হচ্ছে ল্যাপারোস্কোপিক অস্ত্রোপচার।

আরও পড়ুন: হার্টের অসুখ ঠেকাতে চান? ডায়েটে অবশ্যই রাখুন এই খাবার

ক্যানসারের বিপদ সঙ্কেত
‘সাবধানতা স্বাগত’

• সারতে না চাওয়া ঘা
• বক্ষ (স্তনে) বা শরীরের কোথাও দলা বা স্ফীতি দেখা দেওয়া।
• ধারাবাহিক অথবা অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ শরীরের যে কোন অংশ থেকে।
• নজরকাড়া পরিবর্তন তিল বা আঁচিলে।
• তাড়াতাড়ি ওজন কমতে থাকা বা অজ্ঞাত কারণে দীর্ঘস্থায়ী জ্বর।
• স্বাভাবিক মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন।
• গলার স্বর বসে যাওয়া বা দীর্ঘস্থায়ী ঘ্যানঘ্যানে কাশি।
• তখনই খাবার গেলার অসুবিধা এবং বদহজম।
• উপরের লক্ষ্মণগুলি তিন সপ্তাহ স্থায়ী হলে ও সাধারণ চিকিৎসায় না সারলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

তথ্যসূত্র: উৎপল সান্যাল (ক্যানসার গবেষক)

পেটের ক্যানসারে ব্যবহার হয় এই পদ্ধতি। খুব ছোট টিউমার অস্ত্রোপচারে এই পদ্ধতি বেশি সফল। সামান্য কাটাছেঁড়া করে অস্ত্রোপচার হওয়ায় রোগীর শারীরিক ধকলও কম হয়। ইসোফেজিয়াল, কোলোরেক্টাল ক্যানসারের চিকিৎসায় ল্যাপারোস্কোপিক অস্ত্রোপচার এসএসকেএমে নিয়মিত হয়। বেসরকারি ক্ষেত্রে অবশ্য একাধিক জায়গায় হয়।

ক্যানসারের অস্ত্রোপচারে বিশ্বের সর্বাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি রোবোটিক সার্জারি। আজও সেটি কলকাতায় অপ্রতুল। বাইপাসের ধারের এক হাসপাতালে ও রাজারহাটের ক্যানসার হাসপাতালে এই অস্ত্রোপচার হয়। রাজারহাটের ক্যানসার হাসপাতালটির ডেপুটি ডিরেক্টর ভি আর রামানন বলেন, “দেড় বছর ধরে ব্লাডার, প্রস্টেট, কিডনি, গাইনি, কোলন, ফুসফুস ও ইসোফেগাস ক্যানসারের চিকিৎসায় রোবোটিক সার্জারি করা হচ্ছে। হাসপাতাল ভবনে আরও ২৫০টি শয্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্তও হয়েছে।” তবে ভবিষ্যতে নিখুঁত এই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রসারের জন্য সরকারের এখনই প্রশিক্ষিত চিকিৎসক তৈরির কাজ শুরু করা জরুরি বলে মনে করছেন এসএসকেএম হাসপাতালের ক্যানসার চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকার। এ বিষয়ে সহমত ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়, গৌতম মুখোপাধ্যায়, অনুপ মজুমদার, আশিস মুখোপাধ্যায়-সহ অন্যেরাও।

ক্যানসার চিকিৎসায় আরও একটি বড় পরিবর্তন আংশিক সার্জারি বা মিনিমাল সার্জারির প্রসার। স্তন এবং মুখের ক্যানসারের জন্য এই অস্ত্রোপচার অনেক বেশি কার্যকর। এই পদ্ধতিতে আগের মতো মুখের অনেকটা বা পুরো স্তন কেটে বাদ দিতে হয় না। শুধু আক্রান্ত অংশটুকু বাদ দেওয়া হয়। ফলে রোগীর শারীরিক ধকল কম হয় এবং আত্মবিশ্বাসেও ততটা চিড় ধরে না। ২০০০ সাল থেকে এসএসকেএমে স্তনের বিভিন্ন অসুখের চিকিৎসা শুরু হলেও স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা এবং গবেষণার জন্য একটি পৃথক বিভাগ চালু হয়েছে ২০১১ সাল থেকে। সেখানে স্তন ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসা বিনামূল্যে হয়।

অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগে। ইতিমধ্যেই রাজারহাটের ক্যানসার হাসপাতালটি প্রায় ৪০০টি অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করেছে বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। বর্তমানে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শুরু হয়েছে এই অস্ত্রোপচার।

ক্যানসার নির্ধারণেও কলকাতা এখন অনেক সাবালক। ফাইন নিডল অ্যাস্পিরেশন সাইটোলজি (এফএনএসি) থেকে অনেক এগিয়ে গিয়েছে কলকাতা। ইমেজ গাইডেড বায়োপসি এখানে যেমন হচ্ছে, পাশাপাশি এসে গিয়েছে ট্রু-কাট বায়োপসি। এই পদ্ধতিতে টিউমারের কাছে সামান্য ফুটো করে বিশেষ এক ধরনের বন্দুক চালিয়ে টিস্যু বার করে আনা হয়। স্তন ক্যানসার নির্ধারণে এই পদ্ধতি জনপ্রিয়। শরীরে কত দূর ক্যানসার ছড়িয়েছে, তা জানাতে বছর কয়েক আগে শহরে এসে গিয়েছে পেট সিটি স্ক্যান। বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে এই যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারি স্তরে শুধুমাত্র এন আর এসে রয়েছে এটি। যেখান থেকে রোগীরা বিনামূল্যে এই পরিষেবা পেতে পারেন।

কোবাল্ট মেশিনের যুগ পেরিয়ে রেডিয়েশন থেরাপিতে ঢুকে পড়েছে লাইনাক বা লিনিয়ার অ্যাক্সিলারেটর। গত বছরই শহরের সরকারি হাসপাতালে কয়েকটি লিনিয়ার অ্যাক্সিলারেটর যন্ত্র বসেছে। তাদের কোনওটি পরীক্ষামূলক স্তরে রয়েছে, কোনওটি দৌড় শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কলকাতায় আসতে চলেছে রেডিয়েশন থেরাপির আরও একটি আধুনিক চিকিৎসা, স্টিরিয়োট্যাকটিক রেডিয়ো সার্জারি। আক্রান্ত কোষে সরাসরি হানা দেয় এই যন্ত্র। হাই এনার্জিতে রেডিয়েশন দিয়ে মাখনের মতো কেটে নিয়ে আসা যায় কোনও টিউমার। বর্তমানে বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতাল এই পদ্ধতি ব্যবহার হয়। বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসে এই যন্ত্র আনার কথাবার্তা চলছে।

বেসরকারির পাশাপাশি, সরকারি হাসপাতালে ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি শুরু হয়েছে। এই পদ্ধতিও ক্যানসার রোগীর চিকিৎসায় যথেষ্ট সহায়ক। এর মাধ্যমে দেখা হয়, রোগীর উপরে কোনও ওষুধের কার্যকারিতা কতখানি।

ক্যানসারের ভবিষ্যৎ যে জেনেটিক ডায়াগনোসিস বলবে, এ নিয়ে চিকিৎসক মহলে কোনও দ্বিমত নেই। তারই একটি উদাহরণ মলিকিউলার মার্কার টেস্ট এখন এ শহরে হচ্ছে। কোনও ক্যানসার আক্রান্ত টিস্যুতে ওষুধ পৌঁছে দিতে এই পরীক্ষা জরুরি। এর ফলে শরীরের অন্য অংশে ওষুধের প্রভাব না ছড়িয়ে দ্রুত কাজ শুরু করে। মলিকিউলার গাইডেড কেমোথেরাপি এখন মিলছে কলকাতার সরকারি হাসপাতালেও। ৪০ হাজার থেকে শুরু করে লক্ষাধিক টাকা দামের কেমোথেরাপির সেই সব ওষুধ শহরের প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।

জেনেটিক ডায়াগনোসিসের মাধ্যমে বিআরসি-ওয়ান, বিআরসি-টু, পি-৫৩ জিনগুলো পরীক্ষা করে জানা যাবে শরীরের কোন জিনে লুকিয়ে স্তন ক্যানসারের জীবাণু। এ শহরে বসে অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মতো আপনিও তা জানতে পারবেন। নিউ টাউনের এক বেসরকারি ডায়াগনস্টিক কেন্দ্র বছর দেড়েক আগে শুরু করেছে স্তন ক্যানসার নির্ধারণের এই পরীক্ষা।

চিকিৎসকদের মতে, সরকার তো রয়েছেই, পাশাপাশি বেসরকারি অংশগ্রহণও জরুরি। তাঁদের পরামর্শ, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা সাধারণের নাগালে আনতে শহরে তৈরি হোক আরও বেশি প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ক্যানসার চিকিৎসার পরিকাঠামো।

Fitness Tips Health Tips Cancer
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy