Advertisement
E-Paper

রং দিয়ে নয়, চোখ ঢাকা থাক চশমার আড়ালে

ফাগুনের ফাগে রাঙা দুপুর, অথচ চোখের সামনে অন্ধকারের পর্দা। খানিক আগেই যারা ছিলেন আনন্দে মুখর, এখন তারাই যন্ত্রণায় কাতর। দোলই বলুন অথবা হোলি, এমন ঘটনার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। দোলের রঙে থাকা রাসায়ানিকের প্রভাবে চোখের মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। চোখ বাঁচিয়ে রং খেলতে পরামর্শ দিলেন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ নন্দিনী রায়। শুধুমাত্র কলকাতার হাজার দশেকেরও বেশি মানুষ দোলের দিন চোখে অন্ধকার দেখেন। কলকাতা ও শহরতলির চোখের হাসপাতাল আর ক্লিনিকে চোখের কষ্ট নিয়ে ভিড় উপচে পড়ে।

সুমা বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১২:৪১
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শুধুমাত্র কলকাতার হাজার দশেকেরও বেশি মানুষ দোলের দিন চোখে অন্ধকার দেখেন। কলকাতা ও শহরতলির চোখের হাসপাতাল আর ক্লিনিকে চোখের কষ্ট নিয়ে ভিড় উপচে পড়ে। আর যেখানে এই সুযোগ নেই তাঁদের অনেকেই দৃষ্টিহীনতা বা ক্ষীণ দৃষ্টির সমস্যা বয়ে বেড়ান আজীবন। আবির আর রঙে একে অপরকে রাঙিয়ে দিতে গিয়ে দিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হলে চোখ নামক মহামূল্যবান ইন্দ্রিয়টির বিপদ প্রায় অবধারিত। ব্যাপারটা যেন অনেকটা সেই পাঠান কেসর খাঁয়ের সঙ্গে রাজপুতানিদের হোরি খেলা হয়ে যায়। অথচ একটু সতর্ক থাকলে এই বিপদ প্রতিরোধ করা যায় সহজেই।

আবিরের বিপদ পশ্চাতে

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চোখের বিপদ আসে পিছন দিক থেকে। অনেক সময় আবার শূন্য থেকেও উড়ে আসে বিপদ রং। আসলে বন্ধুদের চমক দিতে গিয়ে পিছন দিক থেকে দৌড়ে এসে মুখে রঙ মাখাতে গিয়ে চোখে আবির ঢুকে যায়। চোখে কিছু ঢুকলেই সহজাত রিফ্লেক্সে হাত চলে যায় চোখে। চোখ রগড়ে রঙ বের করার চেষ্টা করা একটা সহজাত প্রবৃত্তি। আর বিপদের সূত্রপাত এখানেই।

ভেষজ পাউডার দেওয়া আবির হোক অথবা চিরাচরিত অভ্র মিশ্রিত, দুটোই চোখ জ্বালা আর অঝোর ধারায় জল বইয়ে দেয়। আবিরে থাকা অভ্র বা কাচের গুঁড়োয় চোখের কর্নিয়া ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আবির মূলত ক্ষারধর্মী। অ্যালাকালাইন এর প্রভাবে চোখের সংবেদনশীল অংশ ঝলসে যাওয়ার একটা ঝুঁকি থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই কর্নিয়াল বার্নের অন্যতম কারণ আবির। চোখের মধ্যে যে এপিথেলিয়াল টিস্যু থাকে শুকনো আবির তাকেও পুড়িয়ে দিতে পারে। দোলের রং থেকে চোখের বিভিন্ন অংশের টেমপোরারি কেমিক্যাল বার্নের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। তাই এই ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। গালে আবির মাখান, পিছন থেকে আচমকা অনিচ্ছুককে চোখমুখে রং মাখানোর চেষ্টা করবেন না। চোখে রং ঢুকে গেলে অনবরত জল দিয়ে ধুয়ে নিন। হাত দিয়ে ঘষে বার করার চেষ্টা করলেই বিপদে পড়ার সম্ভাবনা ষোল আনা। অবিলম্বে ডাক্তারি পরামর্শ নিন। নইলে দৃষ্টিশক্তির স্থায়ী সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

উড়ন্ত বিপদের ঝুঁকি

না কোনও মশা বা পোকার হামলা নয়। বহুতলের বারান্দা অথবা যেখান সেখান থেকে বাচ্চারা, এমনকী বড়রাও রং ভরা বেলুন ছুড়ে রাঙিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই উড়ন্ত বিপদ আঘাত করতে পারে চোখেও। শরীরের অন্য অংশকে তেমন ঘায়েল করতে না পারলেও চোখে লাগলে মারাত্মক বিপদের ঝুঁকি থাকে। জোর আঘাতে চোখ ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাসায়ানিকের ক্ষতিকর দিক ছাড়াও জোর আঘাতে চোখের পাতা থেকে শুরু করে চোখের কর্নিয়া এমনকি রেটিনারও সমস্যা হতে পারে। তাই এই ব্যাপারটাও সবাইকে মাথায় রাখতে হবে। ছোটদের শেখান যে জোর করে অন্যের কষ্টের কারণ হয়ে কখনওই রং খেলা উচিত নয়। অনেক বাচ্চা আবার লম্বা পিচকিরি দিয়ে পথচলতি মানুষের গায়ে রং ছোড়ে। তীব্র রঙের জেট থেকেও চোখ ও কান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বেশি বিপদে পড়ার সম্ভাবনা সাইকেল ও বাইক আরোহীদের।

আরও পড়ুন: জেনে নিন দোলের কোন রং কী ভাবে ক্ষতি করে আমাদের

রঙিন সমস্যা

সুন্দর ও স্নিগ্ধ রং দৃষ্টির জন্যে আরামপ্রদ হলেও চোখের জন্যে নয়। অথচ “স্থলে জলে বনতলে” দোল উৎসবে মুখর। দোল খেলুন কিন্তু চোখ বাঁচিয়ে। এমন না হয় যাবতীয় রং ঝাপসা হয়ে যায়। আসলে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ কম বেশি সব কেমিক্যাল রংই চোখের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

লাল রঙে থাকা মার্কারির যৌগ চোখে গেলে ফুলে উঠে জল পড়ে, ভয়ানক ব্যাথা করে। সবুজ রঙে থাকা কপার সালফেটের প্রভাবে চোখ ফুলে লাল হয়ে যায়, অনবরত চোখ করকর করে। অ্যালার্জির কারণে চোখে এমনই সমস্যা হয় যে চোখ খুলে রাখা দুষ্কর হয়ে যায়। উজ্জ্বল হলুদ রঙে থাকা লেড নার্ভ ড্যামেজ করে অন্ধত্ব ডেকে আনে। নীল রঙে আছে প্রুসিয়ান ব্লু, এটি চোখের পাতা সহ সমস্ত চোখ জুড়ে এমন ইরিটেশন সৃষ্টি করে যে চোখ খুলে তাকানোই যায় না। রুপোলি ও সোনালি রঙের উপাদান ক্যানসার পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। কর্নিয়া ও রেটিনা বাঁচাতে চোখে রং দেখুন, কিন্তু রং দেবেন না, মাখবেনও না।

আরও পড়ুন: জেনে নিন দোলের কোন রঙে মিশে থাকে কোন রাসায়নিক

প্রাথমিক চিকিৎসা পরিষ্কার জল দিয়ে চোখ ধোওয়া

অসাবধানতাবশত চোখে রং ঢুকে গেলে কলের জল দিয়ে ধুয়ে নিন। খুব জোরে ঝাপটা না দেওয়াই ভাল। বিশেষ করে বাচ্চাদের চোখের সমস্যা হলে বড়দের সামলে দেওয়া দরকার।

অনেক সময় আবির চোখের পাতার নীচে আটকে থাকে বলে জল দিয়ে বারে বারে ধুলেও কষ্ট ও ব্যথা কমে না। সাবধানে ওপর ও নীচের চোখের পাতা উল্টে নিয়ে জল দিয়ে ধুয়ে ফেললে সমস্যা কমবে। আবিরে চোখ ভীষণ ভাবে শুকিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে বারে বারে কৃত্রিম চোখের জল লাগানো প্রয়োজন। চোখে জল রং ঢুকে গেলেও বারে বারে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। একই সঙ্গে অ্যান্টি অ্যালার্জিক আই ড্রপ ও টিয়ার্স ড্রপ বারে বারে লাগানো দরকার। প্রযোজনে অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড আই ড্রপ কয়েক বার লাগানো দরকার। চোখের পাতার তলা ও কোণে নরম বাডস দিয়ে পরিষ্কার করা যেতে পারে। জল দিয়ে ধুয়ে এবং ড্রপ দিয়েও চোখের ব্যথা ও ফোলা না কমলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ব্যথা কমানোর জন্যে অ্যানেস্থেটিক ড্রপ ব্যবহার করে দু’বোতল স্যালাইন ওয়াটারের সাহায্যে চোখের মধ্যেকার রং বের করে দেওয়া হয়। সাময়িক ভাবে দৃষ্টিশক্তি চলে গেলে আতঙ্কিত না হয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে স্পেশালিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। কোনও ভাবে রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হলে রেটিনার সার্জারি করার প্রয়োজন হতে পারে।

সানগ্লাস আর চশমা দিয়ে আড়ালে রাখুন

অতি ব্যবহারে জীর্ণ কিন্তু অমোঘ সত্যি সেই কথাটাই মেনে চলুন – প্রিভেনশন ইজ গ্রেটার দ্যান কিওর। চোখ বাঁচাতে সানগ্লাস বা চশমা পরে দোল খেলতে বেরোনোই বুদ্ধিমানের কাজ। সাজুগুজু করুন কিন্তু লেন্স পরবেন না। লেন্সের পরিবর্তে চোখ ঢেকে রাখুন সুদৃশ সানগ্লাসে। অন্য রকম লুক পেলেন আর চোখও বাঁচল। আর রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ মানাও জরুরি। কৃত্রিম রাসায়ানিক রঙের পরিবর্তে ট্যাল্কম পাউডারে ফুলের পাপড়ি বা রান্নার হলুদ দিয়ে রং তৈরি করে দোল খেলুন। অরগ্যানিক খাবারের মত রংও হোক কেমিক্যাল বর্জিত প্রাকৃতিক। চোখও বাঁচল আর দোলের দিন রঙের ভয়ে লুকিয়ে বসে থাকতেও হল না।

পদ্মাবত নিয়ে হইচই যদিও অনেক কমে এসেছে, কিন্তু রবিঠাকুরের হোরিখেলা-র কথা মনে পড়ছে।

“পাঠানপতির ললাটে সহসা/ মারেন রানি কাঁসার থালাখানা।

রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে বেগে / পাঠানপতির চক্ষু হল কানা।।’’

রাজপুতানিরা না হয় যুদ্ধ করার জন্য পাঠান রাজার চোখ কানা করে দিয়েছিলেন, কিন্তু দোলের আনন্দ করতে গিয়ে কাছের মানুষদের “চক্ষু কানা” করা কি উচিত কাজ? আপনারাই বলুন!

সুতরাং হ্যাপি হোলি, ভাল থাকুক চোখ, ভাল থাকুন সবাই, দোল খেলুন পরমানন্দে।

Eye Care Tips Holi Colors
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy