E-Paper

জীবনের দ্বিপ্রহরে মেঘ জমেছে?

শরীর, মন-সহ নানা দিকে মধ্যবয়সে আরও অনেক পরিবর্তন আসে। এই ‘মিডলাইফ ক্রাইসিস’-কে হারিয়ে দেওয়ার উপায়ও আছে।

চিরশ্রী মজুমদার 

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২৫ ০৭:২২
বাস্তব জীবনে কিন্তু মিডলাইফ ক্রাইসিস মানে শুধুই অসমবয়সি প্রেম বা তৃতীয় ব্যক্তি নয়।

বাস্তব জীবনে কিন্তু মিডলাইফ ক্রাইসিস মানে শুধুই অসমবয়সি প্রেম বা তৃতীয় ব্যক্তি নয়। ছবি: জয়দীপ মন্ডল এবং দেবর্ষি সরকার।

আধুনিক সাহিত্য ও সিনেমা একটা দীর্ঘ সময় ধরে বুঝিয়েছে, চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা অনেক সময়েই এত দিনকার থিতু জীবনটাকে একঘেয়ে মনে করেন, আবার নবযৌবনের ফুরফুরে দিনগুলোয় ফিরে যাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ওঠেন। ফলে কেউ জিমে কসরত বাড়িয়ে দেন, চুল ও সাজে রঙিন হয়ে ওঠেন। সম্পর্কের বেড়াও ভেঙে বেরোতে চান, পরকীয়ায় বা কমবয়সি মানুষের প্রতি আগ্রহ দেখান। এটাই নাকি ‘মিডলাইফ ক্রাইসিস’। পঞ্চাশের দশকের তুমুল বিতর্কিত ‘লোলিটা’ থেকে নব্বই দশকের কেভিন স্পেসি অভিনীত ফেস্টিভ্যাল কাঁপানো ‘আমেরিকান বিউটি’— এমন কাহিনির প্রতি মানুষের গোপন আকর্ষণ প্রবল। ‘লাইফ ইন আ... মেট্রো’-য় মধ্যযৌবন বা প্রৌঢ়ত্বে সম্পর্কের জটিল আবর্ত দেখাতে গিয়ে এই সঙ্কটকে সংবেদনশীল ভাবে তুলে এনেছিলেন অনুরাগ বসু। তাঁর নতুন ছবি ‘মেট্রো... ইন দিনো’তেও মিডলাইফ ক্রাইসিস-এর প্রসঙ্গ ফিরে এসেছে। ওটিটি রাজত্বে তো ইদানীং ছকভাঙা প্রেমেরই রমরমা। কারণ সহজেই অনুমেয়।

তবে, বাস্তব জীবনে কিন্তু মিডলাইফ ক্রাইসিস মানে শুধুই অসমবয়সি প্রেম বা তৃতীয় ব্যক্তি নয়। এ নিতান্তই এক স্টিরিয়োটাইপ। গত দশকেই একটি সমীক্ষা দাবি করে, যে সম্পর্কে বিশ্বস্ত নয়, চিরকালই তার মধ্যে বন্ধন ভাঙার প্রবণতা থাকে। মিডলাইফ ক্রাইসিসের পরিধিটা আসলে অনেক বড়। এই শব্দবন্ধের প্রণেতা এলিয়ট জাক সেই ষাটের দশকেই বলেছিলেন, চল্লিশের কাছাকাছি মানুষের জীবনযাপনে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে, তার ফলে যে সাময়িক হতাশা, একাকিত্ব, অবসাদ ঘিরে ধরে, সেই আঁধারই মিডলাইফ ক্রাইসিস। কিংবদন্তি মনস্তাত্ত্বিক কার্ল ইয়ুং-এর ব্যাখ্যা, এ হল জীবনের বিকেলবেলা। হঠাৎ মেঘ জমে, তার গুমোট কাটিয়ে উঠতে জানতে হয়।

জীবনের ওঠাপড়া যেন...

মানুষের আয়ু ও যৌবনের সীমা বেড়েছে। তাই মধ্যবয়স মানেই দিনের আলো কমছে, শেষের রাতটি আসছে— এ ভাবনা পুরনো। এখন মনোবিদরা বলেন, বিকেল নয়, মাঝবয়স হল জীবনের পড়ন্ত দুপুর। এ সময়টা একটু একলা, অস্থির লাগে মানুষের। মনোসমাজবিদ মোহিত রণদীপ বললেন, “স্পষ্ট সীমারেখা নির্দেশ করা মুশকিল। তবে মোটামুটি ৪০-৬০ বছরের মধ্যবর্তীদের মাঝবয়সি বলা হয়। বয়ঃসন্ধি, কর্মক্ষেত্র বা দাম্পত্যজীবনে প্রবেশের পর জীবনে যেমন কিছু পরিবর্তন আসে, এ সময়ও কিছু অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হয়। যেমন আর্থিক ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা। কার্যক্ষমতা কমতে শুরু করছে, চাকুরিজীবীর অবসর জীবন, সেভিংস নিয়ে উৎকণ্ঠা জন্মায়। বাঁধাধরা উপার্জন না থাকলে আবার পরিশ্রম বাড়িয়ে অতিরিক্ত চাপ নিতে হয়। সন্তান বড় হয়ে যায়, তাদের নতুন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হয়। তারা নিজেদের দুনিয়ায় মশগুল হয়ে থাকে, বাইরে পড়তে চলে যায়।”

ছেলেমেয়ে না থাকলে আর এক রকমের সঙ্কটের বোধও জাগতে পারে। জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কও তো সব সময়ে এক তারে বাঁধা থাকে না। সেই সংক্রান্ত ওঠানামার প্রভাব মনে, পরিবারে পড়ে। সব মিলিয়ে একাকিত্বে ভোগার সম্ভাবনা বেশি। বড় সমস্যা, বয়োজ্যেষ্ঠদের অসুস্থতার বাড়বাড়ন্ত। জীবিকায় ব্যস্ত ছোট পরিবারগুলিতে তাঁদের যত্নের ভার নেওয়ার লোকের খুব অভাব। নার্সিংহোম ইত্যাদির দ্বারস্থ হতে হলে পরিস্থিতি গুরুতর হয়। নিয়মিত সেখানে যাওয়া-আসার চাপ, তায় চিকিৎসার খরচের চিন্তা। নিজের স্বাস্থ্যগত দুশ্চিন্তাও বাড়ে। এই সময়ে হরমোনের ওঠা-নামাও মনে প্রভাব ফেলে। মৃত্যুচিন্তারও উদয় হতে পারে। তবে এ সময়ের সবচেয়ে বড় ধাক্কা হয়তো গুরুজনকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট।

মিডলাইফ ক্রাইসিস মানে শুধুই অসমবয়সি প্রেম বা তৃতীয় ব্যক্তি নয়। যে সম্পর্কে বিশ্বস্ত নয়, চিরকালই তার বন্ধন ভাঙার প্রবণতা থাকে।

মিডলাইফ ক্রাইসিস মানে শুধুই অসমবয়সি প্রেম বা তৃতীয় ব্যক্তি নয়। যে সম্পর্কে বিশ্বস্ত নয়, চিরকালই তার বন্ধন ভাঙার প্রবণতা থাকে। ছবি: জয়দীপ মন্ডল এবং দেবর্ষি সরকার।

‘হ্যাপি ক্লাব’-এর সদস্যপদ

এই যে মনের অস্থিরতা, জীবন আর আগের মতো হেসেখেলে ছুটছে না, সেই বোধ বা বাড়তি দায়দায়িত্বের মধ্যে আটকে যাওয়ার অনুভূতি— এর থেকে অনেকের মনেই এক রকম বিষাদ ছায়া মেলে। এক এক জনের ক্ষেত্রে তার প্রভাব, প্রকাশ এক এক রকম। সকলেই যে অবসাদে ডুবে যাবেন বা জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেবেন, তা নয়। একঘেয়ে রুটিন থেকে জোর করে মুক্তি পেতে কেউ হঠাৎ কমবয়সিদের মতো আচরণ করতে থাকেন। বা নেশাসক্ত হয়ে বিপদ ডেকে আনেন। সুখের সন্ধানে পরিবারের গণ্ডির বাইরে পা বাড়ানোর দৃষ্টান্তও বিরল নয়। এ সবে কিন্তু আখেরে জীবনযন্ত্রণা আর বিড়ম্বনাই বাড়ে।

মনোবিদদের অভিজ্ঞতা, এই পরিস্থিতি সাময়িক। কিছু পন্থার মাধ্যমে বেশির ভাগ মানুষই এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসেন। প্রথমত, জীবনের এই মোড়ে এসে অনেক মানুষই খানিক থমকে দাঁড়ান। সুতরাং, জেনে রাখুন আপনি মোটেই একা নন। মোহিতের পরামর্শ, প্রত্যেকটা সমস্যা সামাল দিতে নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা ছকে রাখুন। ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে ও চিকিৎসা সংক্রান্ত উদ্বেগ কমাতে কোনও আর্থিক উপদেষ্টার সাহায্যে বিমা এবং সঞ্চয়নীতি ঢেলে সাজান। বাবা-মাকে দেখাশোনার প্রয়োজন বাড়লে, প্রথমেই তাঁদের কোন সাহায্যগুলো দরকার তার তালিকা করুন। দেখবেন ধীরে ধীরে এই নতুন ভূমিকাতেও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। বৃহত্তর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে ভাল। এ ক্ষেত্রে তাঁদের সাহায্য কিছুটা চাপমুক্ত করবে। সম্পর্কের নতুন সমীকরণগুলির সঙ্গেও মানিয়ে নিন, সন্তান যে এখন আর আপনাকে আঁকড়ে থাকতে চাইবে না, তা মেনে নিন। বরং ছুটিছাটায় একসঙ্গে বেড়াতে যান। ছেলেমেয়ে বন্ধু না হোক, ভরসার জায়গা হয়ে উঠবে, চলতি যুগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করবে আপনাকে। দাম্পত্য মসৃণ রাখবে একটু সিনেমা দেখা, সপ্তাহান্তের বিশেষ প্ল্যান।

নিজের যত্ন করুন। মেদাধিক্যের জন্য মন খারাপ না করে শারীরচর্চা করুন। মাঝবয়সে অনেকেই জীবনের অপূর্ণতা নিয়ে হা-হুতাশ করেন। যা পাননি তা নিয়ে অনুতাপের বদলে ভাবুন এমন কত কী করতে পেরেছেন যা কল্পনারও অতীত ছিল। অতএব, যা পেয়েছেন, তাকে মর্যাদা দিন। বরং কোনও সাধ-আহ্লাদ অপূর্ণ রয়ে গেলে, তা নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করা যায়। দুনিয়া জুড়ে মনোবিদরা একমত, এই মাঝদুপুরের হতাশার সেরা দাওয়াই নতুন শখপালন। বেকারি বা রান্না শেখা, নতুন ভাষা শেখা বা গানের ক্লাস, ফোটোগ্রাফি, বাগান করা, পোষ্যের যত্ন কিংবা সমাজসেবা— পছন্দসই বিষয়ে মনোনিবেশ করুন। এখান থেকেই বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা বাড়বে। সৃষ্টিশীল নেশা পেশার শ্রান্তি ভুলিয়ে দেয়,আর চরম শোকের ক্ষতেও অন্যমনস্কতার ব্যান্ডেজ বেঁধে জ্বালা কমাতে সাহায্য করে।

সময়ের চোরটাকে চেনেন?

নিজের যত্ন, শখ, বেড়াতে যাওয়া, দায়িত্বপালন— এই সব কিছুর জন্যই চাই একটু সময়। আর এখানেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় এ যুগের ‘মিডলাইফ ক্রাইসিস’-এর একটি বড় কারণ, কাজের চাপ, যা কেরিয়ার ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেয়। দাম্পত্যে, অভিভাবক-সন্তানের সম্পর্কে যথেষ্ট সময় দেওয়া যায় না। এই অতিব্যস্ততাই এ বয়সের নিঃসঙ্গতার অন্যতম কারণ।

অন্য দিকে, কেরিয়ার আর ব্যক্তিগত জীবনের মাঝখানে ঢুকে বসে আছে সমাজমাধ্যম। সময়টা আসলে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে সে-ই। ঘুম কাড়ছে, যা সুস্থ, নীরোগ, কর্মক্ষম ও প্রশান্ত থাকার অন্যতম শর্ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় যে সময় হারাচ্ছেন, তা দিয়ে নিজের জীবন ও সম্পর্কগুলোর যত্ন করা যায়। চ্যাটের বদলে দেখা করুন, আড্ডা দিতে যান বা কোথাও গিয়ে একসঙ্গে হইহল্লা করুন।

এই বৈচিত্রই সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার মশলা, ঘরের মধ্যেই সেই আয়োজন রাখলে ফোনের মাঝে বা ঘরের বাইরে, কোথাওই রং-যৌবন-জীবন খুঁজতে বা রুচি পাল্টাতে ছোটাছুটির সময় হবে না।


মডেল: রেশমি ঘোষ,সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়,সুস্মেলি দত্ত, জয়দীপ সিংহ

ছবি: জয়দীপ মন্ডল, দেবর্ষি সরকার

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Midlife Crisis Healthy Lifestyle Tips Healthy Lifestyle Relationship Tips Relationship Advice

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy