E-Paper

মা-সন্তানের সম্পর্কেও সীমারেখা জরুরি...

সেই সীমারেখা পার হলে সন্তানের বিবাহিত জীবনে অযথা নাক গলানোর প্রবণতা জন্ম নেয়। এই অনুপ্রবেশ দু’টি জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করে

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২৫ ০৭:২৫

সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ‘ইচ্ছে’ সিনেমার কথা মনে আছে? ছবিটির মূল চরিত্র মমতার গোটা জীবন আবর্তিত হয় তার ছেলে শমীককে ঘিরে। ছেলের প্রতি সদাসতর্ক মায়ের সেই স্নেহ-ভালবাসা কখন যেন পাল্টে যায় অধিকারবোধ এবং সীমাহীন নিয়ন্ত্রণকামী মানসিকতায়, তা হয়তো সে নিজেও বুঝতে পারে না। সেই মানসিকতা মুঠোবন্দি করে ফেলতে চায় তার বেড়ে ওঠার প্রত্যেক পদক্ষেপ। তার শ্যেনদৃষ্টিতে কিছুই আড়াল করা যায় না, প্রথম প্রেম, প্রথম বিচ্ছেদ— সমস্ত কিছুই নির্ধারিত হতে থাকে মায়ের ‘ইচ্ছে’য়।

এই একই মুদ্রার আর এক পিঠ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘সাত পাকে বাঁধা’। অর্চনা-সুখেন্দুর বিয়েতে প্রবল আপত্তি ছিল অর্চনার মায়ের। বিয়ের পরেও অর্চনার মা ‘মেয়ের ভাল’র নামে অনবরত তাদের সংসারে হস্তক্ষেপ করতে থাকে, সদ্য তৈরি হওয়া সম্পর্কগুলি বিষিয়ে তুলতে শুরু করে। পরিণতি, অর্চনা-সুখেন্দুর বিচ্ছেদ।

এ সব তো শুধু সিনেমা নয়। বাস্তবের ধুলোমাটি মাখা জীবনচিত্র। সেখানে মা-সন্তানের অঢেল স্নেহমাখা সম্পর্কের আড়ালে গভীর অন্ধকারও লুকিয়ে থাকতে পারে। কখনও কখনও সেই অন্ধকারই দাঁত-নখ বার করে প্রকাশ্যে চলে আসে, অতিরিক্ত অধিকারবোধ ছিন্নভিন্ন করে সন্তানের সদ্য বিবাহিত জীবনটিকে। মনস্তত্ত্ববিদ, ম্যারেজ কাউন্সিলররাও একবাক্যে স্বীকার করে নেন, বিবাহবিচ্ছেদের পিছনে অনেক সময়েই ছেলে বা মেয়েটির মায়ের অত্যধিক সক্রিয় ভূমিকাও নির্ণায়ক হয়ে ওঠে।

অযথা নিয়ন্ত্রণ কেন?

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং কাপল থেরাপিস্ট দেবলীনা ঘোষ বলছেন, “সন্তানের বিবাহিত জীবনে ক্রমাগত নাক গলাতে চাওয়ার প্রবণতার পিছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে মায়ের নিজের বিবাহিত জীবনের অতৃপ্তি। তাঁদের অল্প বয়সে, দাম্পত্য জীবনে তাঁরা হয়তো অনেক কিছুই করার সুযোগ পাননি। পরবর্তী জীবনে তাঁদের সামনে আর এক জন সেই সমস্ত না-পাওয়াগুলি অনায়াসে পেয়ে গেলে তাঁদের অবচেতনে এক ধরনের বিরূপতা জন্ম নেয়। বিশেষত ছেলের বউ বাড়ি এলে অনেক শাশুড়ির ভিতরে নিরাপত্তাবোধের অভাব দেখা দেয়। কখনও আবার অল্পবয়সি পুত্রবধূর সমস্ত রং-রূপ-গন্ধ সমন্বিত উপস্থিতি মধ্যবয়স অতিক্রান্ত, ঋতুবন্ধে প্রবেশ করা শাশুড়ির নারীসত্তাটিকে আহত করে। নিজেকে তাঁরা সংসারে অবাঞ্ছিত মনে করতে শুরু করেন, মনের গভীরে ঈর্ষার জন্ম হয়।” এই ঈর্ষা হয়তো নির্দিষ্ট কারও প্রতি নয়। তা পরিস্থিতির চাপে তৈরি, এই মেয়েটির পরিবর্তে অন্য কেউ এলেও হয়তো মায়ের প্রকাশটি একই রকম তীব্র হত।

মেয়ের মায়ের ক্ষেত্রে আবার ছবিটা অন্য রকম। তিনি যদি নিজের জীবন নিয়ে অতৃপ্তিতে ভোগেন, তা হলে তিনি চাইবেন মেয়ের জীবনে যেন সেই অপ্রাপ্তিগুলি ছায়া না ফেলে। মেয়ের এক পরিপূর্ণ, ‘সুখী’ জীবন দেখতে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ক্ষেত্রবিশেষে মায়ের মধ্যে এমন প্রবল হয়ে ওঠে যে, তিনি নিজেও বুঝতে পারেন না তাঁর আচরণে মেয়ের আদৌ কিছু ভাল হচ্ছে না। বরং ক্ষতিই হচ্ছে। অনেক সময়েই মায়ের অতিরিক্ত আগলে রাখার প্রবণতা ও পরামর্শ দেওয়ার জন্য মেয়েটির সংসারে সমস্যা দেখা দেয়।

সমাধান কোন পথে?

মায়েদের বুঝতে হবে ছেলে বা মেয়ে যখন বিয়ের বয়সে পৌঁছে যায়, তখন ‘ছাড়তে পারা’র মন্ত্রটি অভ্যাস করা খুব জরুরি। সম্ভব হলে তাদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া, যেখানে উভয়েই নিজেদের জীবন নিয়ে খুশি থাকতে পারবে। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে, দু’টি বাড়ির মধ্যে দূরত্ব যেন শেষ পর্যন্ত মানসিক দূরত্বে পরিণত না হয়। বাড়ি থেকে চলে যাওয়া মানেই ছেলে বা মেয়ে ‘পর’ হয়ে গেল, এই বস্তাপচা ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে।

দেবলীনা ঘোষের মতে, ছেলে বা মেয়েকে এক পৃথক সত্তা হিসেবে গড়ে তোলার অভ্যাসটি অনেক আগে থেকেই তৈরি করা প্রয়োজন। তাদের দশ-বারো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও বহু কাজ মায়েরা যেচে করে দেন। খাইয়ে দেওয়া, ব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া, বন্ধুর মাকে ফোন করে হোমওয়ার্ক চাওয়া— এ সব বন্ধ করতে হবে। এই অতিসক্রিয়তা দেখাতে গিয়ে অনেক সময়েই মায়েরা নিজেদের বৃত্তটা এমন ছোট করে ফেলেন, যাতে মনে হয় তিনি ও তার সন্তানের বাইরে এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। ফলে সন্তান একটু বড় হলে, তার নিজস্ব চিন্তাধারা, মত গড়ে উঠলে, মায়েরা ভাবতে থাকেন, তাঁদের এত দিনের ‘ইনভেস্টমেন্ট’ জলে গেল। মনে রাখা প্রয়োজন, সন্তান কখনও আপনার ‘ইনভেস্টমেন্ট’ নয়, যে ভাল রিটার্নের আশা করবেন। তাই একটু সময় কম ইনভেস্ট করুন, বরং নিজের জগৎ গড়ে তুলুন।

সন্তানকেও সতর্ক হতে হবে

একটা সময় পরে সন্তানকেও বুঝতে হবে, তার জীবনের লক্ষ্য শুধুমাত্র মাকে খুশি করা নয়। যাকে সে জীবনসঙ্গী বেছে নিচ্ছে, তার হাসি-কান্নার দিকে খেয়াল রাখাও তার দায়িত্ব। মায়ের প্রতি যত্নবান হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু সব কিছুরই স্বাস্থ্যকর মাত্রা আছে। সন্তানের প্রতি মায়ের অবসেশন যদি সেই মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তা হলে সতর্ক হতে হবে। শুধু সন্তানকে সারা জীবন আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ভাবনা। এই ভাবনা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানেরও বেরিয়ে আসা জরুরি। প্রয়োজনে মাকে অহেতুক হস্তক্ষেপ করা থেকে আটকাতে হবে। এক সময়ে মা-ও তাঁর গণ্ডিটা বুঝতে পারবেন, হয়তো তখন নিজের এক অন্য দুনিয়াও তৈরি করে নেবেন।

দেবলীনা ঘোষ জানালেন, তাঁর ক্লিনিকে আসা এক দম্পতির কথা, ছেলেটি বাঙালি, মেয়েটি অবাঙালি পরিবারের। ছেলেটির মা-বাবার সম্পর্ক মধুর নয়। মা ছেলেকে নিয়ে শহরের এক প্রান্তে থাকেন, বাবা অন্য প্রান্তে। মাঝেমধ্যে দেখা করতে আসেন। ছেলেটি এই সম্পর্কেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। অথচ, মেয়েটি তার পরিবারে একসঙ্গে থাকাতেই অভ্যস্ত। সেখানেও কর্তৃত্ব আছে, অশান্তি আছে, কিন্তু কেউ বিচ্ছিন্ন হয়নি। অথচ তাদের দাম্পত্যজীবনে সামান্যতম অশান্তি হলেই ছেলেটি মেয়েটিকে বলে, বাবার বাড়ি চলে যেতে। কারণ তার বদ্ধমূল ধারণা— আলাদা থাকাতেই শান্তি। ঠিক এইখানে সন্তানকেও বুঝতে হবে, তার পারিবারিক জীবনের ছায়া নিজের দাম্পত্য জীবনে যেন না পড়ে। সে যখন বিয়ে করার সিদ্ধান্তটি নিতে পেরেছে, তখন সমস্যা থেকে পালিয়ে যাওয়া নয়, বরং নিজের পরিণত যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে পরিস্থিতি সামলানোটাই সবচেয়ে বড় কাজ।

সব সম্পর্ক অবশ্যই এমন তিক্ত হয় না। বিয়ের পরে পুত্রবধূর হাত ধরে নতুন পৃথিবীকে চিনতে শেখা বা জামাইকে ছেলের জায়গায় বসানোর উদাহরণ এই সমাজেই অসংখ্য। অন্ধকার যেটুকু আছে, উভয়পক্ষ একটু চেষ্টা করলেই তা মুছে ফেলা সম্ভব।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Parenting

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy