E-Paper

লাম্প মানেই কিন্তু কর্কটরোগ নয়

শরীরের যে কোনও জায়গায় জন্ম নিতে পারে লাম্প। কিছু ক্ষেত্রে শরীরের বাইরে থেকে হাত দিয়েও অনুভব করা যায় গোলাকার মাংসপিণ্ড।

ঊর্মি নাথ 

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০২৫ ০৮:১৫

লাম্প বা টিউমার শব্দটি নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তার। অধিকাংশ মানুষই ধরে নেন অতিরিক্ত মাংসপিণ্ড মানেই শরীরে কোনও জটিল রোগের ইঙ্গিত। এই ধরনের গ্রোথ আক্রান্তকে শুধু শারীরিক ভাবে নয়, মানসিক ভাবেও দুর্বল করে দেয়। অথচ লাম্প বৃদ্ধির গতি রোধ করা যায়। প্রাথমিক ভাবে কিছু ওষুধ কার্যকর হলেও, কিছু ক্ষেত্রে কেবল ওষুধ প্রয়োগে তা নির্মূল করা সম্ভব নয়। তখন প্রয়োজন হয় শরীর থেকে অযাচিত এই মাংসপিণ্ড বাদ দেওয়া, যাকে বলে লাম্পেক্টমি। সুস্থ জীবন ফিরে পেলেও মাংসপিণ্ড ও লাম্পেক্টমি নিয়ে ভয় ভীতি পিছু ছাড়ে না।

লাম্প আসলে কী?

শরীরের যে কোনও জায়গায় জন্ম নিতে পারে লাম্প। কিছু ক্ষেত্রে শরীরের বাইরে থেকে হাত দিয়েও অনুভব করা যায় গোলাকার মাংসপিণ্ড। লাম্প সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর মণ্ডল বললেন, ‘‘শরীরে যখন কোনও কোষ অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন করে টিসু মাস তৈরি করে, তাকে বলে লাম্প বা টিউমার। এটা দু’ধরনের হয়। বিনাইন বা নন ক্যানসারাস আর ক্যানসারাস বা ম্যালিগন্যান্ট।’’ এই ব্যাপারে ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘চলতি ভাষায় লাম্প বলে, এর ডাক্তারি পরিভাষা টিউমার। লাম্প শব্দটা বেশি ব্যবহার করা হয় স্তনের ক্ষেত্রে। ব্রেনের ক্ষেত্রে যেমন টিউমার শব্দটির বেশি ব্যবহার হয়।’’ মস্তিষ্ক, স্তন, পেট বা শরীরের যে কোনও অঙ্গে টিউমার থেকে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কায় অনেকেই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। এই প্রসঙ্গে ডা. মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘মাংসপিণ্ড মানেই ক্যানসার, এটা ভুল ধারণা। বেশির ভাগ লাম্প বিনাইন। কিছু টিউমার ক্যানসারাস হতে পারে, তবে তা সংখ্যায় কম।’’

বোঝার উপায়

মাংসপিণ্ডের আকার দেখে তার কতটা বৃদ্ধি হয়েছে বোঝা যায়। এর বাইরে আরও লক্ষণ থাকে। এই প্রসঙ্গে ডা. মণ্ডল বললেন, ‘‘পেটের মধ্যে হলে জল জমতে পারে। স্তনে হলে দু’টি স্তনের মধ্যে আয়তন ও আকারের পরিবর্তন লক্ষ করা যাবে। মাথায় হলে প্রবল যন্ত্রণা হবে। বমি হবে। কিছু ক্ষেত্রে পার্সোনালিটি ডিজ়অর্ডার হয়ে যায়। রোগী এসে বলতে চান না তাঁর অসুবিধের কথা।’’ হাইপারটেনশন, অ্যাংজ়াইটি, মেনস্ট্রুয়েশন, মাইগ্রেন ইত্যাদি কারণে মাথায় প্রবল যন্ত্রণা হতে পারে। এই সব যন্ত্রণার সঙ্গে টিউমারের যন্ত্রণার পার্থক্য করা যায় কী করে? ‘‘সাধারণত মাইগ্রেন বা এই ধরনের ব্যথা মস্তিষ্কের যে কোনও একটা দিকে হয়। টিউমার হলে মাথার নির্দিষ্ট একটা জায়গায় ব্যথা হবে। রোগী পিন পয়েন্ট করে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারবেন যন্ত্রণার জায়গাটি,’’ বললেন ডা. মণ্ডল।

লাম্পেক্টমি

শরীর থেকে মাংসপিণ্ড বাদ দেওয়ার পদ্ধতিকেই বলে লাম্পেক্টমি । লাম্প হলেই যে লাম্পেক্টমি করাতে হবে এমন নয়, পরিস্থিতি বুঝে সার্জারির কথা বলেন চিকিৎসকেরা। লাম্পের প্রকৃতি জানতে লাম্পেক্টমির আগে এফএনএসি বা স্মল বায়পসি বা পাঞ্চ বায়পসি করে নেওয়া হয়। ‘‘লাম্পেক্টমি করে পুরো মাংসপিণ্ডটা বাদ দেওয়া হয়। তার পরে সেই লাম্পকে ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। ফলাফলে যদি ম্যালিগনেন্সি আসে, তা হলে সেই সার্জারি এক্সটেন্ড করা হয়। অর্থাৎ ওই জায়গার কোষ যত দূর ছড়াতে পারে, তার যে প্রবণতা, সেই অঞ্চল থেকে কোষগুলোকে কেটে বাদ দেওয়া হয়। একে বলে র‌্যাডিক্যাল লাম্পেক্টমি। একমাত্র ব্রেনে এই অপারেশন করা যায় না,’’ বললেন ডা. মণ্ডল। লাম্পেক্টমি করে মাংসপিণ্ড বাদ দেওয়ার পরেও পুনরায় লাম্প হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে একটা চিন্তা থেকে যায় রোগীর মনে। এ ব্যাপারে ডা. মণ্ডল বললেন, ‘‘লাম্প যদি বিনাইন হয় তবে লাম্পেক্টমি করলে আবার লাম্প হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে তার থেকে ভবিষ্যতে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই নগণ্য।’’

স্তনে লাম্পেক্টমি

স্তনে লাম্প হয়েছে কি না তা বোঝার সহজ রাস্তা সেল্ফ এগজ়ামিন। স্তনে হাত দিয়ে চাপ দিলে গোলাকার মাংসপিণ্ড অনুভব করলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যাওয়াই ভাল। চিকিৎসকেরা প্রথমে ক্লিনিক্যালি পরীক্ষা করে দেখেন, তার পরে পরিস্থিতি অনুযায়ী নানা ধরনের পরীক্ষা করতে দেন। ‘‘অনেক সময়ে স্তনে লাম্প বলে যেটা মনে করা হয়, সব সময়ে তা না-ও হতে পারে। ফাইব্রোসিস্টিক ডিজ়িজ়ও হতে পারে। অর্থাৎ সিস্ট হয়, যা মাংসপিণ্ডের মতো দেখতে। তাই প্রথমে ক্লিনিক্যালি পরীক্ষা করা হয়। যদি মাংসপিণ্ড মনে হয়, তা হলে আলট্রাসোনোগ্রাফি বা ম্যামোগ্রাফি করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সাধারণত ৪৫ বছরের উপরে বয়স হলে ম্যামোগ্রাফি আর এর চেয়ে কম বয়স হলে আলট্রাসোনোগ্রাফি। লাম্প দেখে চিকিৎসকের সন্দেহ হলে বায়পসির কথা বলেন। এফএনএসি না ট্রু-কাট বায়পসি হবে সেটা নির্ভর করে মাংসপিণ্ডের গঠন, শারীরিক লক্ষণের উপরে,’’ বললেন ডা. গৌতম মুখোপাধ্যায়।

কমবয়সি মহিলারা অনেকেই স্তনে মাংসপিণ্ড হলে সার্জারি করাতে ভয় পান। বিশেষত অবিবাহিত, কমবয়সিরা স্তনে কাটাছেঁড়া করাতে চান না। ধারণা, এর জন্য বিয়ের পরে দাম্পত্য জীবনে অসুবিধে হতে পারে বা মা হওয়ার পরে সন্তানের স্তন্যপানে সমস্যা হতে পারে। ‘‘লাম্প বিনাইন হোক বা ম্যালিগন্যান্ট, আকারে বড় হলেই বাদ দেওয়া উচিত। বিশেষত লাম্প দু’-তিন সেন্টিমিটার হলে। কারণ টিউমার শরীরে থাকলে অস্বস্তি হয়। লাম্পেক্টমি করলে বিয়ের পরে দাম্পত্য জীবনে অসুবিধে হয় না, সন্তানের স্তন্যপানেও সমস্যা হয় না। তবে প্রসঙ্গটা অল্পবয়সি বা বেশি বয়সিদের নয়। কাটা দাগ যাতে না থাকে বা যতটা ন্যূনতম করা যায় তার চেষ্টা যে কোনও রোগীর ক্ষেত্রেই করা হয়। এর জন্য ব্রেস্টের নিপলের পাশে অ্যারিওলার অংশে বা স্তনের নীচে কাটা হয় বা ইনসিশন দেওয়া হয় যাতে দাগ বোঝা না যায়। মানসিক চাপ কমানোর জন্য সব সময়ে সৌন্দর্যের দিকটা মাথায় রেখে সার্জারি করার চেষ্টা করি,’’ বলে জানালেন ডা. মুখোপাধ্যায়।

লাম্প বা লাম্পেক্টমি নিয়ে অহেতুক ভয় পাবেন না। শরীরে কোথাও অযাচিত মাংসপিণ্ডের অনুভূতি হলে বা কোনও লক্ষণ প্রকাশ পেলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Tumour Cancer

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy