E-Paper

বাঁধিব যতনে

হিন্দু-পঞ্জিকা অনুসারে, শ্রাবণী-পূর্ণিমা তিথিতে রাখিবন্ধন-উৎসব পালিত হয়। এর নেপথ্যে পুরাণ, ইতিহাসের নানা ব্যাখ্যা রয়েছে।

পুরীপ্রিয়া কুণ্ডু

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৫ ০৬:৩৪
অলঙ্করণ: রৌদ্র মিত্র।

অলঙ্করণ: রৌদ্র মিত্র।

রাখি এখন শুধু বন্ধনের আবেগ নয়, নব্য প্রজন্মের কাছে তা এখন একটা উৎসবও। বাড়িতে দাদা, ভাইদের হাতে যেমন রাখি পরানোর চল রয়েছে। স্কুল-কলেজে শিক্ষক-শিক্ষিকা, বন্ধুবান্ধবের হাতেও রাখি পরাতে দেখা যায়। রাখিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাখিবন্ধনের আয়োজনও করা হয়। যুগের সঙ্গে এই উৎসবের পরিধি ক্রমশ বেড়েছে। বিভিন্ন সংস্থা রাখিকে কেন্দ্র করে তাদের পণ্য বিপণনের চেষ্টা করে। বাজারের জাঁকজমকের ভিড়ে ভুলে গেলে চলবে না রাখির উৎসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারতীয় ইতিহাস, পুরাণ, লোককথা...

লোকশ্রুতি অনুযায়ী, মহাভারতে বর্ণিত আছে, শিশুপাল-বধের পর সুদর্শন-চক্রের আঘাতে শ্রীকৃষ্ণের তর্জনী থেকে রক্তপাত শুরু হলে দ্রৌপদী তাঁর শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন। কৃষ্ণ অভিভূত হয়ে যান। দ্রৌপদী তাঁর অনাত্মীয়া হলেও, তিনি দ্রৌপদীকে নিজের বোন হিসেবে গ্রহণ করেন ও তাঁকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন কৃষ্ণ। বহু বছর পরে, পাশাখেলায় কৌরবরা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে গেলে তাঁর সম্মান রক্ষা করে কৃষ্ণ সেই রক্ষাবন্ধনের প্রতিদান দেন। এ ভাবেই রাখিবন্ধনের প্রচলন হয় বলে মনে করা হয়। রাখি হল ভাই বা দাদার প্রতি দিদি-বোনের ভালবাসা ও মঙ্গলকামনা এবং দিদি বা বোনকে আজীবন রক্ষার জন্য ভাই বা দাদার শপথের প্রতীক। সে জন্যই বাংলার রাখিবন্ধনকে সংস্কৃতে রক্ষাবন্ধনম্ বলা হয়। হিন্দু-পঞ্জিকা অনুসারে, শ্রাবণী-পূর্ণিমা তিথিতে এই রাখিবন্ধন-উৎসব পালিত হয়ে আসছে। সে জন্যই এটি রাখি-পূর্ণিমা তিথি নামে পরিচিত।

পৌরাণিক সূত্র

রাখি নিয়ে পৌরাণিক গল্পগাথা এখানেই শেষ নয়। পৌরাণিক লোককথা অনুযায়ী, দৈত্যরাজ বলি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। অত্যন্ত দয়ালু ও সাহসী রাজা মহাবলি দেবতাদেরও পরাস্ত করেছিলেন। দেবতাদের অনুরোধে মহাবলিকে পর্যুদস্ত করতে বিষ্ণু বামন রূপ ধারণ করে বলিরাজের কাছে এসে ত্রিপাদভূমি প্রার্থনা করেন। বলি সম্মত হলে বামন বিশাল রূপ ধারণ করেন। দু’বার পা ফেলেই তিনি গোটা স্বর্গ ও মর্ত্য অধিকার করে নেন। তৃতীয় পা ফেলার জন্য বলি নিজের মাথা এগিয়ে দেন। এতে অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে বিষ্ণু তাঁকে আশীর্বাদ করেন যে, তিনি বলিরাজের গৃহেই অবস্থান করবেন। বৈকুণ্ঠ ছেড়ে বিষ্ণু চলে এলে, স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য লক্ষ্মী এক সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলিরাজের কাছে এসে হাজির হন। বলিকে বলেন, তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ। যত দিন না স্বামী ফিরে আসেন, তত দিন যেন বলি তাঁকে আশ্রয় দেন। বলিরাজ রাজি হন। শ্রাবণী-পূর্ণিমা উৎসবে বলিরাজের হাতে একটি রাখি বেঁধে দেন লক্ষ্মী। বলিরাজ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে লক্ষ্মী আত্মপরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলেন। এতে বলিরাজ মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন।তখন বিষ্ণু প্রতিজ্ঞা করেন যে, প্রতি বছর রাখির দিনে অর্থাৎ ওনামে তিনি বলির রাজ্যে ফিরে আসবেন। এই কারণে গোটা বছরে শুধু রাখির দিনই দরজা খোলে উত্তরাখণ্ডের বংশী নারায়ণ মন্দিরের। দশ দিন ধরে চলা ওনামের দ্বিতীয় দিনে বিষ্ণু রাজ্যবাসীর ঘরে ঘরে যান বলে প্রচলিত বিশ্বাস।

আবার ভাগবত-মহাপুরাণের দশম স্কন্ধ অনুযায়ী, শ্রাবণী-পূর্ণিমা তিথি হল বলরামের জন্মতিথি। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি ভাই ও প্রাণসখার প্রতি সৌভ্রাতৃত্ব, ভালবাসা জানানোর দিন। পুরাণ মতে, অত্যাচারী কংসের হাত থেকে বাঁচাতে দেবকীর সপ্তম-গর্ভকে প্রতিস্থাপিত করা হয় বসুদেবের অপর ঘরনি রোহিণীর উদরে। প্রতিনিযুক্ত-মায়ের দায়িত্ব পালন করেন রোহিণী। শ্রাবণী-পূর্ণিমায় ধরাধামে অবতীর্ণ হন জগন্নাথ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও বিশ্বসংসারের সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীকস্বরূপ শ্রীবলভদ্রদেব।

ঐতিহাসিক সূত্র

মহাকাব্য বা পুরাণকথা ছাড়াও ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলেও রাখিবন্ধনের দু’-একটি ঘটনা নজরে আসে। কিংবদন্তি অনুযায়ী, ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজ়ান্ডার ভারত আক্রমণ করলে তাঁর স্ত্রী রোজানা একটি পবিত্র সুতো রাজা পুরুকে পাঠিয়ে অনুরোধ করেন আলেকজ়ান্ডারের যেন কোনও ক্ষতি না হয়। পুরু ছিলেন ধর্মনিষ্ঠ রাজা। রাখির সম্মানার্থে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নিজে আলেকজ়ান্ডারকে আঘাত করেননি।

আবার একটি লোকগাথা থেকে পাওয়া যায়, ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে চিতোরের বিধবা রানি কর্ণবতী অসহায় বোধ করেন এবং তিনি মোগলসম্রাট হুমায়ুনকে রাখি পাঠিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। কর্ণবতীর পাঠানো রাখি পেয়ে অভিভূত হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করার জন্য সেনা পাঠান। তবে হুমায়ুনের সেনা পাঠাতে দেরি হওয়ায় বাহাদুর শাহ রানির দুর্গ জয় করে নিয়েছিলেন। শোনা যায়, বাহাদুর শাহের সেনাবাহিনীর হাত থেকে সম্ভ্রম রক্ষার জন্য রানি কর্ণবতী ১৩,০০০ পুরস্ত্রীকে নিয়ে জহর ব্রত পালন করেন। চিতোরে পৌঁছে বাহাদুর শাহকে দুর্গ থেকে উৎখাত করে কর্ণবতীর ছেলে বিক্রমজিৎ সিংহকে সিংহাসনে বসান হুমায়ুন। সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে রাখি প্রেরণের কথা অবশ্য জানা যায় না। তবে মধ্য-সপ্তদশ শতকের রাজস্থানি লোকগাথায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়।

ইতিহাস-পুরাণের পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিসরেও রাখির গুরুত্ব রয়েছে। বঙ্গভঙ্গের সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলমান ভাইবোনের মধ্যে যে রাখিবন্ধন উৎসব শুরু করেন, সেই প্রেক্ষিত আজও বহাল। কবিগুরুর আহ্বানে সে দিন পরস্পরের হাতে বাঁধা হয়েছিল হলুদ-সুতোর রাখি। আসলে এই হলুদ রং সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক। এই রাখিবন্ধনের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ঊনিশ শতকে বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরম পর্যায়ে ছিল। এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য বাংলাকে দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। ১৯০৫-এর অগস্ট মাসে বঙ্গভঙ্গের জন্য আইন পাশ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরহিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলার জন্য রাখিবন্ধন উৎসবের আহ্বান করেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের পুণ্যতীর্থ এই ভারতভূমি। ‘ভা’ শব্দের অর্থ জ্ঞানের আলো, ‘রত’ শব্দের অর্থ ব্যাপৃত আর ‘বর্ষ’ শব্দের অর্থ পুরাণোক্ত ভূভাগ। আত্মতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্বের অনুসন্ধানে ব্রতী ঋত্বিকগণের বিচরণভূমিই আমাদের দেশ ভারতবর্ষ। উক্ত দিবসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে স্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৬৯ সালে শ্রাবণী-পূর্ণিমা তিথিকে বিশ্ব সংস্কৃত-দিবস ঘোষণা করে। ফলে রাখি বন্ধন দিবসের সঙ্গে সংস্কৃত দিবসের যোগসূত্রও সুদৃঢ়। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য ঋগ্বৈদিক সাম্যের বাণী, ‘সং গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং/ সং বো মনাংসি জানতাম্।।’ অর্থাৎ প্রত্যেক ভারতবাসীই পরস্পরের প্রতি সৌভ্রাতৃত্বের সুনিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ থাকবেন, এটিই ‘সংস্কৃত-দিবস’ পালনের মর্মকথা।

রাখিবন্ধনের নিয়ম

এখন শুধু একটা সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই উৎসব সীমিত নেই, মুসলিম, জৈন, বৌদ্ধ, শিখ সকল সম্প্রদায়ের মানুষ এই উৎসবে শামিল হন। উত্তর ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে সহোদর ভাইবোন ছাড়াও জ্ঞাতি ভাইবোন, এমনকি আত্মীয়দের মধ্যেও রাখিবন্ধন উৎসব প্রচলিত। রাখির সুতো ও তাতে ব্যবহৃত উপকরণেরও ব্যাখ্যা রয়েছে।

রাখি তৈরিতে ব্যবহৃত উপকরণগুলি এক একটি কামনার প্রতীক বলে মনে করা হয়। এই কামনা পূরণের উদ্দেশ্যেই রাখি বাঁধা হয়। রাখিতে ব্যবহৃত দূর্বা হল বংশবৃদ্ধির প্রতীক। আবার দূর্বা গণেশের প্রিয় হওয়ায় একে বিঘ্নহর্তাও বলে। অক্ষত অর্থাৎ অখণ্ড চাল হল শ্রদ্ধা ও ভালবাসার প্রতীক। আবার অক্ষত চালের মাধ্যমে দীর্ঘায়ু ও সুস্থ জীবনের কামনাও করা হয়। জাফরান ভাইকে তেজস্বী করে তোলে, চন্দন শীতলতা প্রদান করে। সরষে ভাইকে নির্দুষ্ট করে। শাস্ত্রবিহিত রক্ষাসূত্রে উক্ত পাঁচটি উপকরণ ছাড়াও কাঁচা সুতো ও হলুদ, গোমতী চক্র, কড়ি একটি হলুদ রেশম কাপড়ে সেলাই করে রাখি তৈরি করা হয়। সেলাইয়ের পর মৌলীসুতোয় গেঁথে নেওয়া হয়।

এই রক্ষাসূত্রের আরও ব্যাখ্যা রয়েছে। পুরোহিত দ্বারা রাজার, ব্রাহ্মণ দ্বারা যজমানের, দিদি বা বোন দ্বারা ভাই বা দাদার, মা দ্বারা সন্তানের এবং স্ত্রী দ্বারা স্বামীর ডান হাতেও বাঁধা যেতে পারে। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে রাখিবন্ধনের মাধ্যমে দুটো মানুষের মধ্যে অটুট সম্পর্ক স্থাপন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

rakhi purnima Rakhi

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy