Advertisement
E-Paper

নিজের শরীরকেও নিয়মিত ‘সার্ভিসিং’ করানো প্রয়োজন

সুস্থ থাকতে এমনই জানাচ্ছেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদারসুস্থ থাকতে এমনই জানাচ্ছেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ ১১:৪১
যত দিন যাচ্ছে, বিজ্ঞান তত এগোচ্ছে প্রাইমারি প্রিভেনশনের দিকে।

যত দিন যাচ্ছে, বিজ্ঞান তত এগোচ্ছে প্রাইমারি প্রিভেনশনের দিকে।

স্বাস্থ্য কী? আমরা চিকিৎসকেরা বুঝি শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা নিয়েই হয় কোনও মানুষের সার্বিক স্বাস্থ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞাতে কিন্তু এমনটাই রয়েছে।

এক জন চিকিৎসকের দৃষ্টিতে বললে, তিন ভাবে শরীরকে সুস্থ রাখা যেতে পারে। এক, প্রতিষেধক দিয়ে শরীরে রোগের বাসা বাঁধতে না দেওয়া। একে বলে প্রাইমারি প্রিভেনশন। দুই, শরীরে যে রোগ বাসা বেঁধে ফেলেছে, সে যাতে আরও ক্ষতি করতে না পারে, তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। একে বলে সেকেন্ডারি প্রিভেনশন। তিন, কোনও রোগে আক্রান্ত হওয়ায় রোগীর শরীরে বড় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। সেই ক্ষতিকে মানিয়ে নিয়ে প্রয়োজনে তাঁকে হুইলচেয়ার, নকল অঙ্গ, বিভিন্ন থেরাপি প্রভৃতি দিয়ে বাঁচতে সাহায্য করা। একে বলে টার্শিয়ারি প্রিভেনশন।

যত দিন যাচ্ছে, বিজ্ঞান তত এগোচ্ছে প্রাইমারি প্রিভেনশনের দিকে। এখন রোগ না হতে দেওয়ার সেই চিন্তাভাবনা শুরু হয় জন্মের আগে থেকেই। কোনও দম্পতি যখন সন্তান আনার পরিকল্পনা করেন, থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া, সিকল সেলের মতো বেশ কিছু রোগের প্রভাব সন্তানের শরীরে পড়তে পারে কি না, তখন তা জানতে জেনেটিক কাউন্সেলিং করা হয়। সেই বুঝে সন্তান আনার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন বহু দম্পতি। পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারা যায়, গর্ভস্থ শিশু কোনও জটিল রোগ নিয়ে জন্মাচ্ছে কি না। সেই বুঝে তার প্রতিকার করা হয়। জন্মের পর থেকেই শুরু হয়ে যায় সন্তানকে সুস্থ রাখার দ্বিতীয় পর্ব। জন্ম মুহূর্ত থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত পোলিয়ো, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, টিটেনাস, হেপাটাইটিস-বি, যক্ষ্মা, হাম, মাম্পস, রুবেলার প্রতিষেধক সন্তানকে ঠিক মতো দিলে ভবিষ্যতে অনেক রোগের আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব।

স্বাদ রেখে সাবধান হোন

পরিবারে উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবিটিসের ধাত রয়েছে কিংবা আপনি নিজেও ভুগছেন। চিন্তা নেই, আপনার জীবন বিস্বাদ হয়ে যায়নি। নিয়ম মানার ফাঁকেও কিছু মনের
মতো খাবার খেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে খাবার আপনাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেতে হবে
• উচ্চ রক্তচাপের রোগীর পাতে কাঁচা নুন একদম নয়।
• মাছ-মাংস-ডিম একসঙ্গে খাবেন না। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খান। এক বেলা পরিমিত মাছ খেলেন, তো অন্য বেলা মেপে মাংস খান।
• আনাজ খাবেন সব রকম।
• সপ্তাহে এক দিন ভাজা খেতেই পারেন। তবে প্রচুর পরিমাণে নয়।
• বিভিন্ন ফল খান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, ়ডায়াবিটিসের রোগী হলে আম, কাঁঠাল ও কলার মতো মিষ্টি ফল খাবেন না।
• ডায়াবিটিসের রোগীও হাল্কা মিষ্টি খেতে পারেন।
• যে দিন মিষ্টি খেলেন, সে দিন ভাত খান নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্ধেক। এ ভাবে খাবারে ভারসাম্য আনুন।
• মাংসের সঙ্গে ভাত একটু বেশি খাওয়া হল, অন্য বেলায় ভাত বর্জন করুন।
• লোভে পড়ে মাংসে আলু খেয়েছেন। শসা, পেয়ারা খেয়ে নিন।
• লুচি খেলে পরের বেলায় ভাত খাবেন না। বরং ফল, টক দই দিয়ে পেট ভরান।
• সাদা তেল, সরষের তেল, বাদাম তেল, অলিভ তেল মিশিয়ে রান্না করুন। দোকানেও মিশ্র তেল কিনতে পাওয়া যাচ্ছে।

ভাজাভুজি বা ফাস্টফুড খাইয়ে সন্তানকে স্থূল করবেন না। যে কোনও বয়সেই স্থূলতা বড় অসুখ ডেকে আনবে। বয়ঃসন্ধির সময়ে ওদেরকে বিশেষ নজরে রাখুন, নেশার দ্রব্যে যেন আকৃষ্ট না হয়ে পড়ে ওরা। নিয়মিত নেশা করলে স্নায়ুরোগ হতে পারে, মস্তিষ্ক শুকিয়ে যায়। খেলাধুলো, শারীরচর্চায় সন্তানকে উৎসাহিত করুন।

আরও পড়ুন: ভারতবর্ষের ভরসায় এই বেশ আছি

শুধু বৃদ্ধির বয়সেই নয়, ব্যধিগ্রস্ত মানুষেরও নিয়মিত শারীরচর্চা করা উচিত। লাঠি ধরে হলেও ধীরে ধীরে হাঁটুন। অস্টিয়োপোরোসিস, আর্থাইটিসের রোগী তো বটেই এমনকি স্ট্রোক বা ক্যানসারের মতো অসুখেও রোগীকে শুয়ে-বসে হাল্কা শারীরচর্চা করার কথা বলে থাকি আমরা। কারণ, তাতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ নাড়াচাড়া করায় রক্ত সংবহন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হয়। ফলে শরীরের খাঁজে যে টক্সিন জমা হয় তা-ও সরানো যায়।

খেয়াল রাখবেন, প্রতিদিনের খাবারটা যেন স্বাস্থ্যকর হয়। দেখা গিয়েছে, ভারতীয়দের মধ্যে অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট নেওয়ার অভ্যাস রয়েছে। কিন্তু একশো ক্যালরি খাবারের মধ্যে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কোনও ভাবেই ৪০ শতাংশের উপরে হওয়া উচিত নয়। ফ্যাট এবং প্রোটিন ৩০ শতাংশ করে থাকতে হবে। দুধ বা দুধ জাতীয় জিনিস রোজ খান। প্রোটিনের জন্য বিভিন্ন ডাল, মাছ, মাংস, ডিম খান। টাটকা শাক-আনাজ, ফল খাদ্য তালিকায় রাখা জরুরি। কিনে আনা ফলের রসে নয়, আসল উপকারিতা গোটা ফলে। একটা করেই খান, তবু রোজ ফল খান। মরসুমি ফল হলে আরও ভাল। এক জন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে দিনে তিন-চার লিটার জল পান করতে হবে। কারণ জলের মাধ্যমেই বর্জ্য বেরিয়ে যাবে।

ষাট বছর পেরিয়ে গেলেই নিউমোনিয়া এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধক নেওয়া উচিত।

পড়াশোনা ও কাজের জগতে জমি পাকা করার তীব্র প্রতিযোগিতা গ্রাস করছে অবসর মুহূর্ত। এই ‘স্ট্রেস’কে কাবু করতে হবে। এ জন্য কয়েকটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে। এক, ন্যূনতম পাঁচ ঘণ্টা একটানা ঘুমোন। দুই, বন্ধু-পরিবার-আত্মীয়ের সঙ্গে যথেষ্ট সময় কাটান। এমনকি পরিবারের ছোটদেরকেও সেই পাঠ দিন। তিন, দেওয়ালের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে ধীরে ধীরে চিন্তামুক্ত হন, প্রাণায়াম এবং ধ্যান করুন। কাজ বা পড়াশোনার ফাঁকে সুযোগ থাকলে সাঁতার কাটুন, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল, ক্রিকেট, দাবা প্রভৃতির মতো খেলায় ডুবে যান। চার, স্বাস্থ্যকর খাদ্য চিন্তামুক্তির বড় টোটকা।

এখনকার জীবনযাত্রা অনেক বেশি খোলামেলা এবং পাশ্চাত্য ঘেঁষা। তাই সুস্থ জীবনযাপনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, নিরাপদ যৌন সম্পর্ক। এ বিষয়ে সচেতন থাকলে এইচআইভি, সিফিলিস, গনোরিয়ার মতো অনেক রোগের থেকে বাঁচা সম্ভব।

আরও পড়ুন: জীবনযাপনে অনিয়মই ডাকছে ডায়াবিটিস

শরীরে কোনও বড় অসুখ বাসা বাঁধল কি না, তা জানতে একটা বয়সের পর থেকে নিজেই সচেতন হন। মহিলাদের মেনোপজ হওয়ার আগে অর্থাৎ পঁয়তাল্লিশ পেরোলেই সতর্ক হতে হবে। পাঁচ বছর অন্তর ব্রেস্ট এবং সার্ভাইক্যাল ক্যানসার স্ক্রিনিং করাতে হবে। পঞ্চাশের পর থেকে সেটা প্রতি বছর করালে ভাল হয়। পুরুষের ক্ষেত্রে প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি শুরু হয় ষাটের পর থেকে। তাই নির্দিষ্ট সময় অন্তর কিছু রক্ত পরীক্ষা, আল্ট্রাসোনোগ্রাফি এবং শারীরিক পরীক্ষা করে দেখে নিতে হবে। আমরা গাড়ি, বাইক, এসি এমনকি জলপরিশোধন যন্ত্রেরও নির্দিষ্ট সময় অন্তর স্বাস্থ্য-পরীক্ষা করাই। সমস্যা হল, নিজেদের স্বাস্থ্য-পরীক্ষা করাতেই ভুল হয়ে যায়। চল্লিশ পেরোতেই মহিলা ও পুরুষ উভয়েই বছরে এক বার স্বাস্থ্য-পরীক্ষা করান। সেই তালিকায় রাখুন ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, লিপিড প্রোফাইল, লিভার ফাংশন টেস্ট এবং ইসিজি। পাশাপাশি কিডনি এবং চোখের পরীক্ষাও করিয়ে নিন।

চল্লিশ বছরের পর থেকে আরও একটি পরীক্ষা নির্দিষ্ট সময় অন্তর শুরু করা উচিত, বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে। তা হল ভিটামিন-ডি পরীক্ষা। ষাট বছর পেরিয়ে গেলেই নিউমোনিয়া এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধক নেওয়া উচিত।

বয়স্কদের ক্ষেত্রে কী কী শারীরিক পরিবর্তন দেখলে সজাগ হবেন সেটা জেনে রাখা জরুরি। আপনা আপনি ওজন বেশি বা কম হলে জানবেন বিপদ লুকিয়ে। ওজন বেড়ে গেলে ডায়াবিটিস বা ফ্যাটি লিভার হতে পারে। চোখে লাগার মতো ওজন কমলে ক্যানসার বা অন্য কোনও সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। হাঁটাচলা বা সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার সময়ে শ্বাসকষ্ট এবং বিছানায় শুতে গেলেই শুকনো কাশি হৃদ্‌রোগের লক্ষণ হতে পারে। বারবার পড়ে গেলে বা চলাফেরায় স্থবিরতা যে কোনও স্নায়ুরোগের কারণ হতে পারে। ভুলে যাওয়ার সমস্যা ডিমেনশিয়ার একটা কারণ, প্রাথমিক অবস্থাতেই এর চিকিৎসা শুরু করা উচিত। জোরে জোরে নাক ডাকা মানে সেটা ঠাট্টার বিষয় নয়। জেনে রাখবেন আপনি যখন ঘুমোচ্ছেন, মস্তিষ্কে কম অক্সিজেন যাচ্ছে। ফলে টানা ঘুমিয়েও পরের দিন ক্লান্তি কাটবে না। কাজের দক্ষতা কমে যাবে।

সময় থাকতেই গোড়ায় রোগের চিকিৎসা শুরু হলে বড় বিপদের থেকে রক্ষা পেতে পারেন। তাই গাড়ির মতো নিজের শরীরকেও নিয়মিত ‘সার্ভিসিং’ করান।

Heatth Health Tips Fitness Tips
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy