E-Paper

‘জলের দরে’ নয়

বিশ্বজুড়ে রয়েছে বহুমূল্য হরেক জল। দাম তাদের লাখ টাকা ছাড়িয়ে। কিন্তু কী তাদের উপকারিতা? কোথা থেকে সংগৃহীত হয় সেই জল?

পারমিতা সাহা

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:৩০
An image of water

—প্রতীকী চিত্র।

কলকাতা হোক বা শহরতলিতে ফি-দিন কত গ্যালন জল যে অপচয় হয়, তার হিসেব কে রাখে! প্রবাদেই আছে ‘জলের দরে’, তার মান রাখতে হবে তো! বিদেশ বিভুঁইয়ে গেলে অবশ্য জলের দর বোঝা যায়। সে যাক গে, আমরা এ রাজ্যে সাধারণত পুরসভা থেকে পাঠানো ট্যাপ কলের জল পিউরিফায়ার বা ফিল্টারের মাধ্যমে পরিস্রুত করে খেয়ে থাকি। কিন্তু জলেরও আছে অনেক ভাগ। সমাজমাধ্যমের দৌলতে অনেকেরই জানা বিরাট কোহলি অ্যালক্যালাইন ওয়াটার খান। তার বাইরেও রয়েছে জলের নানা রকম এবং তার দাম আকাশছোঁয়া। বিশ্বের সবচেয়ে দামি জল বলে পরিগণিত পানীয়ের মাত্র ৭৫০এমএল বোতলের দাম ভারতীয় মুদ্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা! এখানেই আলাদা হয়ে যায় প্রয়োজন ও বিলাসিতার পথ। আর ‘লাক্সারি’কে কি কখনও দামে বাঁধা যায়? কিন্তু এমন কী আছে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের এই মিশেলে, যার জন্য আকাশছোঁয়া দাম? এই বিলাসী জল কখনও হয়তো সংগ্রহ করা হয়েছে হাওয়াই দ্বীপের ভলকানিক পাথর থেকে, কোনও ক্ষেত্রে তা সংগৃহীত নরওয়ের কোনও গলিত হিমবাহ থেকে বা তাসমানিয়ায় ঘাসের উপরে জমা শিশিরবিন্দু থেকে... এ ধরনের জলকে বলা হয় ‘পিয়োরেস্ট অব পিয়োর’।

অ্যাকোয়া: ডি ক্রিস্টালো-র সুদৃশ্য বোতল।

অ্যাকোয়া: ডি ক্রিস্টালো-র সুদৃশ্য বোতল।

এত দাম কেন?

তবে এই সব দামি জলের বিশেষ গুণও রয়েছে। তাই তার এত কদর। ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট অনন্যা ভৌমিক মিত্র বিশদে বুঝিয়ে দিলেন কোনও জলের দাম বেশি হওয়ার পিছনে কারণ।

  • দামি জলের মধ্যে প্রথম নামটি অবশ্যই স্প্রিং ওয়াটারের। এই জল সংগ্রহ করা হয় নদী বা ঝর্নার উৎসমুখ থেকে অর্থাৎ তা হিমবাহের বরফগলা জল, যাতে সেরা মিনারেলস পাওয়া যায় এবং তা বিশুদ্ধ। “স্প্রিং ওয়াটার সংগ্রহের বেশ কিছু নিয়ম আছে। সেই জায়গায় ওই অবস্থায় তা সংগ্রহ করতে হবে এবং বোতলবন্দিও সেখানেই করা হবে। তাই যথাযথ ভাবে নিয়ম মেনে স্প্রিং ওয়াটার সংগ্রহ করা হচ্ছে কি না এবং তা প্রকৃতই স্প্রিং ওয়াটার কি না সেটা বলা সম্ভব নয়, যদি না তা খুবই বিখ্যাত কোনও সংস্থার হয়, যারা সব সময়ে নিজেদের মান সম্পর্কে সচেতন। এই জল অবশ্যই শরীরের জন্য খুব ভাল,” বললেন অনন্যা। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জলের শিরোপা পাওয়া অ্যাকোয়া ডি ক্রিস্টালো ট্রিবুতো আ মোদিগিলানি আসলে কিন্তু স্প্রিং ওয়াটার। ৭৫০ মিলিলিটার জলের দাম ৫০ লক্ষ টাকা! বলা হয় এই ছোট্ট বোতলটিতে রয়েছে ফিজ়ি ও ফ্রান্সের দু’টি বিশেষ ঝর্না এবং আইসল্যান্ডের হিমবাহের বরফগলা জল। এই জলের দামের আর এক কারণ অবশ্য তার বোতলের ডিজ়াইন এবং প্যাকেজিং। প্ল্যাটিনামে মোড়া সীমিত সংস্করণের অসাধারণ দেখতে এই বোতলে ছ’হাজার হিরে খচিত। জলে মিশ্রিত রয়েছে তেইশ ক্যারাট ওজনের পাঁচ গ্রাম সোনার ভস্ম। অতএব বোঝাই যাচ্ছে দামের কারণ।
  • এ ছাড়াও নেভাস, ও অ্যামাজ়ন, ফিলিকো, কোনা নিগারি, ব্লিং এইচটুও, ইত্যাদি অন্যান্য দামি জলের নাম। তার কোনওটির দাম আড়াই লাখ, কোনওটি দেড় লাখ, কোনও জল আবার পঁয়ত্রিশ হাজার, কোনওটি বিশ হাজারি, কোনওটি পাঁচ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়। ফিলিকো এবং কোনা নিগারি মেলে জাপানে। কোনা নিগারির জল ঝর্না থেকে সংগৃহীত এবং তার উপকারিতা বহুবিধ। ফিলিকো আবার গুণের পাশাপাশি দেখনদারিতেও তাকলাগানো। বোতলের ঢাকনাটি যেন মুকুট এবং তা সোনা দিয়ে তৈরি। দু’লাখ একত্রিশ হাজার টাকা মূল্যের ও অ্যামাজ়ন পৃথিবীর একমাত্র জল যা সংগ্রহ করা হয় অ্যামাজ়নিয়া অঞ্চল থেকে এবং বোতলবন্দি করা হয়। নেভাসের জল সংগ্রহ করা হয় দু’টি ভিন্ন আর্টেজিয়ান ঝর্না থেকে। ভূগর্ভস্থ এই জল নানা প্রাকৃতিক খনিজ সমৃদ্ধ যা শরীরের জন্য উপকারী।
  • এ বার আসা যাক ডিস্টিলড ওয়াটার প্রসঙ্গে। এ ক্ষেত্রে জল ফুটিয়ে বাষ্পে পরিণত করা হয়। তার পর সেই বাষ্পকে ফের জলে পরিবর্তিত করা হয়। এর ফলে এর মধ্যে কোনও মিনারেলস থাকে না। এই জল খেলে কোনও রকম পেটের সমস্যা হবে না। কিন্তু ক্রমাগত যদি শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজবিহীন ডিস্টিলড ওয়াটার খাওয়া হয়, তা শরীরের জন্য উপযোগী নয়।
  • অ্যালক্যালাইন ওয়াটার ইদানীং খুবই জনপ্রিয় হয়েছে সেলেব্রিটিদের সুবাদে। সাধারণ জলের পিএইচ লেভেলের চেয়ে অ্যালক্যালাইন ওয়াটারের পিএইচ লেভেল বেশি থাকে। তাই মনে করা হয় যাঁদের অ্যাসিডিটির সমস্যা খুব বেশি তাঁরা অ্যালক্যালাইন ওয়াটার খেলে ভাল থাকবেন। “হয়তো সাময়িক ভাল থাকেন। কিন্তু আমাদের শরীরের পিএইচ ব্যালান্স ঠিক রাখার যে নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে, নিয়মিত অ্যালকালাইন ওয়াটার খেলে তার কার্যকারিতা কিছুটা হলেও কমতে পারে। রিসার্চ বলছে না যে দীর্ঘ দিন ধরে অ্যালকালাইন ওয়াটার খাওয়া শরীরের জন্য ভাল। এতে কিছুটা হলেও মিনারেলস থাকে, তবে তা যে শরীরের জন্য একশো শতাংশ ভাল, তা বলা যায় না,” মত অনন্যার। আবার অনেকে ভাবেন অ্যালক্যালাইন ওয়াটার ক্যানসারের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয় এবং তা বয়স ধরে রাখে— এর কোনওটিই কিন্তু এখনও পর্যন্ত প্রমাণিত নয়। অ্যালক্যালাইন ওয়াটারে মিনারেলস ইনফিউজ় করা হলে তাকে ব্ল্যাক ওয়াটার বলা হয়। এই জলও খুবই দামি।
  • বাড়িতে অনেকে বোতলবন্দি মিনারেল ওয়াটারও খেয়ে থাকেন। সেটা ভাল কোম্পানির হলে তাতে বিভিন্ন মিনারেল থাকে। জীবাণু না থাকার জন্য তা থেকে পেটখারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, তবে তা খরচসাপেক্ষ।
  • শরীরের জন্য কুয়োর জল খুবই ভাল। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে তাতে ব্যাক্টিরিয়া জন্মাচ্ছে কি না। কুয়োর জলের পিএইচ ব্যালান্স যথাযথ, মিনারেলসও রয়েছে, শুধু পরিশোধন করে নেওয়া প্রয়োজন।
  • এ ছাড়াও রয়েছে স্পার্কলিং ওয়াটার। এর মধ্যে সোডা দেওয়া থাকে, তাই খেতে ভাল লাগে। তবে তা কোল্ড ড্রিঙ্কের মতো নয়, এই জলে অতিরিক্ত চিনি বা ফ্লেভার নেই। নিয়মিত এই জল খাওয়া উচিত নয়।
  • যাঁরা খুব কম জল খান বা ছোটরা অনেক সময়ে জল খেতে চায় না, সে ক্ষেত্রে ইনফিউজ়ড ওয়াটার দিতে পারেন। পরিস্রুত জলে আনাজ বা ফলের ফ্লেভার মেশানো হয়। ফলে জলের স্বাদ বাড়ে, জল খাওয়ার ইচ্ছেও বাড়ে। বাড়িতে নিয়মিত জল ইনফিউজ়ড করে রাখলে ক্ষতি নেই, যদি না তাতে চিনি বা কৃত্রিম কোনও সুইটনার যোগ করা হয়।

পরিশেষে এটুকুই বলার, সব ধরনের জল সকলের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই। জল যেন পরিস্রুত হয় এবং তাতে মিনারেলস যেন যথাযথ থাকে, খাওয়ার আগে এটুকু দেখে নিলেই যথেষ্ট। এতে পেটের গোলমাল বা অন্য রোগের ভয় থাকে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Mineral Water expensive Water Bottles health benefits

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy