উদাহরণ এক, বিয়ের পরে বছর ছয়েক পার, অথচ সন্তান আসেনি ঋতুপর্ণা আর কৌশিকের। তারা সন্তান চায়, কিন্তু যেটা চায় না, তা হল এই বিষয়কে কেন্দ্র করে আশপাশের মানুষের চাপা কটাক্ষ। সরাসরি কথা শোনানো না হলেও যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় ঋতুপর্ণাকে, তা শুধু সে-ই জানে। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে মনের আগল খোলে মেয়েটি। বলে, ‘যে করে হোক, একটা উপায় বার করুন’। একাধিক বার আইভিএফের চেষ্টাতে ব্যর্থ হয়েছে এই দম্পতি। এখন তারা মরিয়া।
উদাহরণ দুই, পোস্ট ডক্টরেটের জন্য বিদেশে যাওয়া চূড়ান্ত অয়ন্তিকার। সদ্য বিয়ে হয়েছে তার। সন্তানধারণ নয়, কেরিয়ারকেই প্রাধান্য দিতে চায় বছর তিরিশের অয়ন্তিকা। স্বামী ও পরিবারের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছে সে এ ব্যাপারে। তাই সে আপাতত পিছিয়ে দিতে চায় ফ্যামিলি প্ল্যানিং।
কাল্পনিক নয়, এই দু’টি উদাহরণই কলকাতার এক নামী স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। আর এই দু’টি উদাহরণেই স্পষ্ট— পরিস্থিতি আলাদা হলেও সন্তান আসার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে না এই দু’ক্ষেত্রেই। বিভিন্ন কারণে স্বাভাবিক সন্তানধারণের হার যে আগের চেয়ে কমে এসেছে, এটা আমাদের আশপাশটা একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। রাষ্ট্রপুঞ্জের পপুলেশন ফান্ডের সাম্প্রতিক রিপোর্টও ঠিক সে কথাই বলছে। এ দেশের টোটাল ফার্টিলিটি রেট এখন পৌঁছেছে ১.৯-এ (যা রিপ্লেসমেন্ট লেভেল ২.১-এর নীচে)। বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশের পক্ষে এই পরিসংখ্যানটি এক অর্থে সদর্থক। কিন্তু প্রজননক্ষমতার হার কমে যাওয়ার সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে আমরা কতখানি সচেতন? সন্তান চাইছেন না, কিংবা চেয়েও পাচ্ছেন না... এই বাস্তব পরিস্থিতি ঠিক কী রকম? সন্তানধারণের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে বিষয়গুলি, সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে যে সব কারণ, সেগুলোও খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।
ছবি: সর্বজিৎ সেন।
অনিচ্ছা ও অপারগতা
গত ২৫-২৬ বছর ধরে প্র্যাকটিস করছেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বললেন, “দশ-পনেরো বছর আগেও বেশির ভাগ দম্পতি দু’জন সন্তানের কথা ভাবতেন। আর এখন সামগ্রিক ভাবেই সন্তান নেওয়ায় নিরুৎসাহী হয়ে পড়েছেন তাঁরা। আমরা কাউন্সেলিং করতে গিয়ে দেখেছি, এই উৎসাহ হারিয়ে ফেলার প্রধান কারণটা অর্থনৈতিক। এখন সব কিছুর খরচ এত বেড়ে গিয়েছে যে, একজন সন্তান মানুষ করতেই নাভিশ্বাস ওঠে সাধারণ মধ্যবিত্তের।” অর্থাৎ অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি এখানে একটি প্রধান নির্ণায়ক।
যাঁরা আর্থিক ভাবে সচ্ছল, তাঁদের ক্ষেত্রে কেরিয়ার, সময়ের অভাব, সন্তানের দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা, পরিবারের সদস্যের সমর্থনের অভাব, নিজের স্বাধীন সময়টুকু হারিয়ে ফেলার মতো বিষয়গুলি মুখ্য কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নানা আশঙ্কায় কেউ কেউ সন্তান আনতেই দ্বিধা বোধ করেন এই সময়ের পৃথিবীতে।
আর একটি দিক হল সন্তানধারণে অপারগতা। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে বন্ধ্যাত্বের হার যে আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গিয়েছে, যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা আইভিএফ সেন্টারগুলিই তার প্রমাণ। ডা. চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “লাইফস্টাইলে পরিবর্তন এর পিছনে যে প্রধান কারণ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিভিন্ন কারণে দেরিতে প্ল্যানিং শুরু করেন এখনকার ছেলেমেয়েরা। তখন শরীরে সমস্যা বাসা বাঁধতে শুরুকরে দেয়। মা হওয়ার সেরা সময় তিরিশ বছরের মধ্যে, এটা আমরা বারবার বলি।”
এজিং অব ওভারি, স্পার্ম কোয়ালিটি হ্রাস পাওয়া... এই ধরনের সমস্যা বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে গত কয়েক দশকে। গাইনিকলজিস্ট ডা. চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত বললেন, “সামগ্রিক ভাবে মহিলাদের ফার্টাইল সময়সীমা কমে যাচ্ছে। মেনোপজ় এগিয়ে আসছে, তিরিশ পেরোনোর আগেই ফার্টিলিটি সেন্টারে যেতে হচ্ছে দম্পতিদের। এর জন্য খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা সবচেয়ে আগে দরকার।”
দায়িত্ব বড় কঠিন
আগেকার দিনে ঠাকুরমা-দিদিমারা দশ-বারোজন বাচ্চা হেসেখেলে কী ভাবে মানুষ করে দিতেন, সেই গল্প শুনে আমরা সকলেই বড় হয়েছি। আজকের দিনে নিউক্লিয়ার পরিবারে তা কষ্টকল্পনা বই কিছু নয়। বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রী মিলে সংসার পেতেছে, মা-বাবা দূরে। কর্মসূত্রেও অনেকে দূরে যেতে বাধ্য। এ দিকে সন্তান আসার পরেই তার দেখাশোনার জন্য দরকার হয়ে পড়ছে সেই অভিভাবকদের— এমন ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। তা সব সময়ে হয়তো সম্ভব হচ্ছে না। কাজের জায়গায় ক্রেশ কিংবা ডে কেয়ারের অভাব, দীর্ঘ কাজের সময়, পরিবারের কেউ না থাকলে গৃহসহায়িকার উপরে নির্ভরশীলতা... ইত্যাদি কারণে বাচ্চা নেওয়ার আগে দু’বার ভাবছেন এখনকার কর্মরতা মায়েরা। ডা. দাশগুপ্ত এ প্রসঙ্গে জোর দিলেন কর্মরতা মায়েদের সুবিধার্থে সরকারি পলিসি তৈরির উপরে, “কারও মা হওয়ার পথে কোনও বাহ্যিক কারণ যাতে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়, সেটা নিশ্চিত করা দরকার। চাকরিরতা মায়েদের জন্য কর্মক্ষেত্রে ক্রেশের সুবিধা, ফ্লেক্সিবল ওয়ার্কিং আওয়ারের মতো কিছু সুবিধা সুনিশ্চিত করা দরকার।”
ছবি: সর্বজিৎ সেন।
গ্রাম ও শহর
রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট এ দেশের প্রজননক্ষমতার হারের একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছে মাত্র। আলাদা করে শহর-গ্রাম কিংবা ধর্ম-জনগোষ্ঠীর পার্থক্যের ভিত্তিতে এর তারতম্যের কথা উঠে আসে না এই রিপোর্টে। মেদিনীপুরের ইটভাটায় কাজ করা এক নারীশ্রমিক আর নিউ টাউনের এক চাকরিজীবী মায়ের সন্তানধারণের পরিস্থিতি আলাদা করে বিবেচনাযোগ্য। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে মাইক্রোপ্ল্যানিংয়ের অভাব রয়েছে প্রশাসনের তরফে। ভোটবাক্সে প্রভাব পড়বে, সেই আশঙ্কায় রাজনৈতিক দলগুলিও এ প্রসঙ্গে সচেতনতার প্রচার প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।
তবে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে যত সমীক্ষা হয়েছে, তাতে পরিষ্কার যে, দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে ফার্টিলিটি রেট বরাবরই কম, উত্তরপ্রদেশ, বিহার ইত্যাদি রাজ্যের তুলনায়। এর একটা বড় কারণ প্রত্যাশিত ভাবেই সাক্ষরতার হার। বিশেষ করে নারী সাক্ষরতা। শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের প্রকৃত প্রয়োগ যেখানে সম্ভব হয়েছে, সেখানে নিজের নিয়মেই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে জন্মহার। মেয়েদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, সচেতনতা ও শিক্ষার আলো পৌঁছনোর মতো বিষয়গুলি এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য। এ প্রসঙ্গে সমাজতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক অনিরুদ্ধ চৌধুরী বললেন, “১৯৭০ সালে যেখানে নারীপিছু সন্তানের সংখ্যা ছিল পাঁচ, সেটা এখন দুই বা এক-এ এসে দাঁড়িয়েছে। তবে এই যে সার্ভেতে একটি গড় হিসাব দেখানো হচ্ছে, তাতে অনেক সময়েই স্থানভিত্তিক প্রকৃত তথ্য উঠে আসছে না। এটাই ফ্যালাসি অব সার্ভে। তবে এটাও সত্যি, সন্তানধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আগে মেয়েদের কোনও ভূমিকা ছিল না। প্রত্যন্ত এলাকায় শুধু নয়, অনেক শিক্ষিত পরিবারেও ছিল না তা। এই ছবি এখন অনেকটাই পাল্টেছে।”
ছবি: সর্বজিৎ সেন।
এ পৃথিবী আগামীর বাসযোগ্য কি না, তা তর্কসাপেক্ষ। তবে সন্তান নেওয়া বা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত একান্তই দম্পতিবিশেষের। সেই সিদ্ধান্ত যেন আরোপিত না হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত হয়, সেই চেষ্টা জারি থাকাই দরকার।
মডেল: অঙ্গনা রায়, সত্যব্রত মণ্ডল,
ছবি: সর্বজিৎ সেন,
মেকআপ ও হেয়ার: সোহরাব আলি,
পোশাক: (অঙ্গনা) জুয়েল থিফ বাই সৌমালিনী বিশ্বাস, বালিগঞ্জ ফাঁড়ি, (সত্যব্রত) কণিষ্ক, গড়িয়াহাট,
লোকেশন: উষাবতী, মতিলাল নেহরু রোড।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)