ভুল শোধরানোর পালা শুরু হয়েছিল আগেই। ৩৬ বছর পরে সেই বৃত্তটাই কি সম্পূর্ণ হল?
শুক্রবার বিকেলে ভারতের প্রথম টেস্ট টিউব বেবির জনক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ছবির পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সময়মতো স্বীকৃতি দিতে না পারার লজ্জায় মাথা নোয়ালেন দেশ-বিদেশের বন্ধ্যত্ব চিকিৎসকেরা। নিজেদের কাজের মাধ্যমে সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার শপথও নিলেন তাঁরা। ওই একই মঞ্চে সেই দৃশ্যের সাক্ষী থাকলেন সুভাষবাবুর টিম-এর একমাত্র জীবিত সদস্য, ক্রায়োবায়োলজিস্ট সুনীত মুখোপাধ্যায় এবং প্রথম টেস্ট টিউব বেবি দুর্গার বাবা প্রভাত অগ্রবাল। সুভাষ মুখোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা দিতে ভারতে এসেছিলেন বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় বিশ্বের একটি পরিচিত নাম, ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপ্রোডাক্টিভ মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের প্রধান অ্যাডাম ব্যালেন। তিনিও মেনে নিলেন, গোটা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরাই সুভাষবাবুর কাছে ঋণী।
১৯৭৮ সালের ৩ অক্টোবর জন্ম নিয়েছিল দুর্গা ওরফে কানুপ্রিয়া অগ্রবাল। অধুনা মুম্বইয়ের বাসিন্দা দুর্গা তাঁর অতীতকে লুকনোর কোনও চেষ্টাই করেন না। যেমন করেননি তাঁর বাবাও। এ দিনের অনুষ্ঠানের পরে প্রভাতবাবু বলেন, “আমার মেয়েটা সুখে আছে। ওর নিজের সন্তানও হয়েছে। কিন্তু আমাদের যিনি সন্তানসুখ দিলেন, জীবদ্দশায় তিনি স্বীকৃতি পাননি, এই বেদনা কখনও যাবে না।” একই কথা বলেছেন সুনীত মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায়, “টেস্ট টিউব বেবি নিয়ে গোটা পৃথিবী অনেক পরে যা ভেবেছে, সুভাষবাবু তা ভেবেছিলেন আগেই। কিন্তু তখন সেই জ্ঞান গ্রহণের করার মতো পরিণত মানসিকতা সমাজের ছিল না।”
অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল বেঙ্গল ইনফার্টিলিটি অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ থেরাপি হসপিটাল বা সংক্ষেপে বার্থ। প্রতিষ্ঠানের তরফে অপর্ণা খাস্তগীর তাঁর বক্তৃতায় মেয়েদের নানা অসুখ নিয়ে সামাজিক নিস্পৃহতার উল্লেখ করেন। কখনও কখনও চিকিৎসক মহলও যে এর ঊর্ধ্বে নয়, জানান সে কথাও। সংস্থার মেডিক্যাল ডিরেক্টর গৌতম খাস্তগীরের কথায়, “এখনও আইভিএফ অর্থাৎ টেস্ট টিউব প্রযুক্তিতে সন্তান জন্মের কথা বাবা-মা অনেক সময়েই গোপন রাখতে চান। কিন্তু অত বছর আগে সুভাষ মুখোপাধ্যায় যে আলোর দিশা দেখিয়েছিলেন, সেই আলোর উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন দুর্গার পরিবার। তাঁরা জনসমক্ষে আসতে দ্বিধা করেন না।”
দুর্গা জন্মেছিল পৃথিবীর প্রথম টেস্ট টিউব বেবি লুই ব্রাউনের জন্মের ৬৭ দিন পরে। তখন দুর্গার স্রষ্টাকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৮১-র জুন মাসে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন সুভাষবাবু। গৌতমবাবু বলেন, “ওঁকে জাপানে নিজের গবেষণাপত্র পাঠ করতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। শাস্তিমূলক ভাবে চোখের হাসপাতালে বদলি করা হয়। দিনের পর দিন এক দল ঈর্ষাকাতর ডাক্তার ওঁকে হেয় করেছেন।”
অ্যাডাম ব্যালেন জানান, বন্ধ্যত্বের সমস্যা বাড়ছে পৃথিবী জুড়েই। পরিস্থিতি এমনই যে ২০১২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ বিষয়ে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে। কিন্তু বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার জন্য গড়ে ওঠা ক্লিনিকগুলির কত শতাংশ লাইসেন্স নিয়ে কাজ করছে, বা রোগীকে সঠিক তথ্য জানাচ্ছে? তিনি বলেন, “প্রযুক্তির ব্যবহার বুঝেশুনে করা হয় তো? যথেচ্ছাচার চালানোর প্রবণতা সঠিক সময়ে রুখে দেওয়া যাচ্ছে তো?”
হরিয়ানার রাজো দেবী লোহানের উদাহরণ টেনে আনেন ব্যালেন। ৭০ বছরে মা হয়েছিলেন রাজো দেবী। কিন্তু সন্তানের যখন দেড় বছর বয়স, তখনই মৃত্যুমুখে পৌঁছন তিনি। কারণ অত বয়সে মা হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ধকল নিতে পারেনি তাঁর শরীর।
গৌতমবাবুও জানান, প্রযুক্তি রয়েছে বলে বেশি বয়সে মা হচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু তাঁদের শরীর সেই ধকল নিতে পারবে কি না, পরিবার পাশে কি না, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবটাই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের যাচাই করে নেওয়া উচিত।