নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া সরকারি হাসপাতালের ব্যস্ত শয্যা আটকে রাখা অযৌক্তিক। এ কথা মানছেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু তাঁরা ভেবে পাচ্ছেন না, মাত্র মাসখানেক বয়সের একটি শিশু ও তার মাকে এই শহরে নিঃসহায় অবস্থায় কী ভাবে ছেড়ে দেবেন? ওই দু’জনকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন যে পুলিশকর্মীরা, তাঁদের কাছেও কোনও জবাব নেই। ফলে এই মুহূর্তে আক্ষরিক অর্থেই ধর্মসঙ্কটে উভয়পক্ষ।
১১ অক্টোবর রাতে একটি ফোন পেয়েছিলেন উত্তর বন্দর থানার সাব ইনস্পেক্টর দেবশ্রী আহিরী। ফোনে জেনেছিলেন, তাঁর থানা এলাকায় জ্যোতিনগর কলোনিতে রাস্তার উপরেই প্রসব করেছেন এক তরুণী। সেখানে পৌঁছে তিনি দেখেন, এক তরুণী রক্তাক্ত অবস্থায় একটি শিশুপুত্রকে বুকে আঁকড়ে রয়েছেন। বাচ্চাটির সর্বাঙ্গ ভেজা, রীতিমতো ধুঁকছে সে। মেয়েটির আচরণ দেখে তাঁকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলেই মনে হয় তাঁদের। বাচ্চাটিকে তাঁর কাছ থেকে নিতে গেলেও তিনি বাধা দিচ্ছিলেন। স্থানীয়েরা পুলিশকে জানান, প্রসবের পর নিজে ব্লেড দিয়ে নাড়ি কেটেছেন ওই তরুণী। পরে গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে শিশুটিকে স্নান করিয়েছেন। বেশিক্ষণ শিশুটি ওই তরুণীর কাছে থাকলে তার জীবন-সংশয় হবে বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করেন স্থানীয়েরা।
পুলিশ কোনওমতে শিশুটিকে উদ্ধার করে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে আসে। ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসক কৌশানি চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে শিশুটিকে সিক নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিটে (এসএনসিইউ) ভর্তি করা হয়। ওই তরুণীকে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় প্রথমে স্থানীয় একটি নার্সিংহোমে এবং পরে মেডিক্যাল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগে ভর্তি করে পুলিশ।
দেবশ্রীদেবী জানান, তরুণী কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তাঁর নাম লালমণি। বাড়ি বিহারের ছাপরায়। উত্তর বন্দর থানার মাধ্যমে তাঁরা বিহারের থানায় যোগাযোগ করেন। খবর দেওয়া হয় গ্রামের মুখিয়াকে। তিনি লালমণির বাড়ির লোকদের থানায় ডেকে আনলে তাঁরা জানান, লালমণি ক’বছর ধরেই মানসিক রোগগ্রস্ত। স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন, শ্বশুরবাড়ি থেকেও তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লালমণির বাবা জানান, তাঁদের দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারে মেয়ে ও তার সন্তানকে ঠাঁই দেওয়ার সংস্থান নেই।
এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালই হয়ে উঠেছে মা ও সন্তানের একমাত্র আশ্রয়। ঘটনাটি জেনে চিকিৎসক এবং নার্সরাও এই দু’জনকে নিয়ে বাড়তি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছেন। ওয়ার্ডের এক নার্সের কথায়, “বাচ্চাটাকে দত্তক নিতে অনেকে আগ্রহী। কিন্তু মা-ও তার সন্তানকে কোলে পেতে অস্থির হয়ে উঠেছেন। শেষ পর্যন্ত কী হবে জানি না।”
হাসপাতাল সূত্রে খবর, শিশুটি এখন সুস্থ। তার মা-ও তাকে চাইছেন। কিন্তু মানসিক ভাবে অসুস্থ মা ও তাঁর সন্তানকে কোন ভরসায় বাইরে ছেড়ে দেবেন ভেবে পাচ্ছেন না চিকিৎসকেরা। এসএনসিইউ-এর শয্যা এ ভাবে আটকে থাকায় প্রতি মুহূর্তে জবাবদিহিও করতে হচ্ছে তাঁদের। এক চিকিৎসকের কথায়, “বাচ্চাটি যখন হাসপাতালে পৌঁছেছিল, তখন অবস্থা খুবই সঙ্গীন ছিল। সেই অবস্থা থেকে সুস্থ করেছি আমরা। এখন ও যাতে একটা স্বাভাবিক জীবন পায়, সেটাই কাম্য।” লালমণির চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আপাতত তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল। নিয়মিত ওষুধপত্র পেলে তাঁকে সম্পূর্ণ সুস্থ জীবনে ফেরানো সম্ভব।
দেবশ্রীদেবীর বক্তব্য, “পুলিশ এবং হাসপাতালের ডাক্তার, দু’ক্ষেত্রেই মানুষের বহু অভিযোগ থাকে। এ ক্ষেত্রে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি মেয়েটি ও তার সন্তানকে নতুন জীবন দেওয়ার। কিন্তু এর পর কী হবে জানি না।” বিষয়টি নিয়ে কপালে ভাঁজ স্বাস্থ্যকর্তাদেরও। তাঁরা জানিয়েছেন, এমন সমস্যা সচরাচর তাঁদের সামনে আসে না। তাই তাঁরাও ভেবে পাচ্ছেন না কী করবেন। দফতরের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “সমাজকল্যাণ দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। মা ও শিশু দু’জনেই এখন সুস্থ। কোনও হোমে যদি দু’জনকে একসঙ্গে রাখা যায়, তা হলে সব দিক রক্ষা পাবে।”