Advertisement
E-Paper

কর্কটরোগে সস্তা দাওয়াই, দিশা চার বাঙালির

শিয়রে শমন নিয়ে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। এই পরিস্থিতিতে কম খরচে ক্যানসারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ওষুধের হদিস দিয়ে ক্যানসার চিকিৎসকদের নতুন দিশা দেখালেন এক দল বাঙালি বিজ্ঞানী। আমেরিকার ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং কলকাতার চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের চার বিজ্ঞানীর সাম্প্রতিক গবেষণায় ধরা পড়েছে, ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে এমন একটি রাসায়নিকের, যা তৈরি হয় আমাদের মস্তিষ্কেই। রাসায়নিকটির নাম ‘ডোপামিন’।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:৪৭

শিয়রে শমন নিয়ে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। এই পরিস্থিতিতে কম খরচে ক্যানসারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ওষুধের হদিস দিয়ে ক্যানসার চিকিৎসকদের নতুন দিশা দেখালেন এক দল বাঙালি বিজ্ঞানী।

আমেরিকার ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং কলকাতার চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের চার বিজ্ঞানীর সাম্প্রতিক গবেষণায় ধরা পড়েছে, ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে এমন একটি রাসায়নিকের, যা তৈরি হয় আমাদের মস্তিষ্কেই। রাসায়নিকটির নাম ‘ডোপামিন’। ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ক্যানসার’-এ ওই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষক দলটিতে রয়েছেন ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল অঙ্কোলজি বিভাগের সুজিত বসু, প্যাথোলজি বিভাগের চন্দ্রাণী সরকার ও দেবাঞ্জন চক্রবর্তী এবং কলকাতার চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের এমেরিটাস বিজ্ঞানী পার্থসারথি দাশগুপ্ত। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বহু সময়ে ক্যানসার রোগীদের রক্তে শ্বেত কণিকার পরিমাণ অস্বাভাবিক কমে যায়। ডোপামিন ব্যবহার করলে সেটাও ঠেকানো সম্ভব।

আর বছর পাঁচেকের মধ্যেই মহামারীর আকার নেবে ক্যানসার। ছড়িয়ে পড়বে প্রায় প্রতি ঘরে। এমনই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(হু)। একে তো এই মারণ রোগের বাড়বৃদ্ধি ঠেকানো দুষ্কর। তার উপরে আবার ওষুধের আকাশছোঁয়া দাম। ফলে অনেকেরই তা সাধ্যের বাইরে। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও মারাত্মক। দিন কয়েক আগেই আমেরিকার জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক জানিয়েছেন, অন্তত দুই তৃতীয়াংশ ক্যানসারের কারণ জিনের আকস্মিক মিউটেশন। একে ‘ব্যাড লাক ফ্যাক্টর’ বলেছেন তাঁরা। বিজ্ঞানীরাই যদি ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করেন, তা হলে আমজনতা কোথায় যাবেন, সেই প্রশ্ন নিয়েও তোলপাড় চলছে পৃথিবী জুড়ে। এই পরিস্থিতিতে ওই বাঙালি বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্র এক ঝলক আশার আলো বলেই মনে করছেন ক্যানসার চিকিৎসকরা।

দেহে নতুন রক্তজালিকা বা ক্যাপিলারির সৃষ্টিকে বলে অ্যাঞ্জিওজেনেসিস। এর থেকে ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের জন্ম হতে পারে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের বৃদ্ধির হারও বাড়িয়ে দেয় এই প্রক্রিয়া। চিকিৎসা পরিভাষায় যার নাম ভাস্কুলার এন্ডোথেলিয়াল গ্রোথ ফ্যাকটর।

এখন রক্তনালী এবং রক্তজালিকা বাড়ার সঙ্গে ক্যানসারের সম্পর্ক কী? ক্যানসার বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, যে গ্রন্থিতে ক্যানসার হয় সেগুলিতে অতিরিক্ত কোষ বিভাজনের ফলে টিউমার তৈরি হয়। কোষ বিভাজন যত দ্রুত হয়, তত ক্যানসারের ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। টিউমারের কোষগুলিতে খাদ্য সরবরাহ করে রক্তজালিকা। টিউমার নিজের পুষ্টির জন্য নিজে থেকে রক্তজালিকা তৈরি করে। তাই টিউমার যত বড় হতে থাকে, ততই সংখ্যা বাড়ে রক্ত জালিকার। ওই রক্তজালিকার সংখ্যা কোনও ভাবে কমিয়ে আনা গেলে টিউমারের কোষগুলিতে রক্তসরবরাহ কমে যায়। ফলে ওই কোষগুলি আর পর্যাপ্ত অক্সিজেন এবং খাদ্য পায় না। তাই এক সময় ওই অতিরিক্ত কোষগুলি মরে যায়। এ ভাবেই তাদের বৃদ্ধি রোধ হয়।

রক্তজালিকা তৈরি ঠেকানোর জন্য অ্যান্টিঅ্যাঞ্জিওজেনিক ড্রাগ ব্যবহার হয়। কিন্তু সেগুলি যে শুধু অত্যন্ত দামি তা-ই নয়, তার টক্সিক এফেক্ট (এক ধরনের বিষক্রিয়া)-ও মারাত্মক বলে চিকিৎসকদের অভিমত। সেই কারণেই ওই ওষুধ চিকিৎসকেরা সচরাচর ব্যবহার করতে চান না। ওই বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, ডোপামিন ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করে ক্যানসারের টিউমারের বৃদ্ধি দ্রুত আটকে দেওয়া যাচ্ছে।

তা ছাড়া, এর খরচও বেশ কম। ক্যানসার চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, রক্তজালিকার বৃদ্ধি আটকানোর বাজারচলতি ইঞ্জেকশনটির একটি কোর্স শেষ করতেই খরচ হয় লক্ষাধিক টাকা। তা ছাড়া এর কার্যকারিতাও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের বেশি নয়। তা সত্ত্বেও বাঁচার আশায় বহু মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে ওই চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ভারতের মতো দেশে যেখানে অসংখ্য দরিদ্র মানুষ প্রতি দিন এই রোগের শিকার হচ্ছেন, সেখানে বিকল্প ব্যবস্থার হদিস পাওয়াটা খুবই জরুরি বলে মনে করছেন তাঁরা। ডোপামিন ইঞ্জেকশন ব্যবহার করে চিকিৎসার মোট খরচ হাজার টাকার বেশি নয়।


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন

কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপিতেও টিউমারের বৃদ্ধি আটকায়। কিন্তু সে সব ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব বেশি। কারণ ক্যানসারের কোষের পাশাপাশি দেহের স্বাভাবিক কোষগুলোকেও নষ্ট করে দেয় কেমো বা রেডিয়েশন। ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “অ্যান্টিঅ্যাঞ্জিওজেনিক ওষুধ বাজারে রয়েছে। কিন্তু খুব দামি। একটা কোর্সের দাম প্রায় এক লাখ। ৬ থেকে ৮টা কোর্স দরকার হয়। ডোপামিনের এই ব্যবহার যদি ভবিষ্যতে চালু হয়, তা হলে তাকে আমরা যুগান্তকারী বলতেই পারি। খরচ বাঁচিয়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন কোনও ওষুধ ক্যানসার রোগীদের নাগালে আসছে, এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে?” ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “রক্তজালিকা বৃদ্ধি ঠেকানোর ইঞ্জেকশন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সেটাও ম্যাজিক ড্রাগ নয়। তাই বহু ক্ষেত্রে রোগীরা সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়ে ওষুধের ব্যবস্থা করলেও, যথাযথ ফল মেলে না। ডোপামিনের মতো সস্তার ওষুধ ক্যানসার রোধে কার্যকরী হলে, খুবই ভাল।” ডোপামিনের ব্যবহারে সুফল মিললে সেটা ক্যানসার রোগীদের কাছে সুখবর, মানছেন ক্যানসার চিকিৎসক সৈকত গুপ্তও। তবে তাঁর হুঁশিয়ারি, “ডোপামিনের ডোজের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। ডোজ বেশি হলে তার জেরে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।”

ডোপামিন হল এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার। অর্থাৎ বিভিন্ন স্নায়ুর মধ্যে সংযোগ তৈরি করতে সাহায্য করে এই রাসায়নিক। পার্কিনসনস ডিজিজের ক্ষেত্রে এই নিউরোট্রান্সমিটার কমে যায়। আবার স্কিজোফ্রেনিয়ার ক্ষেত্রে বেড়ে যায়। বহু দিন ধরেই পার্কিনসনস, কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজের চিকিৎসায় ডোপামিনের ব্যবহার চালু রয়েছে। সুজিতবাবু জানিয়েছেন, দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে ইঁদুরের ওপরে তাঁরা ওই পরীক্ষা চালিয়েছেন। ইঁদুরের দেহে মানুষের দেহের ক্যানসারবাহী টিউমার কোষ প্রবেশ করিয়ে সেই ইঁদুরকে সব রকম মাপকাঠি মেনে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে। টানা দু’সপ্তাহ ইঞ্জেকশন প্রয়োগের পরে দেখা গিয়েছে টিউমারের বৃদ্ধি আটকে গিয়েছে। ভবিষ্যতে মানুষের শরীরেও পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহার করা হবে রাসায়নিকটি।

কিন্তু এর পর কী? এখনও খুব স্বস্তিতে থাকতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা। তাঁদের আশঙ্কা, ক্যানসার চিকিৎসার সঙ্গে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য যুক্ত। রাতারাতি কোনও সস্তার ওষুধ কার্যকরী প্রমাণিত হলে বহু বাধা আসতে পারে। সেই বাধার সঙ্গে লড়তে হবে তাবৎ চিকিৎসক সমাজকেই।

soma mukhopadhyay cancer sujit basu parthasarathi dasgupta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy