Advertisement
E-Paper

ডাক্তারদের সালিশি সেল আঁতুড়েই কাঠগড়ায়

সম্পত্তি বা পারিবারিক বিবাদ, প্রণয়-বিসংবাদ ইত্যাদির পরে এ বার চিকিৎসা-বিভ্রাটের ঘটনাতেও ঢুকে পড়ছে সালিশি ব্যবস্থা! যদিও সালিশির কোনও আইনি বৈধতা নেই। চিকিৎসা-বিভ্রাটের ক্ষেত্রে সালিশির উদ্যোক্তা চিকিৎসকদেরই বৃহত্তম সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)।তারা বলছে, চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ নিয়ে আর মেডিক্যাল কাউন্সিল অথবা আদালতে ছুটতে হবে না।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:১১

সম্পত্তি বা পারিবারিক বিবাদ, প্রণয়-বিসংবাদ ইত্যাদির পরে এ বার চিকিৎসা-বিভ্রাটের ঘটনাতেও ঢুকে পড়ছে সালিশি ব্যবস্থা! যদিও সালিশির কোনও আইনি বৈধতা নেই।

চিকিৎসা-বিভ্রাটের ক্ষেত্রে সালিশির উদ্যোক্তা চিকিৎসকদেরই বৃহত্তম সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)। তারা বলছে, চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ নিয়ে আর মেডিক্যাল কাউন্সিল অথবা আদালতে ছুটতে হবে না। তার আগেই ভুক্তভোগী রোগী ও তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং চিকিৎসকেরা যাতে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা মিটিয়ে নিতে পারেন, সেই ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে একটি ‘সেল’ খুলছে আইএমএ। তাদের যুক্তি, চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ মেডিক্যাল কাউন্সিল বা আদালতে পৌঁছলে নিষ্পত্তি হওয়া সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুলও। সেই জায়গায় আইএমএ-র সেলে আলোচনা এবং অর্থ-সহযোগে সমঝোতা করে দেওয়া হবে এক সপ্তাহের মধ্যেই।

প্রেম, বিয়ে এবং বিভিন্ন গ্রামীণ ঝামেলা নিয়ে পঞ্চায়েত বা মোড়লদের সালিশি নিয়ে প্রায় সব সময়েই বিতর্ক এবং আইনি প্রশ্ন ওঠে। একই ভাবে বিতর্ক ও প্রশ্নের মুখে পড়েছে আইএমএ-র এই উদ্যোগ। প্রথম প্রশ্নটাই হল, দেশে আইন-আদালত এবং বিশেষ করে চিকিৎসা-বিবাদের ক্ষেত্রে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই) থাকতে এমন সালিশি সেল কেন?

অভিযুক্ত চিকিৎসকেরা যাতে টাকা দিয়েই নিষ্কৃতি পান, সর্বোপরি তাঁদের রেজিস্ট্রেশন যাতে বাতিল না-হয়, তা নিশ্চিত করতেই আইএমএ এই ভাবে উদ্যোগী হল কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। কারণ, আইএমএ-র প্রস্তাব, ভুক্তভোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে সমঝোতা নগদ টাকার মাধ্যমেও হতে পারে। তাই অভিযোগ উঠেছে আইএমএ-র উদ্দেশ্য নিয়ে। এতে মনে হচ্ছে, সুবিচার চাওয়া রোগীর বাড়ির লোকজন টাকা পেলেই মুখ বন্ধ করে ফেলবেন। এই অবস্থায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য আইএমএ-র কর্তাদের তলব করেছে এমসিআই।

সালিশি সেলের উদ্যোক্তাদের সাফাই, সাধারণ দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলাতেও অনেক সময় আদালতের নির্দেশে অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত, দু’পক্ষের সম্মতি নিয়ে এজলাসের বাইরে মধ্যস্থতায় বসেন দু’দিকের আইনজীবীরা। অনেক সময় আবার আদালতই কোনও অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বা বিচারপতিকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ করে। চিকিৎসায় গাফিলতি সংক্রান্ত অভিযোগের নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তেমনই মধ্যস্থতার ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হয়েছে আইএমএ। দেশে প্রায় তিন লক্ষ ও পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ডাক্তার ওই সংগঠনের সদস্য।

আইএমএ-র আশ্বাস, আদালতে যাওয়ার আগেই তাদের মধ্যস্থতাকারী সেল সব কিছুর নিষ্পত্তি করে দেবে। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসায় গাফিলতির জন্য চিকিৎসকের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেন রোগী বা তাঁর পরিবার। সে-ক্ষেত্রে কত টাকা দিয়ে বিষয়টি মেটানো যেতে পারে, দরদস্তুর করে আইএমএ-র মধ্যস্থতাকারী সেলের সদস্যেরা গ্রহণযোগ্য একটা অঙ্ক ঠিক করে দেবেন। টাকা দেওয়া ও নেওয়ার পরে আইএমএ-র আইনজীবীদের সাহায্যে তৈরি করা আইনি সম্মতিপত্রে অভিযোক্তা ও অভিযুক্ত সই করবেন। সেখানে টাকার অঙ্ক লেখা থাকবে এবং দু’পক্ষই লিখিত ভাবে জানাবে যে, তারা বিবাদ মিটিয়ে ফেলেছে। পরবর্তী কালে আর কোনও আইনি প্রক্রিয়ায় যাবে না।

টাকা দিয়ে মুখ বন্ধের উদ্দেশ্যটা এখানেই প্রকট হয়ে যাচ্ছে। আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া কী ভাবে এই লেনদেন বৈধ হতে পারে, উঠছে সেই প্রশ্নও।

অথচ যাবতীয় প্রশ্ন ও বিতর্কের মধ্যেই শনৈ শনৈ এগোচ্ছে আইএমএ। তারা ফলাও করে জানাচ্ছে সেল গঠন প্রক্রিয়ার কথা। দিল্লির আইএমএ ভবনে ‘মধ্যস্থতাকারী সেল’ খোলা হচ্ছে। আইএমএ-র কর্তারা জানান, তাঁরা তিন মাসের মধ্যে প্রতিটি রাজ্যে এটা খুলে ফেলবেন। সেল হবে পাঁচ সদস্যের। তাঁদের মধ্যে দু’জন চিকিৎসক এবং তিন জন অন্য পেশার। সেলের চেয়ারম্যান হবেন এক জন বর্ষীয়ান চিকিৎসক।

দেশে চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা এমসিআই কিন্তু আইএমএ-র এই উদ্যোগে স্তম্ভিত। কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন জয়শ্রী বেন মেটার প্রশ্ন, চিকিৎসায় গাফিলতির ঘটনায় আইএমএ মধ্যস্থতা করার কে? ওটা তো চিকিৎসকদের সংগঠন। তিনি বলেন, “এ তো মনে হচ্ছে, ভুক্তভোগী রোগী বা তাঁর বাড়ির লোকজনকে কোনও ভাবে বুঝিয়েসুজিয়ে বা টাকার পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে আইনের দ্বারস্থ হওয়া থেকে নিরস্ত করার চেষ্টা চলছে!”

জয়শ্রীদেবীর বক্তব্য, মেডিক্যাল কাউন্সিলের এথিক্যাল কমিটি বা নীতি সমিতিতে নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করার সুযোগ রয়েছে। তাঁর প্রশ্ন, চিকিৎসায় গাফিলতির নালিশ ঠোকা রোগী বা তাঁর আত্মজন তো দোষীর শাস্তি চাইবেন। তিনি বা তাঁরা কোনও রকম মধ্যস্থতা চাইবেন কেন?

রোগীদের অধিকার আন্দোলনে যুক্ত কুণাল সাহা, দেবপ্রিয় মল্লিকদের অভিযোগ, ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশন নম্বর বাতিল হওয়া আটকাতে এবং সমাজে তাঁদের বদনাম হওয়া রুখতেই আইএমএ এই রাস্তা নিয়েছে।

তবে জাতীয় আইএমএ-র সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণকুমার অগ্রবালের সাফাই, “আমরা তো কাউকে সেলে আসতে জোর করছি না। অনেক সময় অভিযুক্তের তেমন গলদ থাকে না। শুধু বোঝাপড়ার অভাবে সমস্যা তৈরি হয়। আমরা তাঁদের সামনাসামনি আলোচনায় বসিয়ে কী কারণে কী হয়েছে, তা-ও বুঝিয়ে দেব।” তাঁর যুক্তি, মেডিক্যাল কাউন্সিল বা আদালতে গেলে প্রচুর টাকা আর সময় খরচ হবে। সুরাহা পেতে বছরের পর বছর কেটে যাবে। বরং ঝামেলা এড়ানো যাবে ওই সেলে গেলেই।

অগ্রবালের সুরেই জাতীয় আইএমএ-র সভাপতি মার্তণ্ড পিল্লাইয়ের ব্যাখ্যা, চিকিৎসক ও রোগীর বেশির ভাগ গোলমালের কারণ হল টাকা। চিকিৎসায় গাফিলতির ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ চেয়েই অধিকাংশ মামলা হয়। মধ্যস্থতায় টাকার প্রশ্নটির সুরাহা হয়ে গেলেই পুরো সমস্যা মিটে যাবে। মেডিক্যাল কাউন্সিলের নীতি সমিতির তুলনায় সালিশি সেলকে শ্রেয় দেখানোর চেষ্টাও করছে আইএমএ। তাদের যুক্তি, মেডিক্যাল কাউন্সিলের এথিক্যাল কমিটির সদস্যেরা অনেক ক্ষেত্রে সকলেই হন চিকিৎসক। কিন্তু প্রস্তাবিত ‘মধ্যস্থতাকারী সেল’-এর পাঁচ জনের মধ্যে তিন জন সদস্যই চিকিৎসা পেশার বাইরের।

সেলের গঠন যেমনই হোক, প্রশ্ন উঠছে, আইনত আইএমএ ভবনে মধ্যস্থতাকারী সেল কি টাকার ব্যাপারে রোগী-ডাক্তার সমঝোতার ব্যবস্থা করতে পারে? অগ্রবালের জবাব, “আমাদের রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। তা ছাড়া আমরা আইনজীবীদের তৈরি সম্মতিপত্রে উভয় পক্ষকে দিয়ে সই করিয়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত রাখছি। এর মধ্যে বেআইনি তো

কিন্তু আইনি স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। এমনকী আইএমএ-র রাজ্য শাখাও বিষয়টি নিয়ে বেশ বিভ্রান্ত। সংগঠনের রাজ্য সচিব শান্তনু সেনের কথায়, “আইএমএ বড়জোর ডাক্তার ও রোগীকে মুখোমুখি বসিয়ে বোঝানোর কাজ করতে পারে। কিন্তু কে কাকে টাকা দেবে বা কত দেবে, সেই ব্যাপারে আইএমএ-র গঠনতন্ত্রে কিছু বলা আছে বলে তো শুনিনি।”

settlement meeting doctor parijat bandyopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy