Advertisement
E-Paper

পুরুষ ডাক্তারে লজ্জা, আরও জটিল কর্কট-জট

অঝোরে কাঁদছিলেন যুবকটি। গরফা থেকে পার্ক স্ট্রিট এলাকার এক বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতালে বোনকে দেখাতে এনেছিলেন। বোনের জরায়ুমুখ ক্যানসার হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালে পুরুষ চিকিত্‌সক শারীরিক পরীক্ষা করবেন জানতে পেরে যুবক মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা, পুরুষ চিকিত্‌সকের কাছে জরায়ুমুখের মতো গোপন দেহাংশ পরীক্ষা করানো চরম সম্মানহানির বিষয়। তিনি তা কিছুতেই হতে দেবেন না।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:১০

অঝোরে কাঁদছিলেন যুবকটি। গরফা থেকে পার্ক স্ট্রিট এলাকার এক বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতালে বোনকে দেখাতে এনেছিলেন। বোনের জরায়ুমুখ ক্যানসার হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালে পুরুষ চিকিত্‌সক শারীরিক পরীক্ষা করবেন জানতে পেরে যুবক মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা, পুরুষ চিকিত্‌সকের কাছে জরায়ুমুখের মতো গোপন দেহাংশ পরীক্ষা করানো চরম সম্মানহানির বিষয়। তিনি তা কিছুতেই হতে দেবেন না।

মাসখানেক আগেই এই অভিজ্ঞতা হয়েছে রক্ত তথা ক্যানসার বিশেষজ্ঞ আশিস মুখোপাধ্যায়ের। তিনি একা নন, কমবেশি সব ক্যানসার বিশেষজ্ঞরাই এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী।

দেড়শো-দু’শো বছর আগে অন্তঃপুরে প্রবেশাধিকার ছিল না পুরুষ চিকিত্‌সকদের। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকেও রোগিনীকে স্পর্শ করার বা বুকে স্টেথো বসানোর অনুমতি অনেক জায়গায় পেতেন না পুরুষ ডাক্তারেরা। সময় বদলেছে। কিন্তু চিকিত্‌সকদের অভিজ্ঞতা বলছে, এখনও অনেক আলোকপ্রাপ্ত, শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরা স্তন, জরায়ু, জরায়ুমুখ বা ডিম্বাশয়ের মতো অঙ্গের সমস্যায় পুরুষ চিকিত্‌সকের দ্বারস্থ হতে কুণ্ঠিত। ক্যানসার চিকিত্‌সকরাই জানিয়েছেন, ইতস্তত করতে গিয়ে এবং মহিলা চিকিত্‌সক খুঁজতে গিয়ে স্তন এবং জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত মহিলাদের অন্তত ২ শতাংশ চিকিত্‌সা শুরু করাতে দেরি করে ফেলেন।

ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অরমিতা সাহা বলছিলেন, শুধু গ্রামের বা নিরক্ষর মহিলারা এই দ্বিধায় ভুগছেন ভাবলে ভুল হবে। উচ্চ বা উচ্চমধ্যবিত্ত বাড়ির অনেক শিক্ষিত মহিলা স্তন বা জরায়ুমুখের সমস্যায় প্রথমেই খোঁজেন কোনও স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ। তিনিও মহিলা হলে ভাল হয়। কিন্তু অনেক সময়ে ক্যানসারের প্রাথমিক কিছু চিহ্ন বা উপসর্গ এক জন অঙ্কোলজিস্ট যত সহজে বুঝতে পারেন, এক জন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব হয় না। ফলে আসল রোগ চিহ্নিত হতেই দেরি হয়ে যায়। যে রোগ প্রথম পর্যায়ে সারানো যেত, তা পৌঁছে যায় তৃতীয় পর্যায়ে। রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা এবং বাঁচলেও ‘কোয়ালিটি লাইফ’ পাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়।

ভারতবর্ষে যত মহিলা ক্যানসার আক্রান্ত হন, তাঁদের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা সব চেয়ে বেশি। এর পরেই হল স্তন ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা। আর এই দু’টি ক্ষেত্রেই মহিলাদের একটা বড় অংশ পুরুষ অঙ্কোলজিস্টকে দেখানোর বিষয়টি এড়াতে চান। প্রবীণ অঙ্কোলজিস্ট সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “চিকিত্‌সকের লিঙ্গ নয়, চিকিত্‌সার মানের দিকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কিন্তু কোন লিঙ্গের চিকিত্‌সককে দেখাবেন তা নিয়েই বাধ্যবাধকতা তৈরি করছেন অনেক রোগী।”

সুবীরবাবু জানালেন, পাঁচ-ছয় বছর আগে তিনি যখন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ছিলেন, তখন সেখানকার ক্যানসার বিভাগে কোনও মহিলা চিকিত্‌সক ছিলেন না। সেই সময় স্তন বা জরায়ুমুখ ক্যানসারের অনেক রোগীর স্বামী কিংবা বাড়ির লোক রোগীকে পরীক্ষা করতেই বাধা দিতেন। “এক বার জরায়ুমুখ ক্যানসার আক্রান্ত এক রোগিনীর স্বামী আমাকে বলেছিলেন, দেহ পরীক্ষার দরকার নেই। কী অসুবিধা মুখে শুনে আপনি ওষুধ দিন।” স্তন ক্যানসার জয় করেছেন এমন মহিলাদের সংগঠন ‘হিতৈষিণী’ গ্রামেগঞ্জে ক্যানসার সচেতনতার কাজ করে। সংগঠনের তরফে নুপুর চক্রবর্তী বলছিলেন, অনেক জায়গায় মহিলারা এসে তাঁদের কাছেই প্রথম জরায়ুমুখ বা স্তনের কোনও সমস্যার কথা জানান যা তাঁরা সঙ্কোচে বাড়িতে স্বামীকে জানাতে পারেননি।

হয়তো বাজার-সমীক্ষায় এই প্রবণতার কথা উঠে আসায় কলকাতার একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল এখন এমন স্তন পরীক্ষা ক্লিনিক বা জরায়ুমুখ পরীক্ষা ক্লিনিক চালুর বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করেছে যেখানে শুধুমাত্র মহিলা চিকিত্‌সকেরাই থাকবেন। তালতলার এমনই এক হাসপাতালের তরফে অরিন্দম চন্দ বলছিলেন, “মেয়েরা সহজে এই ক্লিনিকে লজ্জা কাটিয়ে দেহ পরীক্ষা করাতে পারবেন। সমস্যা ব্যাখ্যা করতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। এতে দ্রুত রোগ ধরা পড়বে।”

সমাজতত্ত্ববিদ রুচিরা ঘোষ জানান, কলকাতার ওই নামীদামি হাসপাতালে একেবারে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা আসেন না। অর্থাত্‌ বোঝা যাচ্ছে, সম্পন্ন, শিক্ষিত পরিবারেও মেয়েদের শারীরিক সমস্যায় মহিলা ডাক্তার দেখানোর ঝোঁক রয়েছে। তাঁরা ওই ‘প্রাইভেসি’টা চাইছেন। রুচিরার কথায়, “এ যুগেও চিকিত্‌সকের ক্ষেত্রে লিঙ্গবোধ তাঁরা ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না। হয়তো চিকিত্‌সক রোগিনীর শ্লীলতাহানি করেছেন, এই রকম খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশিত হওয়ায় মহিলাদের একাংশ আরও স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছেন।”

অঙ্কোলজিস্ট অর্ণব গুপ্তের হাসপাতালে এই মুহূর্তে বাঁকুড়ার এক মহিলা ভর্তি রয়েছেন। স্তন ক্যানসার, তৃতীয় পর্যায়। হাসপাতালে পুরুষ ডাক্তারদের কাছে স্তন পরীক্ষা করাতে হবে শুনেই পাড়ার এক মহিলা হাতুড়ে চিকিত্‌সকের জড়িবুটির উপর ভরসা করে চুপচাপ বসেছিলেন তিনি। তাতেই ক্যানসার ছড়িয়ে যায়। অঙ্কোলজিস্ট গৌতম মুখোপাধ্যায়ও জানাচ্ছিলেন, আগের তুলনায় মেয়েদের এই জড়তা কিছুটা কাটলেও পুরোপুরি যায়নি। তিনি বলেন, “আমরা সাধারণত স্তন বা জরায়ুমুখ পরীক্ষার সময়ে মহিলা অ্যাটেন্ডেন্ট সঙ্গে রাখি বা রোগিনীর সঙ্গীকে ঘরে ডেকে নিই। তা সত্ত্বেও অল্পবয়সী, অবিবাহিত মেয়েদের একাংশ এবং বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর মহিলাদের মধ্যে পুরুষ চিকিত্‌সকদের নিয়ে ‘ইনহিবিশন’ রয়েছে। এমনকী একই কারণে পুরুষ চিকিত্‌সক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে ক্যানসার প্রতিরোধে প্যাপ স্মেয়ার বা ম্যামোগ্রাফির মতো জরুরি পরীক্ষাও তাঁরা এড়িয়ে যান।”

cancer male doctor parijat bandyopadhyay world cancer day
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy