Advertisement
E-Paper

রোগী দেখা থেকে সেলাই, ভরসা ফার্মাসিস্টই

সপ্তাহে তিন দিন চিকিত্‌সকের চেয়ার খালি থাকে। দেড় বছর ধরে নেই নার্স, সাফাইকর্মী এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সব সময়ের কর্মী বলতে রয়েছেন শুধু ফার্মাসিস্ট। আর তাই রোগীদের কাটাছেঁড়ায় সেলাই করা বা ক্ষতে গজ-ব্যান্ডেজ বাঁধা থেকে শুরু কেরেরাগ পরীক্ষা করে ওষুধ দেওয়া সবই একা হাতে করতে হচ্ছে ওই ফার্মাসিস্টকে।

দেবব্রত দাস

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৪ ০২:২৬
বারিকুল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগী দেখছেন ফার্মাসিস্ট।—নিজস্ব চিত্র।

বারিকুল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগী দেখছেন ফার্মাসিস্ট।—নিজস্ব চিত্র।

সপ্তাহে তিন দিন চিকিত্‌সকের চেয়ার খালি থাকে। দেড় বছর ধরে নেই নার্স, সাফাইকর্মী এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সব সময়ের কর্মী বলতে রয়েছেন শুধু ফার্মাসিস্ট। আর তাই রোগীদের কাটাছেঁড়ায় সেলাই করা বা ক্ষতে গজ-ব্যান্ডেজ বাঁধা থেকে শুরু কেরেরাগ পরীক্ষা করে ওষুধ দেওয়া সবই একা হাতে করতে হচ্ছে ওই ফার্মাসিস্টকে।

গত তিন মাস ধরে এ ভাবেই চলছে বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের বারিকুল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কর্মী-সঙ্কটের জেরে চরম বেহাল অবস্থা রানিবাঁধ ব্লকের এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের। নিরুপায় হয়ে এক দিকে নার্সের কাজ, অন্য দিকে ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে রোগী দেখার গুরু দায়িত্ব একাই সামলাচ্ছেন ফার্মাসিস্ট নন্দদুলাল মণ্ডল। জঙ্গলমহলের গবিবগুর্বো মানুষের কাছে এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। দেড় বছর ধরে প্রথমে নার্সহীন অবস্থায় এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র চলছে। তার উপরে গত তিন মাস ধরে সপ্তাহে তিন দিন করে ডাক্তার আসছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। বাকি তিন দিন তাই বাধ্য হয়ে রোগী দেখতে হচ্ছে ফার্মাসিস্টকে।

রানিবাঁধ ব্লক সদর থেকে প্রায় ১৬ কিমি দূরে বারিকুল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকন্দ্র। খাতড়া মহকুমা হাসপাতাল থেকে দূরত্ব ৩২ কিমি, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সীমানা ঘেঁষা জঙ্গলমহলের এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরে নির্ভরশীল ৩০টি গ্রামের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বারিকুল, খেজুরখেন্ন্যা, পূর্ণাপানি, ছেন্দাপাথর, মাজগেড়িয়া, সাতনালা, সারেংসোগড়া, বুচিবুড়ি, ডুবুখানা, লেপাম, ধজুড়ি-সহ আশপাশের বহু গ্রামের বাসিন্দা প্রাথমিক চিকিত্‌সার জন্য এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ছুটে আসেন।

জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নার্স নেই, নেই চতুর্থ শ্রেণির কর্মী বা সাফাইকর্মী। মে মাসে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিত্‌সক বিদ্যুত্‌বিকাশ মণ্ডলকে রানিবাঁধ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানো হয়। খেজুরিয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিত্‌সক অসীম মুখোপাধ্যায়কে সপ্তাহে তিন দিন বারিকুল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডিউটি দেওয়া হয়েছে। মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিবার অসীমবাবু এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে রোগী দেখেন।

সম্প্রতি বারিকুল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, ডাক্তারের চেয়ার ফাঁকা, চেম্বারের ভিতরে রোগীদের লম্বা লাইন। ফার্মাসিস্ট নন্দদুলালবাবু রোগী দেখছেন, ওষুধ দিচ্ছেন, ক্ষতস্থান সেলাই করেও দিচ্ছেন তিনিই। রতনপুর গ্রামের বাসিন্দা মিঠু কর্মকার তিন বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছিলেন। জ্বর, সর্দি কাশি, ব্যথা নিয়ে খেজুরখেন্ন্যার বধূ বাসন্তী পাল, নীলিমা পাল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছিলেন ডাক্তার দেখাতে। তাঁদের রোগ দেখে ওষুধ লেখার পর নিজেই ওষুধ দিলেন ফার্মাসিস্ট। মিঠুদেবীর কথায়, “রানিবাঁধ ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এখান থেকে অনেকটা দূরে। তাই কাছে ভেবে এখানে এসেছিলাম। কিন্তু ডাক্তার না থাকায় বাধ্য হয়ে ফার্মাসিস্টকে দেখালাম।” জ্বর, গা বমি ভাব নিয়ে এসেছিলেন লেপাম গ্রামের জয়ন্ত সর্দার, বুচিবুড়ি গ্রামের রোহিণী মান্ডি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যে ডাক্তার প্রতিদিন থাকেন না, তা তাঁরা জানতেন। তাঁরা বলেন, “দিনক্ষণ দেখে তো কারও রোগ হয় না! অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দেখাতে এসেছি। ফার্মাসিস্ট থাকায় তাঁকেই দেখালাম।”

সোম থেকে শনিবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা থাকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ, এত দিন ধরে নার্স নেই, প্রায়দিনই চিকিত্‌সক থাকেন না। ফার্মাসিস্ট রোগী দেখে ওষুধ দিচ্ছেন, তা-ও দুপুর পর্যন্ত। রাতবিরেতে কিছু হলে রোগীকে নিয়ে রানিবাঁধে ছুটতে হয়। এলাকার বাসিন্দা তথা বারিকুল পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান, তৃণমূলের অনিমা হাঁসদাও বলেন, “জঙ্গলমহলের বড় অংশের মানুষ চিকিত্‌সার জন্য এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরে নির্ভরশীল। সেখানে এতদিন ধরে নার্স নেই, প্রতিদিন ডাক্তার থাকেন না। স্বাস্থ্য দফতরের কাছে আমরা অবিলম্বে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্থায়ী চিকিত্‌সক, নার্স ও সাফাইকর্মী নিয়োগের দাবি জানিয়েছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।”

চিকিত্‌সক অসীম মুখোপাধ্যায় বলেন, “একসঙ্গে দু’টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দায়িত্বে রয়েছি। ফলে, দু’টি জায়গায় সপ্তাহে তিন দিন করে ডিউটি করি। এক্ষেত্রে সকলেরই অসুবিধা হচ্ছে। তবু আমি নিরুপায়।” ফার্মাসিস্ট নন্দদুলালবাবু অবশ্য দাবি করেন, “দেড় বছর আগে দুই নার্স স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বদলি হয়ে গিয়েছেন। তার পর থেকে নতুন করে কোনও নার্সকে নিয়োগ করা হয়নি। অথচ রোগীরা আসছেন। তাই তাঁদেরকে ফিরিয়ে না দিয়ে আমিই দেখছি। নার্সের কাজও করছি। সাধ্যমতো সবাইকে পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।” তাঁর ক্ষোভ, সব কিছু সামলাতে হচ্ছে। রোগীদের কিছু হলে, দোষ তাঁ ঘাড়েই পড়বে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, সাফাইকর্মী না থাকায় প্রচণ্ড অসুবিধা হচ্ছে বলেও তিনি জানান। স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বর পরিষ্কার রাখতে স্থানীয় এক জনকে অস্থায়ী ভাবে মাসিক এক হাজার টাকার বিনিময়ে রাখা হয়েছে।

রানিবাঁধের ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক উদয়ন মহান্তি বলেন, “ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৬ জন চিকিত্‌সক থাকার কথা। কিন্তু, মাত্র তিন জন রয়েছেন। ১৫ জন নার্সের মধ্যে ৬ জন আছেন। এই অবস্থায় এক জন ডাক্তারকেই বারিকুল ও খেজুরিয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডিউটি দেওয়া হয়েছে।”

pharmcist primary health centre debabrata das barikul
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy