Advertisement
E-Paper

রোগীর চাপে রুগ্ণ নবদ্বীপ হাসপাতাল

ঘটনা ১: মামার বাড়ি এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বছর দুয়েকের ছোট্ট কথা। প্রবল জ্বরে আক্রান্ত মেয়েকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারের কাছে ছুটেছিলেন বাড়ির লোকজন। কিন্তু রবিবারের মধ্য রাতে নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন যে, হাসপাতালের তিন জন শিশু বিশেষজ্ঞই ছুটিতে আছেন। সারারাত শহরের কোথাও কোনও শিশু বিশেষজ্ঞকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত পরিচিত এক স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শে ওষুধ খাইয়ে অবস্থা সামাল দেওয়া গিয়েছিল। কথার বাড়ির লোকেদের একটাই প্রশ্ন- তিন জন শিশু বিশেষজ্ঞের ছুটি কী করে একসঙ্গে মঞ্জুর করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ?

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৪ ০১:৪০

ঘটনা ১: মামার বাড়ি এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বছর দুয়েকের ছোট্ট কথা। প্রবল জ্বরে আক্রান্ত মেয়েকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারের কাছে ছুটেছিলেন বাড়ির লোকজন। কিন্তু রবিবারের মধ্য রাতে নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন যে, হাসপাতালের তিন জন শিশু বিশেষজ্ঞই ছুটিতে আছেন। সারারাত শহরের কোথাও কোনও শিশু বিশেষজ্ঞকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত পরিচিত এক স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শে ওষুধ খাইয়ে অবস্থা সামাল দেওয়া গিয়েছিল। কথার বাড়ির লোকেদের একটাই প্রশ্ন- তিন জন শিশু বিশেষজ্ঞের ছুটি কী করে একসঙ্গে মঞ্জুর করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ?

ঘটনা ২: দিন কয়েক আগে অসুস্থ শ্বশুরমশাইকে নিয়ে বিপদে পড়েছিলেন নবদ্বীপ আদালতের নন্দলাল শর্মা। বুকে তীব্র যন্ত্রণা হওয়ায় দেরি না করে তাঁকে নিয়ে সোজা নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে গিয়েছিলেন নন্দলালবাবু। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারেন যে, হাসপাতালে সেদিন কোনও এমডি (মেডিসিন) নেই। রোগী, মধ্য ষাটের গোবিন্দ সাহার শারীরিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকায় বাধ্য হয়ে জরুরি বিভাগে দেখিয়ে সাধারণ মেডিক্যাল অফিসারের তত্ত্বাবধানেই তাঁকে ভর্তি করানো হয়। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পরে দেখা মিলেছিল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের। নন্দলালবাবু বলছেন, “ওই সময় যে কী অসহায় লাগছিল তা মুখে বলে বোঝানো যাবে না। এত বড় হাসপাতাল, এত রোগীর ভিড় অথচ কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। যে কোনও সময়ে একটা অঘটন কিছু ঘটে যেতেই পারে। কিন্তু এই বিষয়ে কারও কোনও হেলদোল নেই।

ঘটনা ৩: বার্ধক্যজনিত সমস্যা নিয়ে নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ৭০ বছরের গৌর চক্রবর্তীকে ভর্তি করিয়েছিলেন তাঁর শিষ্যরা। কিন্তু গৌরবাবুর জন্য জেলা ব্ল্যাড ব্যাঙ্কে রক্ত আনতে গিয়ে অদ্ভুত সমস্যায় পড়েন তাঁর শিষ্যরা। ব্ল্যাডব্যঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানান, রিক্যুইজিশন স্লিপে লেখা রক্তের গ্রুপ এবং রোগীর রক্তের গ্রুপ মিলছে না। শুনে তাজ্জব হয়ে যান সকলে। এটা কি করে হল? কোন গ্রুপের রক্ত প্রকৃতপক্ষে লাগবে তা ফের নবদ্বীপ হাসপাতাল থেকে ঠিক করিয়ে আনতে বলেন ব্ল্যাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। আবার নবদ্বীপ হাসপাতালে ফিরে আসেন শিষ্যরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গোলমালের আঁচ পেয়ে ওই রিক্যুইজিশন স্লিপ হাতিয়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেন। নতুন করে কাগজপত্র তৈরি হওয়ার পর ফের ব্লাডব্যাঙ্কে গিয়ে রক্ত আনতে হয়। অভিযোগ, দ্বিতীয় বার আনা সেই রক্ত হাসপাতালে সন্ধ্যা সাতটার সময় পৌঁছলেও গৌরবাবুকে সেই রক্ত দিতে রাত একটা বেজে যায়। শুধু তাই নয়, পরদিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গৌরবাবু অভিযোগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জানতে পেরে সাত সকালেই তাঁকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।

নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে এমন চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। যাঁরা চিকিৎসার প্রয়োজনে নবদ্বীপ হাসপাতালে আসা যাওয়া করেন তাঁদের কাছে এমন ঘটনা কিন্তু নতুন নয়। নবদ্বীপ এবং বর্ধমানের বিস্তীর্ণ এলাকার কয়েক লক্ষ মানুষের চিকিৎসার অন্যতম ভরসা এই হাসপাতাল। অথচ এলাকায় একমাত্র বড় হাসপাতাল হওয়া স্বত্ত্বেও নবদ্বীপ হাসপাতাল এখন নিজেই মুমূর্ষু। বর্ধমানের কালনা থেকে কাটোয়া এবং নদিয়ার কৃষ্ণনগর থেকে কল্যাণীর মধ্যবর্তী বিরাট অঞ্চলের কয়েক লক্ষ মানুষ নির্ভর করেন এই হাসপাতালের উপরে। যদিও চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্যকর্মী, পরিকাঠামো থেকে ওষুধ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধুঁকছে নবদ্বীপ হাসপাতাল। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক থেকে ব্লাডব্যাঙ্ক, আইসিসিইউ থেকে বার্ন ইউনিট, অ্যানাসথেটিস্ট থেকে এক্সরে প্লেটনেই এর তালিকাটা ক্রমে যেন বেড়েই চলেছে। হাসপাতালে আসা রোগীদের অভিযোগ, জ্বর, সর্দি কিংবা পেটের গোলমালের মতো সাধারণ অসুখ-বিসুখ ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রেই রেফার করে দেওয়াটা এই হাসপাতালে এখন রোজনামচা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যত্র রেফার করার এই প্রবণতা দেখে নবদ্বীপকে স্টেট জেনারেল নয়, স্টেট রেফারেল হাসপাতাল বলেও ব্যাঙ্গ করেন অনেকে।

১২৫ শয্যার এই হাসপাতালে সবসময় একটি শয্যায় একাধিক রোগী থাকেন। অথচ রোগীর চাপের নিরিখে হিসেব করতে গেলে নবদ্বীপ স্টেট জেনারেলের স্থান শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের পরেই। শুধু চিকিৎসকের ঘাটতিই নয়, নবদ্বীপ হাসপাতালে স্থায়ী কোনও কোন স্থায়ী সুপারও নেই। সম্প্রতি হাসপাতালের মেডিসিনের চিকিৎসক উৎপল কুমারও বদলি হয়ে যাচ্ছেন। তিনি চলে গেলে মাত্র একজন মেডিসিনের চিকিৎসক ও তিন জন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ কীভাবে সামলাবেন এই বিপুল রোগীর চাপ তা নিয়ে দিশেহারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার আশিস রঞ্জন কুঁয়ার বলেন, “এক সময়ে এখানে মোট চার জন মেডিসিনের চিকিৎসক ছিলেন। কমতে কমতে এখন এই অবস্থা। গত সপ্তাহেই উৎপল কুমারকে রিলিজ করে দিতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে তিনজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সপ্তাহে তিন দিন রাতে হাসপাতাল সামলাচ্ছেন ওঁরাই। উৎপলবাবু চলে যাচ্ছেন কিন্তু তাঁর পরিবর্তে এখনও পর্যন্ত কাউকে পাঠানো হয়নি। ফলে হাসপাতালটা তো চালাতে হবে।”

আশিসবাবু বলেন, “এত বেশি কাজ এত কম লোক দিয়ে করাতে গিয়ে কখনও ভুল-ভ্রান্তি হয়ে যায়। তাছাড়া নবদ্বীপ রাজ্যের একমাত্র স্টেট জেনারেল হাসপাতাল যেখানে ২৪ ঘণ্টা ‘অন কল’ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। অথচ সেই পরিষেবা দেওয়ার মত পরিকাঠামো নেই। হাসপাতালে সার্জেন, ফিজিশিয়ান এবং প্যাথোলজিস্টের পদও ফাঁকা। এই অবস্থায় বাধ্য হয়ে আমাদের রেফার করা ছাড়া কিছু করার থাকে না।”

debashish bandopadhyay nabadwip patient overload at nabadwip hospital
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy