Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সাগর দত্তে অ্যাম্বুল্যান্স চলারও পথ নেই, বিরক্ত এমসিআই

রক্তে ভেসে যাচ্ছিল বছর পঁচিশের তরুণীর শরীর। আচমকাই বাড়িতে পা পিছলে পড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয় ওই আসন্নপ্রসবার। অ্যাম্বুল্যান্সে চড়িয়ে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে এলেন বাড়ির লোকজন। কিন্তু হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে পৌঁছবেন কী করে? সেই পর্যন্ত তো কোনও গাড়ি চলার রাস্তাই নেই। এবড়ো-খেবড়ো পাথর ছড়ানো রাস্তা, পুকুরের উপরে ছোট কাঠের সাঁকো পেরিয়ে তরুণীকে পাঁজাকোলা করে ছুটতে হল বাড়ির লোককে।

সাগর দত্তে আনা হচ্ছে এক রোগিণীকে। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

সাগর দত্তে আনা হচ্ছে এক রোগিণীকে। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৪ ০২:২৩
Share: Save:

রক্তে ভেসে যাচ্ছিল বছর পঁচিশের তরুণীর শরীর। আচমকাই বাড়িতে পা পিছলে পড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয় ওই আসন্নপ্রসবার। অ্যাম্বুল্যান্সে চড়িয়ে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে এলেন বাড়ির লোকজন। কিন্তু হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে পৌঁছবেন কী করে? সেই পর্যন্ত তো কোনও গাড়ি চলার রাস্তাই নেই। এবড়ো-খেবড়ো পাথর ছড়ানো রাস্তা, পুকুরের উপরে ছোট কাঠের সাঁকো পেরিয়ে তরুণীকে পাঁজাকোলা করে ছুটতে হল বাড়ির লোককে। কারণ ওই হাসপাতালে ওটাই দস্তুর। কোনও প্রত্যন্ত গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্র নয়। কলকাতার সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের ছবি। যেটিকে রাজ্যের সেরা মেডিক্যাল কলেজ হিসেবে তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর স্বাস্থ্য দফতর।

মঙ্গলবার সকালে ওই এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা ধরে ছুটতে গিয়ে পড়ে যান টুম্পা মণ্ডল নামে ওই তরুণীর স্বামী অশোক মণ্ডল। তাঁর মাথা ফেটে গিয়েছে। এই অবস্থায় আর কোনও ঝুঁকি না নিয়ে দু’জনকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান বাড়ির লোকেরা। তাঁদের বক্তব্য, যে হাসপাতালে রোগীকে দেখাতে এসে এমন হয়রান হতে হয়, সেখানে তাঁরা ফের ভরসা করবেন কী করে?

ঘটনাচক্রে ওই দিনই ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’ (এমসিআই)-র প্রতিনিধিরা কলেজ পরিদর্শনে আসেন। হাসপাতালের পরিকাঠামো সংক্রান্ত সমস্যার কথা লিখতে গিয়ে এর আগের রিপোর্টেই রাস্তার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল এমসিআই। এ দিনের দুর্ঘটনার কথা এমসিআই প্রতিনিধিদেরও কানে গিয়েছে। কী করে একটা মেডিক্যাল কলেজে অ্যাম্বুল্যান্স চলার রাস্তাও না থাকতে পারে, তা নিয়ে ফের প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।

কেন নেই রাস্তা? হাসপাতাল সূত্রের খবর, গত কয়েক বছর ধরে এ ব্যাপারে বারবার কেএমডিএ-কর্তাদের কাছে দরবার করেছেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ দেবাশিস ভট্টাচার্য অবশ্য বলেন, “রাস্তা তৈরির কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। কেএমডিএ-র সঙ্গে আমাদের কথা হয়ে গিয়েছে। মূল গেট থেকে ৭০০ মিটার পর্যন্ত রাস্তা তারা করে দেবে। বাকি রাস্তার ব্যবস্থা করবে হাসপাতাল নির্মাণের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদার সংস্থা।”

কেন এত দিন সেই কাজ করেনি কেএমডিএ? সংস্থার এক কর্তা বলেন, “এর আগে দু’বার দরপত্র ডাকা হয়েছিল। কিন্তু সে ভাবে সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই তৃতীয় বার দরপত্র ডাকতে চলেছি। আশা করি, এ বার সব কিছু ঠিকঠাকই হবে।”

কিছু দিন আগেই আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক আত্মীয়াকে ভর্তি করতে এসে ভাঙা ট্রলিতে হাত কেটে গিয়েছিল এক যুবকের। তাঁর হাতে সাতটি সেলাই করতে হয়েছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া লিখিত অভিযোগে ওই যুবকের প্রশ্ন ছিল, কেন ন্যূনতম পরিকাঠামোও পাবেন না সাধারণ মানুষ? যথারীতি ওই প্রশ্নের কোনও জবাব কর্তৃপক্ষ দিতে পারেননি। এ দিন সাগর দত্ত মেডিক্যালের প্রশ্নটা আরও কড়া। হাসপাতালের গেট থেকে চিকিত্‌সকের কাছে পৌঁছতেই কেন নাভিশ্বাস উঠবে রোগীদের? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “একটা সাধারণ হাসপাতালকে মেডিক্যাল কলেজ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অনেক ধাপ পেরোতে হয়। সেই কারণেই সময় লাগছে। রাস্তা না থাকার বিষয়টি আমরা জানি। মাস কয়েকের মধ্যেই ব্যাপারটার সুরাহা হবে।”

সাগর দত্তের শিক্ষক-চিকিত্‌সকেরা জানান, ধাপে ধাপে পরিকাঠামোর দিক থেকে উন্নত হচ্ছে ওই কলেজ। দামি সরঞ্জাম এসেছে। অভিজ্ঞ চিকিত্‌সকেরা রয়েছেন। তৈরি হচ্ছে নতুন ভবন। কিন্তু একেবারে গোড়ার কিছু বিষয়ে স্বাস্থ্য দফতরের অবহেলা এই কলেজকে এখনও পিছনের সারিতেই রাখছে।

ক্ষমতায় আসার পরে পাঁচ বছরে রাজ্যে নতুন ১০টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তৃণমূল সরকার। মানের কথা ভুলে সংখ্যার দৌড়ে এগিয়ে থাকতে গেলে পরিণতি যে কী হয়, সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের মতো ঘটনা বারবার তা প্রমাণ করছে, আক্ষেপ স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE