Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সুরাহা নাগালেই, তবু হাত বাড়াতে গড়িমসি

নাক ডাকিয়ে ঘুমের মধ্যে নিশ্চিন্তির কিছু নেই, বরং তা মহা বিপদেরই সঙ্কেত। অথচ এ নিয়ে ভাবেন ক’জন? আজ বিশ্ব ঘুম দিবসের প্রাক্কালে সতর্ক করল আনন্দবাজার।শুরু হয়েছিল যখন, বয়স কুড়িও পেরোয়নি! গা-ও করেননি। ফি রাতে ঘুমের মধ্যে নাক ডাকিয়ে আরও বছর আষ্টেক কাটিয়ে দিয়েছিলেন ব্যারাকপুরের পিনাকী সরকার। এর মধ্যে ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছেন। মাস কয়েক আগে বিয়েও করেছেন। স্ত্রী-ই লক্ষ্য করলেন, ঘুমের সময়ে প্রবল নাসিকাগর্জনের সঙ্গে প্রতি দশ-পনেরো মিনিট অন্তর শ্বাস বন্ধ হয়ে বিছানায় উঠে বসছেন তাঁর স্বামী!

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৪ ০৩:১৭
Share: Save:

শুরু হয়েছিল যখন, বয়স কুড়িও পেরোয়নি!

গা-ও করেননি। ফি রাতে ঘুমের মধ্যে নাক ডাকিয়ে আরও বছর আষ্টেক কাটিয়ে দিয়েছিলেন ব্যারাকপুরের পিনাকী সরকার। এর মধ্যে ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছেন। মাস কয়েক আগে বিয়েও করেছেন। স্ত্রী-ই লক্ষ্য করলেন, ঘুমের সময়ে প্রবল নাসিকাগর্জনের সঙ্গে প্রতি দশ-পনেরো মিনিট অন্তর শ্বাস বন্ধ হয়ে বিছানায় উঠে বসছেন তাঁর স্বামী! ঘেমে-নেয়ে বিধ্বস্ত হয়ে!

মহিলা দেরি করেননি। স্ত্রীর তাড়নাতেই পিনাকীবাবু ডাক্তারের চেম্বারে যান। এবং জানতে পারেন, তিনি বাড়াবাড়ি রকমের ‘স্লিপ অ্যাপনিয়া’য় আক্রান্ত। শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ায় ঘুমের মধ্যে গলায় মাংসপেশি শিথিল হয়ে বাধার সৃষ্টি করছে তাঁর শ্বাসনালিতে। গলার ভিতরে বাড়তি মেদ জমেও বিপত্তি ঘটিয়েছে। বায়ু চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ঘুমন্ত শরীরে কমছে অক্সিজেনের মাত্রা। বেহালার সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের একই হাল। বছর তিরিশ আগে ফুটবল খেলতে গিয়ে নাকের হাড় ভেঙেছিল। ২০০৯-১০ নাগাদ ওজন অনেকটা বেড়ে যায়। শুরু হয় ঘুমের সময়ে নাক ডাকা, আর মাঝে মাঝে দম আটকে জেগে ওঠা। বাধ্য হয়ে তিনিও ডাক্তার দেখিয়েছেন। জানতে পেরেছেন, কী বিপজ্জনক রোগ নিয়ে ঘর করছেন!

দেরিতে হলেও ডাক্তারদের পরামর্শ মেনে ও ওষুধপত্র খেয়ে পিনাকীবাবু-সুদীপ্তবাবুর মতো অনেকে এখন অনেক সুস্থ। ঘুমের মধ্যে শরীরে অক্সিজেন কমে গিয়ে ‘সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ বা আকস্মিক হৃদ্রোগে মৃত্যুর আশঙ্কাকে ওঁরা পাশ কাটাতে সক্ষম হয়েছেন। ইএনটি ও বক্ষ বিশেষজ্ঞদের (চেস্ট স্পেশ্যালিস্ট) চেম্বারে ইদানীং দৈনিক গড়ে তিন-চার জন স্লিপ অ্যাপনিয়া’র রোগী আসছেন। যদিও একে যথেষ্ট মনে করছে না চিকিৎসক মহল। তাদের দাবি, রোগীর সংখ্যাটা আসলে বহু-বহু গুণ বেশি। রোগ চিহ্নিত হওয়ার আগে অনেকের মৃত্যুও হচ্ছে। এমনকী, ওবেসিটি (অতিরিক্ত স্থূলতা)-তে ভোগা শিশুরাও সহজে এর শিকার হতে পারে।

তাই যত দ্রুত সম্ভব, স্লিপ অ্যাপনিয়া নিয়ে সার্বিক সচেতনতাবৃদ্ধির উপরে ডাক্তারেরা জোর দিচ্ছেন। ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া’-র বক্তব্য, এ বিষয়ে চিকিৎসকদেরও ঠিকঠাক ওয়াকিবহাল হওয়া জরুরি। কারণ, ঘুমের মধ্যে এই সব অসুবিধে দেখা দিলে অনেকেই প্রথমে ইএনটি’র কাছে না-গিয়ে মেডিসিন, কার্ডিওলজি বা চেস্ট স্পেশ্যালিস্টের কাছে ছোটেন। কাজেই রোগ নির্ণয়ের প্রাথমিক দায়িত্বটা ওই সব চিকিৎসকের উপরে এসে বর্তায়। কী ভাবে আসল রোগটা ধরা যেতে পারে?

অ্যসোসিয়েশনের তরফে জানানো হচ্ছে, প্রথমে দেখতে হবে, ঘুমের মধ্যে বা সকালে ঘুম ভাঙার পরে রোগীর রক্তচাপ বাড়ছে কিনা। ঘুমন্ত অবস্থায় হৃৎস্পন্দনে ছন্দপতন যাচাই করতে হবে। অতিরিক্ত ওজন বা ডায়াবেটিস থাকলে সেটাও খেয়াল করতে হবে।

প্রাথমিক ভাবে স্লিপ অ্যাপনিয়া নির্ণয়ের লক্ষণ এগুলোই। অ্যাসোসিয়েশনের রিজিওন্যাল কো-অর্ডিনেটর ইএনটি চিকিৎসক দীপঙ্কর দত্ত জানিয়েছেন, স্লিপ অ্যাপনিয়ার মাত্রা মাপতে কলকাতায় বেশ ক’টা স্লিপ ক্লিনিক চালু হয়েছে। সেখানে রাতে রোগীকে বিশেষ উপায়ে ঘুম পাড়িয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। সমস্যা হল, অনেকেই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র ঘুমোতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। এঁদের জন্যই এখন বাড়িতে পলিসমনোগ্রাফি যন্ত্র লাগিয়ে আসা হয়। রোগী ঘুমানোর সময় তাঁর শারীরিক নানাবিধ অবস্থা তাতে লিপিবদ্ধ হয়। দম আটকে কত বার জেগে উঠলেন, তা-ও বোঝা যায়।

পাশাপাশি দশ-পনেরো মিনিটের জন্য অপারেশন থিয়েটার ভাড়া নিয়ে রোগীকে অ্যানাস্থেশিয়া করে এন্ডোস্কোপি করা হয়। তাতে বোঝা যায়, ঘুমের মধ্যে জিভ, টাকরা বা টনসিল শিথিল হয়ে শ্বাসনালির ঠিক কোথায় বাধা তৈরি করছে। সেই অনুযায়ী পরে অপারেশন করা যেতে পারে, কিংবা কবলেশন যন্ত্র দিয়ে গলার টিস্যুগুলোর শৈথিল্য দূর করা হতে পারে। যদিও ডাক্তারদের অনেকের মতে, এটা স্থায়ী সমাধান নয়। অস্ত্রোপচারের পরেও টিস্যু আবার আলগা হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

অনেক ক্ষেত্রে আবার স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগীকে ‘সি-প্যাপ’ যন্ত্র দেওয়া হয়। মুখোশাকৃতি যন্ত্রটি ঘুমের সময় নাকে লাগিয়ে শুতে হয়। তা শ্বাসনালীর বাধা কাটিয়ে শরীরে অক্সিজেন প্রবেশে সাহায্য করে। চিকিৎসকদের একাংশ অবশ্য এই পদ্ধতির বিরোধী। তাঁদের দাবি, এটা সাময়িক নিষ্কৃতি মাত্র। দিনের পর দিন যন্ত্র মুখে দিয়ে কেউ ঘুমোতে পারেন না। অনেকে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

তা হলে সুরাহা কী?

বক্ষ বিশেষজ্ঞ অরূপ হালদারের জবাব, “জীবনযাত্রায় সদর্থক পরিবর্তনই হল রোগ নিরাময়ের স্থায়ী ও ফলপ্রসূ উপায়। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, ওজন কমাতে হবে। ঠিক সময়ে খেতে হবে, ঠিক সময়ে ঘুমোতে হবে। ধূমপান-মদ্যপান এড়িয়ে চলতে হবে।” অরূপবাবুর এ-ও হুঁশিয়ারি, “স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকলে ঘুমের ওষুধ কিন্তু একেবারে চলবে না। কারণ, ঘুমের ওষুধ বা মদের মতো জিনিসে পেশি আরও শিথিল হয়ে যায়। শ্বাসনালিতে বাধা বাড়ে।” আরও একটা সাধারণ ভুল ডাক্তারেরা ভাঙিয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, শুধুমাত্র মোটা লোকেরাই স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ভুগবেন, এমনটা ভাবার কারণ নেই। রোগা-পাতলা নারী-পুরষও এর পাল্লায় পড়তে পারেন।

অর্থাৎ, মূলমন্ত্র একটাই। স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার দৌলতে সহজ শ্বাস-প্রশ্বাস। নিভৃতের নিদ্রাকে নিরাপদ রাখতে তাই সচেতনতার দাওয়াইয়েই সবচেয়ে ভরসা রাখছেন চিকিৎসকেরা।

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

snoring health parijat bandyopadhyay sleep apnea
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE