Advertisement
E-Paper

বাংলা ছবির রোম্যান্টিক জুটি

উত্তমকুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মান্না দে-র রসায়ন। লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীআগে মান্নাদার বেসিক গান নিয়ে বলেছি। লিখতে লিখতে অবাক হয়েছি। এক মলাটের মধ্যে কত যে অধ্যায়। বেসিক গানের পাশাপাশি মান্নাদাকে যখন দেখছি প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসাবে, তখনও আশ্চর্য হওয়ার পালা। এমন অ্যাক্টর সিঙ্গার বিরল।

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:৩০

আগে মান্নাদার বেসিক গান নিয়ে বলেছি। লিখতে লিখতে অবাক হয়েছি। এক মলাটের মধ্যে কত যে অধ্যায়। বেসিক গানের পাশাপাশি মান্নাদাকে যখন দেখছি প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসাবে, তখনও আশ্চর্য হওয়ার পালা। এমন অ্যাক্টর সিঙ্গার বিরল। মান্নাদার প্রথম প্লে-ব্যাক ১৯৫২ সালে ‘অমর ভূপালি’ ছবিতে। শুরুটা একটু থমকে থমকে। তখনও মান্নাদা কোনও বাংলা বেসিক গান রেকর্ড করেননি। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতে বাংলা সিনেমা মান্নাদার উপরে অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। মান্নাদার দুঃখ ছিল হিন্দি সিনেমায় পিওর রোম্যান্টিক গান গাওয়ার বেশি সুযোগ পাননি। কিন্তু বাংলা সিনেমা মান্নাদার সেই দুঃখ একেবারে ভুলিয়ে দিয়েছে।

বাংলা সিনেমা বলতে যে-মুখটা আমাদের চোখের সামনে প্রথম ভেসে ওঠে তিনি উত্তমকুমার। তখন উত্তমকুমার মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সফল জুটি, সফল গান—হারানো সুর, সপ্তপদী, শিল্পী, ইন্দ্রাণী, চাওয়া-পাওয়া। যখন সফলতা আসে, কোনও পরিচালক, প্রয়োজক, সঙ্গীত পরিচালক সেই সফল জুটি ভাঙতে চায় না। হিন্দি সিনেমাতেও আমরা এমনটি দেখেছি। কিন্তু গায়কটির নাম যে মান্না দে। গানবাজনার সমস্ত কিছু শিখে বসে আছেন। (নিজে বলতেন সামান্যই গাইতে পারি), অসাধারণ সব গান গাইছেন হিন্দি ছবিতে। একদম তৈরি শিল্পী। তাঁকে দূরে রাখবেন কী করে? অনিবার্য ঘটনাটি ঘটালেন সুধীন দাশগুপ্ত। ১৯৫৯ সালে ‘গলি থেকে রাজপথ’ ছবিতে মান্নাদাকে গাওয়ালেন উত্তমকুমারের লিপে। আগের বছরই মান্নাদাকে দিয়ে গাইয়েছেন ‘ডাকহরকরা’ ছবির অসাধারণ গান—প্রভু তোমার শেষবিচারের আশায়। ইতিহাস কিন্তু তৈরি হল আরও কয়েক বছর পরে। ১৯৬৬। শঙ্খবেলা। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত, উত্তমকুমার, মান্না দে। ফলত: ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ এই গানে উত্তমকুমারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করলেন মান্নাদা। সুরে, সুরে। রোম্যান্টিকতার একদম শেষ কথা এই গান। বহুবার মান্নাদা বলেছেন—বাংলায় এই গানটিই তাঁর সব থেকে রোম্যান্টিক গান। এই ছবিতেই মান্নাদা প্রায় পুরোপুরি উত্তমকুমারকে অধিকার করে নিলেন। উত্তমকুমার-মান্না দে। বাংলা সিনেমা অচিরেই সুরের ধনে ধনী হয়ে উঠল—আমি যে জলসাঘরে, আমায় চিরদিনের সেই গান বলে দাও, হাজার টাকার ঝাড় বাতিটা, কাহারবা নয় দাদরা বাজাও, চম্পা চামেলি, যেদিন লব বিদায়, বড় একা লাগে, ওরাই রাতের ভ্রমর হয়ে। এই তালিকার কোনও শেষ হয় না। খুব বিনীত ভাবে, বিব্রত হয়ে একটা কথা বলছি। উত্তমকুমারের লিপে বহু গান গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, কিশোরকুমার, কিন্তু মান্নাদার মতো পরিপূর্ণতা কেউ দিতে পারেননি—কখনও রোম্যান্টিক, কখনও জমিদারি মেজাজ, কখনও মাতাল, কখনও বার-সিঙ্গার, কখনও কমেডিয়ান, কখনও খলনায়ক, যখনই যে চরিত্রের গান গেয়েছেন, মান্নাদা চরিত্রের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে গেছেন। মান্নাদা নিজেকে এমন ভাবেই তৈরি করেছিলেন। যথার্থ বলেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়—‘হেমন্ত মুখার্জি ইজ বর্ন, বাট মান্না দে ইজ মেড’।

মান্না দে এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যুগলবন্দির কথাও একটু আলাদা ভাবে বলি। সংখ্যায় কিছুটা কম হলেও দুজন মিলে তৈরি করেছেন গানের সব অসাধারণ মুহূর্ত। মান্নাদাই প্রথম সৌমিত্রকে টুইস্ট নাচালেন—‘জীবনে কি পাবো না’। গানের বয়স ছেচল্লিশ। এখনও এ-গান গাইছে এ-যুগের ছেলেরা। কলেজের ফেস্ট বলুন, নতুন সিনেমা বলুন, গানের অনুষ্ঠান বলুন—এখনও এ-গানের সমান চাহিদা।

‘সুদূর নীহারিকা’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। অত্যন্ত সুগায়ক এবং সুরকার। সৌমিত্রবাবুর লিপে একটি অসাধারণ গান তৈরি করলেন—‘কেন ডাকো মিছে পাপিয়া’। প্রচণ্ড কঠিন সুর, আবার ছবির সিচুয়েশন অনুযায়ী আবেদনও প্রচুর। মানবেন্দ্র নিজে এ গান গাইলেন না। তিনি জানতেন ভারতে এই গানটি গাইবার জন্য একজনই শিল্পী আছেন মান্না দে।

সৌমিত্রবাবু অভিনয় করেছেন নানা চরিত্রে—চরিত্রের যত ভ্যারিয়েশন, গানেরও তেমন বৈচিত্র। মান্নাদা গাইলেন সব অসাধারণ গান, ছবিগুলোর কথা ভাবুন—প্রথম কদম ফুল, তিন ভুবনের পারে, অসতী, হারায়ে খুঁজি, ইন্দিরা, প্রতিশোধ, ছুটির ফাঁদে, এপার-ওপার, ঘরের বাইরে ঘর, অগ্রদানী

বলার মতো ঘটনা, মান্নাদা যে স্বল্প সংখ্যক বাংলা সিনেমায় সুর করেছেন, তার মধ্যে তিনটে ছবিতেই, বাবুমশাই, শেষপৃষ্ঠায় দেখুন ও প্রেয়সী, মান্নাদা গাইলেন সৌমিত্রবাবুর লিপে। ভোলা যায় —‘এ কি এমন কথা তাকে বলা গেল না’?

‘অমরগীতি’ ছবিতে তরুণ মজুমদার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সৌমিত্রের লিপে গাইয়েছিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে। যদিও পুরাতনী গান, তারই সাবজেক্ট। কিন্তু গান একদম জমলো না। পরে সবাই আফসোস করেছেন। আহা, গানগুলো যদি মান্নাদা গাইতেন।

এতো গেল দুই নায়কের কথা। পরিচালক সঙ্গীত পরিচালকেরা যখন একটু অন্যরকম চরিত্রের মুখে গান চাইছেন, তখনও ভেবেছেন মান্নাদার কথা। ছবি বিশ্বাস (এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়/একদিন রাত্রে), বিকাশ রায় (এই মাল নিয়ে চিরকাল যত গোলমাল), না, না, না, আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না (জহর রায়)/নিশিপদ্ম), ভারত আমার ভারতবর্ষ (চারমূর্তি/চিন্ময় রায়)

সিচুয়েশন ডিমান্ড করছে কমেডি গান, মাতালের গান—মান্নাদাকে ডাকো—সীতাকে কামড়ালো কুকুর (প্রেয়সী), এমন বন্ধু আর কে আছে (দীপ জ্বেলে যাই), আমি তো কুমির ধরে আনিনি (কবিতা), আমি বাঘ নই যে খিদের চোটে (ননী গোপালের বিয়ে)। ভক্তিগীতির প্রয়োজন? সেই মান্নাদা—ঘনশ্যামসুন্দর (অমর ভূপালি), খেলার ছলে হরি ঠাকুর (গৃহপ্রবেশ), আঁখি মোর কৃষ্ণ রূপের পিয়াসী (বিল্বমঙ্গল)। দেশাত্মবোধক—তব চরণ নিম্নে, বঙ্গ আমার জননী আমার (সুভাষচন্দ্র)—লোকসঙ্গীত—উথালি-পাথালি আমার বুক, কত না নদীর জন্ম হয়। ক্লাসিকাল—বাজে গো বীণা, বেঁধো না ফুলডোরে

স্বল্প পরিসরে এটুকুও শুধু ঝলক। এই ঝলকই বলে দেয় মান্নাদা প্লে-ব্যাক সিঙ্গার (এখানে শুধু বাংলা সিনেমার কথাই বলা হল) হিসেবে একাই একশো। আগেও কেউ নেই, সঙ্গেও নেই, পরেও নেই।

uttam kumar সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় manna dey exclusive ananda plus web edition debprasad chakraborty soumitro chattopadhyay manna dey uttam kumar manna dey soumitro chattopadhyya উত্তম কুমার মান্না দে
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy