Advertisement
E-Paper

‘চিরশত্রু’কে মিলিয়ে দিয়েছেন মোদী, রাহুল-চন্দ্রবাবু গলাগলিতে অন্যায় দেখছেন না ওঁরা

শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু। রাজনৈতিক সমীকরণকে এই ফর্মুলাতে ফেলেই তেলঙ্গানায় ভোটে জেতার আঁক কষেছে কংগ্রেস এবং তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)। নইলে  যে কংগ্রেসের বিরোধিতা করতে একটা রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছিলেন এন টি রামারাও, ৩৬ বছর পর সেই টিডিপি-ই কিনা ধরে ফেলল তার হাত!

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৮ ১৩:৪৫
আমিরপেটের জনসভায় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী এবং টিডিপি সুপ্রিমো চন্দ্রবাবু নায়ডু।

আমিরপেটের জনসভায় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী এবং টিডিপি সুপ্রিমো চন্দ্রবাবু নায়ডু।

শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু। রাজনৈতিক সমীকরণকে এই ফর্মুলাতে ফেলেই তেলঙ্গানায় ভোটে জেতার আঁক কষেছে কংগ্রেস এবং তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)। নইলে যে কংগ্রেসের বিরোধিতা করতে একটা রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছিলেন এন টি রামারাও, ৩৬ বছর পর সেই টিডিপি-ই কিনা ধরে ফেলল তার হাত!

তেলঙ্গানা তো বটেই, অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের ইতিহাসে কেউ কখনও দেখেননি, কংগ্রেসের কোনও নেতার সঙ্গে টিডিপি-র কেউ রাজনৈতিক মঞ্চ ভাগ করে নিয়েছেন। কিন্তু, এ বারের বিধানসভা নির্বাচন সেই ঐতিহাসিক ছবিটা তুলে ফেলল। তেলঙ্গানায় একের পর এক জনসভায় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধীর সঙ্গে একই মঞ্চে ভাষণ দিচ্ছেন টিডিপি সুপ্রিমো চন্দ্রবাবু নায়ডু। একের মুখে অন্যের প্রশংসার বন্যা। একই গাড়িতে জনতার উদ্দেশে হাত নাড়ছেন দুই নেতা। সৌজন্যে অবশ্যই ‘প্রজা কুটামি’ অর্থাৎ মহাজোট।

তবে, এই ছবিটা তৈরির কারিগর কিন্তু এক জনই। তিনি নরেন্দ্র মোদী। তাঁর সৌজন্যেই তো কংগ্রেসের সঙ্গে জোটটা হল টিডিপি-র। মোদী যদি চন্দ্রবাবুর হাতে অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজটা ধরিয়ে দিতেন, তা হলে তিনি এনডিএ ছেড়ে যেতেন না। আর কংগ্রেসের হাতটাও ধরা হত না।

আরও পড়ুন: হনুমানও ‘দলিত’! ত্রেতা যুগের বার্থ সার্টিফিকেট কলিতে দিলেন যোগী

কিন্তু কয়েক মাস আগে পর্যন্ত যেমন বন্ধু ছিল বিজেপি, তেমন ভাবে কংগ্রেস তো টিডিপি-র শত্রু ছিল! ফর্মুলা মেনে প্রতিপক্ষ দলের সঙ্গে এই বন্ধুতা সাধারণ মানুষ, সমর্থক, এমনকি নিচু তলার কর্মীরা কি বুঝবেন? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, এত দিনের প্রতিপক্ষ কংগ্রেসকে তারা বন্ধু হিসাবে মেনে নিচ্ছেন? প্রশ্নটা করতে যত ক্ষণ সময় লেগেছে, কুকাটপল্লি কেন্দ্রের টিডিপি প্রার্থী এন ভেঙ্কট সুহাসিনী দলীয় কার্যালয়ে বসে এক সেকেন্ডও সময় নিলেন না। তেলুগু ভাষায় মিনিটখানেক বলে গেলেন। তার পরেই খেয়াল হওয়ায় একগাল হেসে ইংরেজিতে বললেন, ‘‘আপনি নিশ্চয়ই তেলুগু বোঝেন না? শুনুন এ রাজ্যে যে শাসন চলছে, তার থেকে মুক্তি পেতে মানুষ বিকল্প চাইছেন। টিডিপি সেই বিকল্প আনতেই কংগ্রেসের সঙ্গে গিয়েছে। মানুষ সেটা মন থেকে চাইছিলেনও।’’ এই সুহাসিনী আবার সম্পর্কে দলের প্রতিষ্ঠাতা এনটি রামারাওয়ের নাতনি।

(ইতিহাসের পাতায় আজকের তারিখ, দেখতে ক্লিক করুন — ফিরে দেখা এই দিন।)

কংগ্রেসও প্রকাশ্যে টিডিপি-র সুনাম করতে নেমে পড়েছে। আমিরপেটের জনসভায় খোদ রাহুল গাঁধীকে বলতে শোনা গেল, ২০০৪ সালে চন্দ্রবাবু নায়ডু হেরে গেলে তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে টিডিপি নেতার প্রশংসা করে বলেছিলেন, নায়ডুজি ভোটে নিশ্চয়ই হেরেছেন। কিন্তু হায়দরাবাদ এবং নিজের প্রদেশের জন্য জবরদস্ত কাজ করেছেন তিনি। রাহুলের মুখে এ কথা শোনার পরেই জনতার ‘বাবু... বাবু’ চিৎকার। চন্দ্রবাবুকে ভালবেসে তাঁরা ‘বাবু’ বলে ডাকেন।

আরও পড়ুন: অমিতাভের কণ্ঠে ভোটারের কাছে পৌঁছতে চান মোদী​

তেলঙ্গানার এই নির্বাচনটা প্রকৃত অর্থেই লোকসভা ভোটের সেমিফাইনাল। টিডিপি এবং কগ্রেসের কাছে তো বটেই। কারণ, এই নির্বাচন থেকেই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যাবে, তাদের জোট মানুষ কী ভাবে নিচ্ছেন। জোট কতটা প্রভাব ফেলছে ভোটের বাক্সে। তার ভিত্তিতেই তো ঘুঁটি সাজানো হবে ফাইনালে। টিডিপি গোটা দেশ জুড়ে কংগ্রেসকে সঙ্গে রেখে অবিজেপি শক্তিগুলোকে একত্রিত করতে চাইছে। এখানে যদি এই ফর্মুলা কাজ না করে, তা হলে চন্দ্রবাবুর উদ্দেশ্য বানচাল হয়ে যেতে পারে। এল বি নগরের টিডিপি কর্মী রাজেন্দ্র রেড্ডি বলছিলেন, ‘‘বাবু আসলে মোদীকে সরাতে চায় দিল্লি থেকে। সে জন্যেই কংগ্রেসের হাত ধরা। আর একই উদ্দেশ্যে তো আপনাদের বাংলায় গিয়ে মমতাজির সঙ্গে দেখা করা।’’

কংগ্রেসের প্রচারসভা।

ঠিক এমনটাই আশির দশকের শেষ দিকে করতে চেয়েছিলেন এন টি রামারাও। কংগ্রেসকে হঠাতে জ্যোতি বসু, রামকৃষ্ণ হেগড়ে, ফারুখ আবদুল্লা, লালুপ্রসাদ যাদবের মতো নেতাদের নিয়ে অকংগ্রেসি দলগুলোকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছিলেন। আরও পরে সংযুক্ত মোর্চা কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ভিপি সিংহ।

আরও পড়ুন: ‘মায়া-মমতা চলেগি, অখিলেশ চলেগা, তবে কংগ্রেস নয়’, সুর পাল্টে বললেন মোদী!

কিন্তু, মোদীকে সরাতে চাওয়ার কারণ? কুকাটপল্লি, ইব্রাহিম পট্টনাম, এল বি নগর, জুবিলি হিল, রাজেন্দ্রগর, সনৎনগর, মহেশ্বরমের মতো বিধানসভা কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে দেখা গেল কারণটা সকলেই জানেন। এই সব কেন্দ্রের একটা বড় অংশে বাস করেন অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এক কালে চলে আসা মানুষজন। তাঁদের অন্তরের টান কিন্তু এখনও রয়েছে অন্ধ্রের প্রতি। কুকাটপল্লির বাসিন্দা মোটুরি শরৎবাবু বললেন, ‘‘আমরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট মেনে নিয়েছি। কারণ, এর সঙ্গে চন্দ্রবাবুর সম্মান জড়িয়ে। মোদীকে সরাতেই হবে। এ রাজ্যে জিতব। দিল্লিতে হারাব। এটাই এখন আমাদের লক্ষ্য।’’ জানাতে ভুললেন না, দলের প্রতি টানটা তাঁর এন টি রামারাওয়ের সময় থেকে।

একই মঞ্চে চন্দ্রবাবু, কোডানডারম এবং রাহুল গাঁধী।

২০১৪ সালের নির্বাচনে টিডিপি একক ভাবে ১৫টি আসনে জিতেছিল। পরে শিবরাত্রির সলতের মতো টিকে গিয়েছেন দু’জন বিধায়ক। বাকি সবাই চলে গিয়েছিলেন তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি (টিআরএস)-তে। সে বার বিজেপির সঙ্গে জোট ছিল। বিজেপি পেয়েছিল ৫টি আসন। কিন্তু, চন্দ্রবাবু এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসায় বিজেপি এ বার একক ভাবে লড়ছে। কংগ্রেসের হাত ধরে টিডিপি ক’টা আসন পাবে? জোটই বা পাবে ক’টা? টিডিপি-র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ই পেড্ডি রেড্ডি বললেন, ‘‘জোট সব মিলিয়ে ৭৫টি আসনের বেশি পাবে। আমরা যে ক’টা কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়েছি, সব ক’টাতেই জিতছি।’’

জোটের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে কি একটু বাড়িয়ে বলে ফেললেন অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন এই মন্ত্রী? প্রশ্নটা হাসি মুখে বিনীত গলায় করা গেল। জবাবটাও এল হাসি মুখে— ‘‘আপনি এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে চেনেন না। তিনি এখানকার কিং। কিন্তু রাজা যখন উন্মাদ হয়ে যান, তখন প্রজারা কিন্তু তাঁকে আর রাজা বলে মানতে চায় না। কারণ ফলটা তো তাঁদের ভোগ করতে হয়। তাঁদের তখন নতুন রাজা প্রয়োজন হয়। কাজেই...’’ কথাটা শেষ করলেন না তিনি।

সভায় তখন রাহুল-বাবু। উল্লাসে ফেটে পড়ছেন সমর্থকেরা।

বাইরে থেকে পি রেড্ডিকে যতটা আত্মবিশ্বাসী দেখাল, প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি এন উত্তমকুমার রেড্ডিকে ততটাই বিধ্বস্ত লাগল। প্রচারের কাজে বেরিয়ে ক্লান্ত বলেই হয়তো। কারণ জোটসঙ্গীদের ভাগ করে দেওয়ার পর কংগ্রেসের হাতে তো প্রায় একশোর কাছাকাছি কেন্দ্র রয়েছে। সব মিলিয়ে জোটের একটা বড় চাপ সামলাতে হচ্ছে কংগ্রেসকেই। এমনটাই জানালেন তিনি।

আরও পড়ুন: উনিশের বীজ বুনে সভা রাহুল-নায়ডুর

তবে, ভোটের বাজারে টিডিপি বা কংগ্রেস দু’পক্ষেরই একমাত্র নিশানা কিন্তু নরেন্দ্র মোদী। কখনও সখনও এক আধটা তির লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে লাগছে কেসিআর-এর গায়ে। তাতে কেমন মনে হচ্ছে, তেলঙ্গানায় যেন বিধানসভা নির্বাচন নয়, লোকসভা ভোট হচ্ছে। দু’দলের মন কি তবে নিজামের রাজ্য ছেড়ে দিল্লির মসনদের দিকেই!

ছবি: পিটিআই।

(ভোটের খবর, জোটের খবর, নোটের খবর, লুটের খবর- দেশে যা ঘটছে তার সেরা বাছাই পেতে নজর রাখুন আমাদেরদেশবিভাগে।)

Assembly Elections 2018 TDP Congress N. Chandrababu Naidu Rahul Gandhi Narendra Modi BJP রাহুল গাঁধী চন্দ্রবাবু নায়ডু Telangana Assembly Election 2018
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy