Advertisement
E-Paper

পাঁচ বছরে ঢেলেছেন ১৮৫ কোটি! তবু কেশপুর-গড়বেতার ছায়া মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্রে

উন্নয়ন নিয়ে কুলদীপের এই প্রশ্নকে অবশ্য গুরুত্ব দিচ্ছেন না স্থানীয় কংগ্রেস কর্মীদেরই অনেকে। প্রকাশ্যে না হলেও, আলাদা কথোপকথনে বুদনীর কংগ্রেস কর্মীরা মানছেন, শিবরাজ সিংহ চৌহান বুদনীর জন্য করেছেন অনেক।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৮ ১৫:১৪
ভোটের প্রচারে শিবরাজ সিংহ চৌহান।—ফাইল চিত্র।

ভোটের প্রচারে শিবরাজ সিংহ চৌহান।—ফাইল চিত্র।

এ বার এক লাখের মার্জিন হবে, এক লাখ। গুড়ের মতো মিষ্টি চায়ে চুমুক দিয়ে কাটা কাটা উচ্চারণে বললেন বিজয় সিংহ রাজপুত। কিন্তু, তাঁর কণ্ঠস্বর অতটা মিষ্টি লাগল না। বুদনী নগর পঞ্চায়েতের প্রধান বিজয় সিংহ রাজপুতের কথাবার্তা যথেষ্ট পরিশীলিত। কিন্তু যখনই ভোটপ্রাপ্তির হার বা জয়ের ব্যবধানের কথা উঠছে, তখনই একটা শৈত্য ধরা দিচ্ছে বুদনীর বিজেপি স্ট্রংম্যানের মুখ থেকে ঠিকরে আসা শব্দগুলোয়। আর সেই শৈত্যে মধ্যপ্রদেশের বুদনীর সঙ্গে যেন মিল পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের কেশপুর-গড়বেতার বা আরামবাগ-গোঘাটের।

বুদনী হাইপ্রোফাইল কেন্দ্র। পর পর তিন বার মধ্যপ্রদেশকে মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছে এই আসন। রাজ্যে যদি এ বার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে বিজেপি, তা হলে এ বারও মুখ্যমন্ত্রী হবেন বুদনীর বিধায়কই। কোনও সংশয় নেই তাতে।

কিন্তু কংগ্রেস বলছে সংশয় রয়েছে। ‘‘রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতা ধরে রাখবে কি না, তা নিয়ে তো রয়েছেই, ভরপুর সংশয় রয়েছে বুদনী থেকে শিবরাজ সিংহ চৌহানের জয় নিয়েও।’’ বললেন, প্রদেশ কিষাণ কংগ্রেসের সহ-সভাপতি কুলদীপ সিংহ। কেন সংশয়? কুলদীপের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘এত বছর ধরে এই কেন্দ্রের বিধায়ক রয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে, এলাকাটা দেখে আপনার কি মনে হচ্ছে এখানে সেই অনুযায়ী উন্নয়ন হয়েছে?’’

আরও পড়ুন: অনাপ-শনাপ পয়সা! কৃষক হত্যার মন্দসৌরেও উদ্বেগে থাকতে হচ্ছে কংগ্রেসকে​

উন্নয়ন নিয়ে কুলদীপের এই প্রশ্নকে অবশ্য গুরুত্ব দিচ্ছেন না স্থানীয় কংগ্রেস কর্মীদেরই অনেকে। প্রকাশ্যে না হলেও, আলাদা কথোপকথনে বুদনীর কংগ্রেস কর্মীরা মানছেন, শিবরাজ সিংহ চৌহান বুদনীর জন্য করেছেন অনেক। মানছেন যে, ১৫ বছর আগের বুদনী আর আজকের বুদনীকে মেলানো যায় না। তা হলে কোন ভরসায় প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ যাদবের মতো হেভিওয়েটকে কংগ্রেস লড়তে পাঠিয়ে দিল সীহোর জেলার পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা এই বিধানসভা কেন্দ্রে? গত বিধানসভা নির্বাচনেও এই কেন্দ্র থেকে ৮৪ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছিলেন শিবরাজ। উন্নয়ন নিয়েও প্রশ্ন তোলা যাচ্ছে না। তা হলে কোন হাতিয়ারে শিবরাজকে ঘায়েল করবেন অরুণ?

ব্যাখ্যাটা এল কংগ্রেসের স্থানীয় মণ্ডল কমিটির নেতা বছর তিরিশের মনজিৎ সিংহের কাছ থেকে। মনজিৎ ধারালো যুবক। এলাকায় জনসংযোগও রয়েছে। বললেন, ‘‘মূল সমস্যা কৃষকদের অসন্তোষ আর কাজের অভাব। এলাকায় দুটো বড় বড় মিল রয়েছে। কিন্তু এলাকার লোকজন তাতে কাজ পান না। চাষিরা ফসলের দাম পান না। তা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রীর এত আত্মবিশ্বাস যে, তিনি বুদনীতে প্রচারেই আসছেন না। স্ত্রী আর ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রচারের জন্য। ফলটাও পাচ্ছেন। বেশ কয়েকটা গ্রামে মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী বা ছেলের পথ আটকে দিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। বলেছেন, আমাদের গ্রামে আপনাদের ঢোকার দরকার নেই, ফিরে যান।’’

বুদনীতে বিজেপির অফিস।

শিবরাজের স্ত্রী সাধনা বা ছেলে কার্তিকেয় বেশ কয়েকটা গ্রামে ঢুকতে বাধা পেয়েছেন— এই গল্পটা মুখে মুখে বেশ ছড়িয়েছে। বুদনীতেও, বুদনীর বাইরেও। যদিও সাধনা বা কার্তিকেয় বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন, এমন কোনও ছবিও সংবাদমাধ্যমে ভেসে ওঠেনি এখনও। বিজেপি-ও পত্রপাঠ খারিজ করে দিচ্ছে কথাটা। বিজয় সিংহ রাজপুতের কথায়, ‘‘এই রকম ঘটনা ঘটা কখনও সম্ভব! গুজব ছড়ালেই হবে?’’

কেন সম্ভব নয়? বর্ধমান এবং ট্রাইডেন্ট নামে দুটো বড় কাপড়ের মিল রয়েছে বুদনীতে, যেখানে এলাকার লোকজন সে ভাবে কাজ পান না বলে অভিযোগ। মালিকপক্ষ মনে করেন, এলাকার লোকজনকে বেশি সংখ্যায় কাজ দিলে ইউনিয়নবাজি বেশি হবে। আর মালিকপক্ষের সেই ধারণা ভাঙার জন্য শিবরাজ কোনও ভাবেই সক্রিয় হননি বলেও আক্ষেপ অনেকের। একটা কল সেন্টার গড়ে উঠেছিল বুদনীতে। সেটাও সম্প্রতি ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে, অনেকে কাজ হারিয়েছেন। বুদনীতে একটা কৃষক বিক্ষোভও হয়ে গিয়েছে সম্প্রতি। মানুষের মধ্যে ক্ষোভ থাকা সম্ভব নয়, এমনটা বিজেপি ধরে নিচ্ছে কী ভাবে?

বিজয় সিংহ রাজপুত এ বার বললেন, ‘‘গত পাঁচ বছরে শুধুমাত্র নগর পঞ্চায়েতটার জন্য কত টাকা এসেছে জানেন? ১৮৫ কোটি টাকারও বেশি। আবাসন প্রকল্প, রাস্তা, নগর পর্ষদ, স্টেডিয়াম— কী হচ্ছে না বুদনীতে! কংগ্রেসের আমলে আড়াই লাখ-তিন লাখ টাকা আসত, তাতেই বাজি ফাটিয়ে উৎসব করত। আর এখন পাঁচ বছরে একটা নগর পঞ্চায়েতের জন্য ১৮৫ কোটি টাকা! ভাবতে পেরেছেন কেউ আগে?’’ সব মিলিয়ে বরাদ্দ অর্থের অঙ্কটা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে বিজেপি কর্মীদের দাবি।

মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিন শিবরাজ সিংহ চৌহান।

শিবরাজ সিংহ চৌহান নিজেও সম্ভবত বেশ আত্মবিশ্বাসী নিজের কেন্দ্র নিয়ে। তাই প্রচারেই যাচ্ছেন না নিজের কেন্দ্রে। শিবরাজকে বুদনীতে কিছুটা আটকে দেওয়ার জন্যই যে অরুণ যাদবের মতো হেভিওয়েটকে প্রার্থী করেছে কংগ্রেস, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না। কিন্তু নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্রের বাসিন্দাদের উদ্দেশে শিবরাজের বার্তা— প্রচার তিনি করবেন না, এলাকার মানুষই ঠিক করুন, তাঁকে ভোট দেবেন কি না।

আরও পড়ুন: আত্মবিশ্বাস নেই বিজেপির, কিন্তু কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার কারণ খুঁজছে মালওয়া-নিমাড়​

শিবরাজের এই আবেগঘন আহ্বানের প্রভাব একেবারে নেই, তা নয়। কিন্তু আর একটা ভিন্নধর্মী আবেগও কাজ করছে। সেটা হল জাতপাতের আবেগ। শিবরাজ নিজে কিরার রাজপুত সম্প্রদায়ের। হাজার ষোলো ভোট রয়েছে কিরারদের। ধাকড় রাজপুতদের ভোট রয়েছে আরও হাজার চারেক। এই ভোটের অধিকাংশটাই শিবরাজের দিকে যাবে বলে বিজেপির আশা। এ ছাড়া ব্রাহ্মণ ও ঠাকুর মিলিয়ে প্রায় হাজার কুড়ি ভোট বিজেপির ব্যাঙ্কেই জমা হয় বরাবর। কিন্তু এই সবটা মেলালে ৪০ হাজারের মতো ভোট হয়। ২ লক্ষ ৪১ হাজার ভোটারের কেন্দ্রে জয় সুনিশ্চিত করার জন্য ওই সংখ্যা একেবারেই যথেষ্ট নয়।

উল্টো দিকে থাকা প্রার্থীর জন্য সমীকরণটা কেমন? বুদনীতে যাদব ভোট প্রায় হাজার তিরিশেক। সেই ভোটের সিংহ ভাগ নিজের ঝুলিতে টানতে পারবেন বলে আশাবাদী অরুণ যাদব। এ ছাড়া হরিজন, আদিবাসী এবং মুসলিম ভোটের উপরেও কংগ্রেসের দখল বরাবরই ভাল। প্রচারের ফাঁকে তাই অরুণ যাদবের ভাই মনোজ যাদব বললেন, ‘‘এই কেন্দ্রে হরিজন ভোটার প্রায় ৩০ হাজার, আদিবাসী ৩২ হাজার আর মুসলিম ২০ হাজারের মতো। এর সঙ্গে যাদব ভোটটা যোগ হলে আমাদের সংখ্যাটা কোথায় পৌঁছচ্ছে হিসেব করুন।’’

অখিলেশ যাদবের সঙ্গে অরুণ যাদব।

অরুণ যাদব নিজেও হিসেবটা করেছেন। তাই জাতপাতের সমীকরণটাকেই বুদনীতে সবচেয়ে বেশি করে কাজে লাগাতে চাইছেন তিনি। ‘উন্নয়নের জোয়ার’ বা ‘মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্র’ জাতীয় তত্ত্বকে পিছনে ঠেলে দিয়ে জাতপাতের আবেগটাকে সামনে আনতে পারলেই কেল্লা ফতে— মনে করছেন কংগ্রেস নেতারা।

তবে একটা আশঙ্কার কথাও কংগ্রেস নেতাদের মুখে মুখে ফিরছে বুদনীতে। আশঙ্কাটা ওই কেশপুর-গড়বেতা বা আরামবাগ-গোঘাট সুলভ শৈত্যটা নিয়ে। বুদনীতে ভোটটা আদৌ হতে দেবেন তো শিবরাজ? প্রশ্ন কংগ্রেসের। বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনে গিয়ে ৬৩টা বুথের তালিকা জমা দিয়েছেন অরুণ যাদব। ওই বুথগুলোয় কোনও ভোটই হয় না বলে যাদবের দাবি। যাদবের কথায়, ‘‘এক-একটা বুথে ৭০০-৮০০ ভোটার। কিন্তু ওই ৬৩টা বুথে বিরোধী দলগুলোর ভাগে মাত্র ১৫-২০টা ভোট, বাকি সব শাসক দলের। ২০০৮ এবং ২০১৩— দুটো বিধানসভা নির্বাচনেই এমনটা হয়েছে।’’ যাদবের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে এমন ‘একতরফা’ ভাবে ভোট পড়াটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। তাই ওই ৬৩টা বুথের দিকে আলদা করে নজর দেওয়ার জন্য কমিশনকে অনুরোধ করেছেন তিনি।

৬৩টা বুথে এই ‘একতরফা ভোট’ যদি আটকে দেওয়া যায়, তা হলে ফলটা দেখে নেবেন— বুদনী ছাড়ার আগে বললেন কংগ্রেস কর্মীরা। আর বিজেপি হাসছে। নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে রাজপুত নেতা সহাস্যে প্রশ্ন করছেন, ‘‘হারার আগেই হার মেনে নিল তো?’’

Assembly Elections 2018 Madhya Pradesh Assembly Election 2018
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy