Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Bihar Election 2020

নীতীশের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তেজস্বী, তবে খেলা জমিয়েছেন চিরাগই

মাঝে ২০১০ থেকে ২০১৫ বাদ দিলে সেই ১৯৯৫ থেকে এই আসনে কখনও জিতেছেন লালু, কখনও রাবড়ী, আর শেষ বার তেজস্বী নিজে।

চিরাগ পাসোয়ান ও তেজস্বী যাদব

চিরাগ পাসোয়ান ও তেজস্বী যাদব

অনমিত্র সেনগুপ্ত 
হাজিপুর শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২০ ০৪:১৬
Share: Save:

দু’জনের রক্তেই রাজনীতি। কিন্তু এক জন হতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটার, অন্য জন অভিনেতা। প্রথম পছন্দের পেশায় দু’জনেই ব্যর্থ। এক জন আইপিএল-এ দিল্লির রিজার্ভ বেঞ্চে বসেই কাটিয়ে দেন একাধিক মরসুম। অন্য জন বলিউড থেকে ফিরে আসেন ফ্লপ হিরোর তকমা নিয়ে। সেই ক্রিকেটার তেজস্বী যাদব আর অভিনেতা চিরাগ পাসোয়ান-এ বার বিহার ভোটের অন্যতম কুশীলব। ঘটনাচক্রে দু’জনেরই ‘শত্রু’ এক জন— নীতীশ কুমার।

ধারে ও ভারে তেজস্বী এগিয়ে থাকলেও, নিঃসন্দেহে বিহারের নির্বাচন জমিয়ে দিয়েছেন চিরাগ। হাজিপুর সংলগ্ন এলাকা দীর্ঘদিনই পাসোয়ানদের গড়। এখান থেকেই চার দশক ধরে জিতে এসেছেন চিরাগের বাবা রামবিলাস পাসোয়ান। সম্প্রতি তাঁর মৃত্যুর পরে অরন্ধন পালন করেছে এখানকার বহু পাসোয়ান পরিবার।

সেই হাজিপুরে সাহু মিষ্টির দোকানে আলাপ হল রসিক পাসোয়ানের সঙ্গে। পেশা চাষবাস। চিরাগের কথা উঠতেই প্রশ্নে এক কথায় উচ্ছ্বসিত। বললেন, “রামবিলাসের মৃত্যুতে পাসোয়ান সমাজের মাথা থেকে ছাতা সরে গিয়েছিল ভেবেছিলাম। কিন্তু চিরাগ যে পরিণতিবোধ দেখাচ্ছেন, তাতে পাসোয়ান সমাজ নতুন নেতা পেয়ে গিয়েছে। আসলে বাপ-কা-বেটা আর সিপাহি-কি-ঘোড়া— প্রভাব তো পড়বেই।’’ হাজিপুরের রামদেও চকের পানের দোকানি বৈজুপ্রসাদ নিজে যাদব। ভোট দেবেন আরজেডি-কে।

আরও পড়ুন: সাফল্য মোদীর, ব্যর্থতা মানুষের? প্রশ্ন বিরোধীদের​

কিন্তু চিরাগের রাতারাতি পরিবর্তনে তিনিও অবাক। পান সাজতে সাজতে বললেন, ‘‘নীতীশকে অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছেন চিরাগ। নীতীশ সরকারের বিরুদ্ধে চিরাগ যে দুর্নীতির অভিযোগ তুলছেন, তার একটিও মিথ্যা নয়। আমজনতা তার সাক্ষী।’’ স্থানীয় স্কুল-শিক্ষক রামাধর মাহাতোর কথায়, “রামবিলাসের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নীতীশের বিরুদ্ধে যে অভদ্রতার অভিযোগ চিরাগ তুলেছেন, তাতে শুধু পাসোয়ানরা নন, অন্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষও নীতীশের উপরে বেশ রেগে আছেন। তা ছাড়া, নীতীশকে আক্রমণ করতে গিয়ে চিরাগ শালীনতার সীমা ছাড়াননি। ফলে আমজনতার সহানুভূতি পেয়েছেন তিনি।’’

আরও পড়ুন: ত্রিপুরায় আবার সক্রিয় উগ্রপন্থীরা​

ভাবমূর্তির প্রশ্নে চিরাগ যেখানে নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, সেখানে তেজস্বী ভুগছেন সেই ভাবমূর্তির সমস্যায়। মাধ্যমিক পাশ না-করা তেজস্বীকে গত ভোটের পরে জেডিইউ-আরজেডি-কংগ্রেস সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী করায় প্রবল সমালোচনা হয়েছিল। অল্প কয়েক মাসের মন্ত্রিত্বেই একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তেজস্বীর বিরুদ্ধে। সেই ভূত এখনও তাড়া করছে তাঁকে। গাড়িচালক দিবাকরের সাফ কথা, ‘‘তেজস্বী তো লাফুয়া (উচ্ছৃঙ্খল)। রিক্সাওয়ালা রাস্তা আটকালে গাড়ি থেকে নেমে রিক্সাওয়ালার সঙ্গে মারপিট করেন। কিন্তু চিরাগ রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে হলেও এখনও কোনও অভিযোগ নেই ওঁর বিরুদ্ধে।’’

তেজস্বীর বাবা লালুপ্রসাদ জীবনের বড় সময় বিহারের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, রামবিলাসের রাজনৈতিক জীবন দিল্লিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। চিরাগ বাবার মতোই দিল্লি-কেন্দ্রিক রাজনীতি করলেও, এখন দলের দায়িত্ব পেয়ে বিহারে এলজেপি-র জনভিত্তি বাড়াতে সক্রিয় হয়েছেন। নীতীশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, সদ্য রাজনীতিতে আসা চিরাগের এই দুঃসাহসের পিছনে কে রয়েছে? বিহারের সাধারণ মানুষ মনে করছেন, ইন্ধন জোগাচ্ছে বিজেপি-ই।

বিজেপি অবশ্য গোড়া থেকেই ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। রাজ্য বিজেপির প্রধান নেতা সুশীল মোদীর কথায়, ‘‘চিরাগ সম্পূর্ণ আলাদা দল হিসেবে লড়াই করছেন।’’ বিজেপির আর এক নেতা শাহনওয়াজ হুসেনের দাবি, ‘‘চিরাগকে সমর্থন করে বিহারে এনডিএ-কে দুর্বল করার কোনও প্রশ্নই নেই।’’ যদিও পাল্টা যুক্তিতে অনেকেই বলছেন, পরিকল্পিত ভাবে নীতীশের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে খাড়া করা হয়েছে চিরাগকে। লক্ষ্য হল, নীতীশ তথা এনডিএ-বিরোধী ভোট বিরোধী মহাজোট ও চিরাগের দলের মধ্যে ভাগাভাগি করে দেওয়া। বিরোধী ভোট যত ভাগ হবে, ততই ফায়দা শাসক শিবিরের।

এ দিকে, লালুপ্রসাদের অনুপস্থিতিতে প্রচারের আলোয় চলে এসেছেন তেজস্বী। বিরোধী মহাজোটের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী তিনিই। কার্যত পারিবারিক কেন্দ্র রাঘোপুর থেকে ফের লড়ছেন তেজস্বী। মাঝে ২০১০ থেকে ২০১৫ বাদ দিলে সেই ১৯৯৫ থেকে এই আসনে কখনও জিতেছেন লালু, কখনও রাবড়ী, আর শেষ বার তেজস্বী নিজে। কিন্তু উন্নয়ন থমকে রয়েছে দিয়াড়া ক্ষেত্র রাঘোপুরে। এখনও পটনার সঙ্গে যোগাযোগ বলতে সেই নৌকা, তা না হলে পন্টুন বা অস্থায়ী ব্রিজ।

যাদব অধ্যুষিত রাঘোপুর অবশ্য সে সব নিয়ে মাথা ঘামায় না। স্থানীয় চায়ের দোকানি প্রকাশ যাদবের কথায়, “তেজস্বী আমাদের জাতের প্রতিনিধি। ওঁকে জেতানো আমাদের কর্তব্য। একমাত্র ও-ই ফেরাতে পারে আমাদের রাজত্ব।’’ রাঘোপুরের যাদবেরাই শুধু নন, রাজপুত সমাজও এ বার নীতীশকে হারাতে এককাট্টা। রাজপুত অধ্যুষিত বীরপুর এলাকার মনিহারি দোকানের মালিক মণীশ সিংহেরা এ বার তেজস্বীর পিছনে। তিনি বলছেন, “গোটা রাজ্যের রাজপুতেরা এ বার নীতীশ তথা এনডিএ-র বিরুদ্ধে। পনেরো বছরে রাজপুত সমাজের জন্য ছিটেফোঁটা কাজ করেননি নীতীশ। প্রশাসন থেকে সরকার— সবতেই আমাদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। এ বার সব হিসেব মেটানোর পালা।’’

তেজস্বীর নেতৃত্বে বিরোধী ভোট একজোট হচ্ছে দেখে লালুপ্রসাদের পনেরো বছরের কুশাসন, যাদব রাজত্বে প্রকাশ্যে কী ভাবে খুন-জখম-রাজাহানি হত, সেই স্মৃতি উস্কে দেওয়ার কৌশল নিয়েছেন নীতীশ। আরজেডি নেতা শিবানন্দ তিওয়ারির পাল্টা আক্রমণ, “অতীত ছেড়ে নীতীশ বরং বলুন গত পনেরো বছরে তিনি কী করেছেন। কিছুই যে করেননি তা বুঝতে পেরেই এখন অতীতকে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। কিন্তু লিখে রাখুন লোকে এ বার পরিবর্তন চাইছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tejashwi Yadav Chirag Paswan Bihar Election 2020
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE