Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Delhi Violence

অবিশ্বাসের পাড়ায় সন্দেহের পোড়া দাগ

তিন দশকের সম্প্রীতি গুঁড়িয়ে গিয়েছে সোমবার বিকেলে, মাত্র দশ মিনিটের তাণ্ডবে।

যেমন আছি: জুম্মার প্রার্থনার আগে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেললেন প্রৌঢ়। শুক্রবার দিল্লিতে।

যেমন আছি: জুম্মার প্রার্থনার আগে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেললেন প্রৌঢ়। শুক্রবার দিল্লিতে।

অনমিত্র সেনগুপ্ত
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৩:৩৬
Share: Save:

জবাব নেই। আসলে জবাব দেবেন কী ভাবে, চার দিন পরেও জানেন না বৃদ্ধ মিনাজউদ্দিন। হিসেব কিছুতেই মিলছে না যে!

করওয়াল নগরের মোড়েই বড় রাস্তার উপরে চাঁদ বাবার মাজার। গত ২৫-৩০ বছর তারই দেখভাল করে এসেছেন মিনাজ। তুবড়ে যাওয়া দরজার শিক দড়ি দিয়ে বাঁধতে বাঁধতে মিনাজ বললেন, ‘‘কী বলব বলুন তো! কারা করেছে জানি না। এখানে যারা আসে, তাদের আশি শতাংশই হিন্দু। পরীক্ষায় ভাল ফলের আশায় পড়ুয়া থেকে বিয়ে করতে যাওয়া বর— এখানে মাথা ঠেকাবেই সক্কলে। তার পর সব শুভ কাজ।’’ সৌহার্দ্যের সেই প্রতীক, চাঁদ বাবার মাজার পুড়ে ঝামা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক্কেবারে রাস্তার উপরে। পাঁচ ফুট দূরে নীরব দর্শক দিল্লি পুলিশের চৌকি।

তিন দশকের সম্প্রীতি গুঁড়িয়ে গিয়েছে সোমবার বিকেলে, মাত্র দশ মিনিটের তাণ্ডবে। মিনাজ বললেন, ‘‘একদল লোক রে রে করে দৌড়ে এল। অচেনা মুখ। পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল মাজারের বাইরে। ভিতরে ফেলে দেওয়া হল জ্বলন্ত টায়ার।’’ কোনও মতে দৌড়ে প্রাণ বাঁচান মিনাজ। ভেঙেই গিয়েছে মাজারের দরজার একাংশ। জ্বলন্ত টায়ারের আগুনে ঘর পুড়ে ঝামা। আগুনের তাপে বেঁকে গিয়েছে সিলিং ফ্যানের ব্লেড।

করওয়াল নগরে ঢুকতেই এক পাশে আজাদ চিকেন সেন্টার। বুরে খান, দীন মহম্মদেরা চার ভাই মিলে দোকান চালাতেন। পেট্রল বোমায় পুড়ে গিয়েছে গোটা বাড়ি। নীচের দরজা বন্ধ থাকায় চার ভাইয়ের আঠারো জনের পরিবার ছাদ ডিঙিয়ে প্রাণ বাঁচায়। আজাদ চিকেন সেন্টার ঝলসে গেলেও উল্টো দিকে ভুজিয়াওয়ালার দোকান অক্ষত। আগুন তো দূর, গন্ডগোলের আঁচটুকু পড়েনি সেই দোকানে। কেন? উত্তরে সকলে জানেন। কিন্তু আতঙ্কের আবহে মুখে কুলুপ। ভিড় দেখলেই খেঁকিয়ে উঠছেন আধাসেনারা। দ্রুত লাঠি তুলে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হচ্ছে ভিড়। ধমকে ফের বাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে মানুষকে।

ধ্বস্ত রাজধানী


• নতুন কোনও গোলমালের খবর নেই
• মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪২ (রাত ১২টা পর্যন্ত)
• ৬৩০ জন গ্রেফতার, ১২৩টি এফআইআর
• মসজিদগুলি থেকে শান্তি ফেরানোর বার্তা
• ইমামদের সঙ্গে কথা, শান্তির আশ্বাস পুলিশের
• বোর্ড পরীক্ষায় নিরাপত্তা দেবে পুলিশ: হাইকোর্ট
• দুর্গতদের ক্ষতিপূরণ দিতে চালু হবে অ্যাপ
• শান্তি ফেরাতে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি বিরোধীদের
• অশান্তিতে ক্ষুব্ধ বিজেপি-সঙ্গী অকালি

করওয়াল নগর ধরে চাঁদ বাগের দিকে যত এগিয়েছি তত দেখেছি, বেছে বেছে কিছু দোকান ও বাড়িকেই ছুঁয়ে গিয়েছে আগুনের দৌরাত্ম্য। যেমন পাপ্পু কুলারওয়ালা। দোতলা বাড়ির উপরের তলায় হিন্দুদের দোকান— তাই পাপ্পুর দোকান বেঁচেছে। কিন্তু কুলারগুলোকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে অগ্নিকুণ্ডে। চার দশকের বাসিন্দা, পক্ককেশ নাদিম অবশ্য রাখঢাক না-রেখেই বললেন, ‘‘বাইরে থেকে লোক ঢুকেছিল। স্থানীয়রা সেই বাইরের লোকেদের আমাদের ঘর-দোকান চিনিয়ে দিয়েছে।’’ চাঁদ বাগ হিন্দু অধ্যুষিত হওয়ায় মুসলমানেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এটা যেমন সত্যি, কয়েকশো মিটার এগোলেই চমন পার্কে ঠিক উল্টো ছবি। মুস্তাফাবাদের বাসিন্দা সুনীতা শর্মার কথায়, ‘‘হিন্দুদের স্কুল জ্বলছে। আর পাশে মুসলমানদের স্কুল অক্ষত। কেমন করে হয়? সোমবার ঝামেলার দিন মুসলিম স্কুলটি বেলা এগারোটায় ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। হিন্দু স্কুলে তখন ক্লাস চলছে। আসলে সব খবর ছিল
ওদের কাছে।’’

নাদিম যেখানে বসে কথা বলছিলেন, তার উল্টো দিকেই আপের কাউন্সিলর তাহির হুসেনের চারতলা বাড়ি। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে আর্বজনায় ভর্তি নালা। ওই নালা থেকেই উদ্ধার হয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মী অঙ্কিত শর্মার ক্ষতবিক্ষত দেহ। যাঁকে হত্যার অভিযোগে তাহিরের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করেছে দিল্লি পুলিশ। নাদিমদের অভিযোগ, ‘‘পরিকল্পিত ভাবে ফাঁসানো হচ্ছে তাহিরকে। গোষ্ঠী সংঘর্ষের পুরো দায় এখন তাহিরের উপরে চাপানো হচ্ছে। আসলে দোষী বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র।’’ দু’টি বাড়ি দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা নিশান গুজ্জর সব দাবি উড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, ‘‘তা হলে তাহিরের বাড়ির ছাদ থেকে আমাদের লক্ষ্য করে পেট্রল বোমা, অ্যাসিড, গুলতি দিয়ে ইট-পেরেক কারা ছুড়ছিল?’’ চারটে দিন কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছুই। রেখে গিয়েছে পারস্পরিক সন্দেহ, আতঙ্ক আর অবিশ্বাস। আজ শিব বিহার হয়ে নালা টপকে মুস্তাফাবাদে ঢোকার সময়ে আগ বাড়িয়ে সতর্ক করে দেওয়া চেহারাগুলো বলেছিল, ‘‘সব শান্ত, কিন্তু সাবধানে যাবেন।’’ নালা পেরিয়ে মুস্তাফাবাদে পা দিতেই খালি রাস্তায় মাটি ফুঁড়ে উদয় হল জনা ছয়েকের একটা দল। হিংসার সময়ে ওই নালাই ছিল সীমানা। স্থানীয়রা কেউ কেউ বলেন, ‘ভারত-পাক সীমান্ত’। পরিচয় দেওয়ার পরে অনুমতি মিলল এগোনোর। কিন্তু নজর রাখতে দূর থেকেই পিছু নিল দু’জন। শুক্রবারের নমাজ শেষে তখন ভিড় প্রতিটি গলির সামনে। সেই ভিড় ঠেলে কোনও ভাবে এসে পৌঁছলাম চমন পার্কে। উপস্থিত সাংবাদিকদের ভিড়ে মিশে যেতেই সরে গেল দু’জন।

অবিশ্বাসের একই ছবি দেখেছি পরে চাঁদ বাগে। হিন্দু মহল্লায় থাকা গুটিকয়েক মুসলিম পরিবারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতেই উপযাচক হয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসেছে নিরীহ চেহারার দু’-একজন। নাম ও পরিচয় জেনে একটাই পরামর্শ, ‘‘এখানে মুসলিম পরিবারের সবাই ভাল আছেন। এখানে কোনও খবর পাবেন না।’’ গলি থেকে না-বেরোনো পর্যন্ত নীরবে পিছনে হাঁটতে থেকেছে সেই ‘নিরীহ’ চেহারাগুলোই।

সময় পেলেই মাজারের কালো ছোপ-পড়া মেঝেতে ন্যাতা ঘষে চলেছেন মিনাজউদ্দিন। কিন্তু অবিশ্বাস মুছবে কবে? জবাব নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Delhi Violence CAA Protest Karwal Nagar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE