Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

রাফাল খুইয়ে হ্যাল বেহাল, ফুঁসছে নাশিক

হ্যালের কর্মী থেকে বিশেষজ্ঞ— সকলেই এক কথায় বলছেন, হ্যালের পারদর্শিতায় কোনও খামতি নেই।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অনমিত্র সেনগুপ্ত
নাশিক শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৫৫
Share: Save:

একটি বিতর্কিত চুক্তি। একটি কারখানার অনিশ্চিত ভবিষ্যত। একটি শহরের বেঁচে থাকা— তিনটিই আজ এক সুতোয় বাঁধা।

সৌজন্যে রাফাল।

নরেন্দ্র মোদীর করা চুক্তি অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত হিন্দুস্থান অ্যারোনটিক্যাল লিমিটেড (হ্যাল) নয়, রাফাল যুদ্ধবিমান তৈরি করবে অনিল অম্বানীর নবগঠিত সংস্থা। আর তার জেরেই মহারাষ্ট্রের নাশিকে হ্যালের কারখানাটির ভবিষ্যত প্রশ্নের মুখে। সদর দফতর বেঙ্গালুরুতে হলেও ষাটের দশকে তৈরি হওয়া নাশিকের কারখানাটি সংস্থার অন্যতম শাখা। কিন্তু এখন কাজ বাড়ন্ত। ২০২০ সালের পরে বন্ধ হয়ে যাবে সুখোই যুদ্ধবিমানের আধুনিকীকরণ। তার পর! শহরবাসীর আশঙ্কা, কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেলে শুকিয়ে যাবে নাশিকের বিরাট অংশের অর্থনীতি। স্থানীয় বাণিজ্য সংস্থাগুলির মতে, গোটা নাশিকের পঞ্চাশ শতাংশ অর্থনীতি হ্যালের উপর নির্ভরশীল। সেই কারখানা বন্ধ হলে শুধু কয়েক হাজার কর্মীই কাজ হারাবেন, তা নয়। পথে বসবে কার্যত গোটা নাশিক। তাই ভোটের উত্তাপ যত বাড়ছে, তত প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে নাশিক লোকসভা কেন্দ্রে এনডিএ জোটের শিবসেনা প্রার্থী হেমন্ত গডসেকে। বিপাকে পড়ে হ্যাল সংলগ্ন এলাকায় তাই প্রচারেই যেতে চাইছে না শাসক দল।

হ্যালের কর্মী থেকে বিশেষজ্ঞ— সকলেই এক কথায় বলছেন, হ্যালের পারদর্শিতায় কোনও খামতি নেই। ভারতীয় পাইলট অভিনন্দন বর্তমানের যে মিগ-বাইসন বিমানটি পাকিস্তানের এফ-সিক্সটিন বিমানকে ধরাশায়ী করেছিল, তার আধুনিকীকরণের দায়িত্বে ছিল হ্যাল। বালাকোটে হামলা চালানো মিরাজ বিমানকে ‘কভার’ দিতে যে সুখোই বিমান উড়েছিল, তারও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে হ্যালের মহারাষ্ট্র শাখা। বিরোধীদের অভিযোগ, ভারতীয় বায়ুসেনার সঙ্গে ৭৫ বছরের বেশি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত থাকা সত্ত্বেও কেবল মোদী সরকারের স্বজনপোষণ ও পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির কারণে অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছেন নাশিকের হ্যাল কর্মীরা। কংগ্রেস নেতা পৃথ্বীরাজ চহ্বাণের মতে, ইউপিএ আমলে ফরাসি সংস্থা দাসোর সঙ্গে যে রাফাল চুক্তি হয়েছিল, তাতে ১৮টি রাফাল যুদ্ধবিমান দাসো তৈরি করত। বাকি ১১৮টি তৈরির দায়িত্ব পেত হ্যাল। তার জন্য নিজেদের প্রযুক্তি হস্তান্তর করতেও রাজি ছিল দাসো। ওই চুক্তি কার্যকর হলে আগামী দু’দশক কাজের সমস্যা হত না হ্যালের সব ক’টি শাখার।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ক্ষমতায় এসে মোদী সরকার রাফাল কেনাবেচায় উদ্যোগ নেওয়ার খুশিই হয়েছিলেন হ্যাল কর্মীরা। পৃথ্বীরাজের অভিযোগ, কিন্তু দেখা গেল তাদের কাজ চলে গিয়েছে চুক্তির দু’সপ্তাহ আগে বানানো অনিল অম্বানীর সংস্থার হাতে! এটা নিয়েই বিজেপির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ তুলে রাহুল গাঁধী আওয়াজ তোলেন ‘চৌকিদার চোর হ্যায়!’ পাল্টা যুক্তিতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামন দাবি করেন, হ্যালের রাফাল তৈরির ক্ষমতাই ছিল না। যার উত্তরে সম্প্রতি মুখ খুলে হ্যালের প্রাক্তন প্রধান সুবর্ণ রাজু জানিয়েছেন, কাঁচামাল থেকে সুখোই তৈরি করেছে হ্যাল। তারা রাফালও তৈরি করতে সক্ষম। নাশিক ইউনিটের কর্মী সংগঠনের প্রাক্তন সাধারণ সচিব তথা হ্যালের সর্বভারতীয় আহ্বায়ক এস কুলে বলেন, ‘‘পরিবর্তে পরিকাঠামোহীন একটি সংস্থার হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হল! যারা এখনও ঠিক ভাবে কারখানার জমিই বেছে উঠতে পারেনি!’’ তাঁর সাফ কথা, ‘‘অস্তিত্বের সঙ্কটে এখন নাশিকের হ্যাল-কর্মী ও তাঁদের পরিবার বিজেপিকে হারানোর প্রতিজ্ঞা করেছেন।’’

সেই সংখ্যাটি কিন্তু নেহাত কম নয়। বর্তমানে ঠিকা ও অস্থায়ী কর্মী এবং অফিসার মিলিয়ে প্রায় ছয়-সাত হাজার কর্মী রয়েছেন নাশিকের হ্যালে। এ ছাড়া সংস্থার অনুসারি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৪০০-৫০০ সংস্থা। আরও হাজারখানেক ছোট-বড় ব্যবসায়ী রয়েছেন, যাঁরা কোনও না কোনও ভাবে সংস্থায় মাল সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত। কুলের কথায়, ‘‘এ ছাড়া গোটা নাশিক শহরের অর্থনীতির উন্নতির পিছনেই হ্যালের ভূমিকা রয়েছে।’’ বিরোধীদের অভিযোগ, কেবল অনিল অম্বানীকে পাইয়ে দিতে গিয়ে এতগুলি লোকের পরিবারকে পথে বসাচ্ছেন মোদী।

খুব সূক্ষ্ম ভাবে এই অভিযোগকেই জনমানসে পৌঁছে দিচ্ছেন এলাকার এনসিপি প্রার্থী তথা মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ছগন ভুজবলের ভাইপো সমীর ভুজবল। ২০০৯ সালের সাংসদ সমীর গত বার মোদী হাওয়ায় হেরে গিয়েছিলেন। তার পর থেকেই তলে তলে সংগঠন গড়ার উপরে জোর দেন যাঁরা এখন বাড়ি-বাড়ি ঘুরে প্রচার চালাচ্ছেন। হ্যাল ছাড়াও নোট বাতিল, জিএসটি নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ রয়েছে পূর্ণমাত্রায়। স্থানীয় হোটেলের ম্যানেজার থেকে অট‌োওয়ালা—সকলেই ভুগেছেন নোট বাতিলে। স্থানীয় গাড়িচালক মনোজ জোশীর কথায়, ‘‘নোট বাতিলের ধাক্কা এখনও সামলানো যায়নি। হ্যালে আগে আমাদের ছ’টি গাড়ি চলত। এখন তিনটে চলে। এর পর শুনছি বন্ধ হয়ে যাবে। তা হলে তো ব্যবসাও শেষ হয়ে যাবে!’’ নাশিক কলেজ রোডের দফতরে বসে এনসিপির-র স্থানীয় নেতা মনোজ পওয়ার বলছেন, ‘‘বিজেপির উপর থেকে স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস চলে গিয়েছে। তাই মানুষই পরিবর্তন চাইছেন।’’ যদিও এত সহজে হাল ছাড়ছে না শিবসেনা। তবে তারা মানছে যে, গ্রামীণ অঞ্চলের ভোট তারা পাবে না। সেই ভোট কী ভাবে উদ্ধার করা যাবে, তার উপরেই নির্ভর করছে শিবসেনার জয়।

নাসিক সংলগ্ন ধুলে কেন্দ্রেও বিজেপি দুশ্চিন্তায়। সেখানকার গত বারের জেতা প্রার্থী সুভাষ ভামরে আবার কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী। খোদ নাশিক সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা হয়ে হ্যাল বন্ধ করতে তাঁর ভূমিকা রয়েছে বলে প্রচারে নেমে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন বিরোধীরা। জেতা যে কঠিন, তা বুঝে মন রাখতে নাশিকের হ্যালকে তেজস বিমান তৈরির বরাত দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন ভামরে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রয়ে গিয়েছে খাতায়-কলমেই। ফল? প্রচারে নেমে টের পাচ্ছেন ভামরে।

হ্যাল কর্মীদের দাবি, এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটিকে দুর্বল করতে ছক কষে এগোচ্ছে মোদী সরকার। প্রথম ধাপ হিসেবে সংস্থার ভাঁড়ারে থাকা রিজার্ভ তহবিলের প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা হঠাৎই নিয়ে নেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। বায়ুসেনা, উপকূলরক্ষী বাহিনী এবং নৌবাহিনীর কাছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি বকেয়া রয়েছে সংস্থার। সেই টাকা কবে আসবে, জানে না কেউই। ফলে ইতিমধ্যেই আর্থিক সঙ্কটে ভুগতে শুরু করেছে সংস্থাটি। কর্মীদের বেতন দিতে ইতিমধ্যেই বছরের শুরুতে হাজার কোটি টাকা ধার নিতে হয়েছে। কর্মী সংগঠনের দাবি, টাকা তুলে নেওয়ার পরে বন্ধ হবে বরাত দেওয়া। স্বভাবতই কাজ না পাওয়ায় ধীরে ধীরে রুগ্‌ণ হয়ে পড়বে হ্যাল। শেষে তা জলের দরে বিক্রি করে দেবে সরকার। পথে বসবে গোটা নাশিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nasik Maharashtra Lok Sabha Election 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE