রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে এনডিএ জোটের প্রার্থীদের জয়। হার বিরোধীদের।
ছোট শরিক তথাআঞ্চলিক দলগুলিকে গুরুত্ব। অরাজনৈতিক প্রার্থী। মোদী-অমিত শাহের ফোন ম্যানেজমেন্ট। এই তিন মন্ত্রেই রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে জয় পেল এনডিএ জোট। আর এই তিন ক্ষেত্রেই ডাহা ফেল বিরোধীরা। যতই ফেডারেল ফ্রন্টের ধুঁয়ো উঠুক, যতই বিরোধীদের জোটবদ্ধ চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা হোক, আদপে গা ছাড়া মনোভাব এবং একে অন্যের প্রতি কার্যত আস্থাহীনতাই স্পষ্ট হল বিরোধী শিবিরে। নিজেদের দক্ষতা আর বিরোধীদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের আগে ফের একবার শক্তি পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হলেন মোদি-অমিত শাহরা।
অথচ শুরুটা এমন ছিল না। এনডিএ জোটের প্রার্থী হিসাবে জেডিইউ সাংসদ হরিবংশ নারায়ণ সিংহের নাম ঠিক হওয়ার পরই ক্ষোভের আঁচ মিলেছিল একাধিক শরিক দলের তরফে। পঞ্জাবের অকালি দল, নবীন পট্টনায়েকের বিজেডি, মহারাষ্ট্রে শিব সেনার মতো দল প্রকাশ্যেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল।
কিন্তু গোড়া থেকেই ময়দানে নেমেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ। একে তো হরিবংশ প্রাক্তন সাংবাদিক এবং সজ্জন বলেই পরিচিত। তার উপর সরাসরি মোদীর ফোন পেয়ে নবীন পট্টনায়েকের আর আপত্তির কারণ ছিল না। করেনওনি। কিছুদিন আগেই লোকসভায় আস্থা ভোট থেকে বিরত থাকা বিজেডি সমর্থনে রাজি হয়।
অরাজনৈতিক প্রার্থী, এই যুক্তিতে শিব সেনাও ভোটের আগের দিন জানিয়ে দেয়, তারা হরিবংশকেই সমর্থন করবেন। এই শিব সেনাও আস্থা ভোটে অংশ নেয়নি। আবার তাঁদের দলের প্রার্থী না হলেও আঞ্চলিক কোনও দলের সাংসদকে প্রার্থী করার সূত্রেই উষ্মা ভুলে পাশে দাঁড়ায় আকালি দলও।
অথচ সহজ পাটিগণিতই বলছে, বিজেডি, শিব সেনা ও আকালি দল ভোট দানে বিরত থাকলে এবং বিরোধী শিবিরে আপ, পিডিপি, ওয়াই এস আর কংগ্রেসকে ভোটে আনতে পারলে ফল অন্যরকম হতই। এই অঙ্ক কষে এগনোর ব্যর্থতার জেরেই ধরাশায়ী বিরোধীরা।
ভোটে জেতার পর নতুন ডেপুটি চেয়ারম্যানকে বসার অনুরোধ চেয়ারম্যান বেঙ্কাইয়া নায়ডুর। ছবি: পিটিআই
কারণ আরও একাধিক। হারের বিষবৃক্ষের অঙ্কুরটা সম্ভবত পুঁতেছিলেন শরদ পাওয়ার। বিরোধী প্রার্থী হিসেবে এনসিপি সাংসদ বন্দনা চহ্বাণের নাম প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়। এনডিএ-র অন্যতম বড় শরিক শিব সেনাও মরাঠী ভাবাবেগে বন্দনাকে সমর্থনের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু পুনের প্রাক্তন মেয়রকে প্রার্থী করতে রাজি হননি এনসিপি প্রধান।
আরও পড়ুন: সংসদের নতুন ডেপুটি চেয়ারম্যানকে শুভেচ্ছা মোদীর
বিরোধী শিবিরে মোদী-অমিত শাহের মতো কোনও নেতা নেই। রাহুল গাঁধী সুযোগটা নিতে পারতেন। কিন্তু তাঁকে সেভাবে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। আপের এক নেতা সরাসরিই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘লোকসভায় মোদীকে আলিঙ্গন করতে পারলেন, আর আমাদের একটা ফোন করতে পারলেন না রাহুল? অথচ এই আপই আস্থা ভোটে হুইপ জারি করে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিতে বলেছিলেন সাংসদদের।
কাশ্মীরে সদ্য বিজেপির সঙ্গে জোট ভেঙেছে পিডিপি। কিন্তু মেহবুবা মুফতিকে ভোটের ময়দানের আনতে পারেনি বিরোধীরা। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগে বিজেপির সঙ্গে জোট ভাঙা অন্ধ্রের টিডিপি ভোট দিলেও সে রাজ্যের আর এক দল ওয়াই এস আর কংগ্রেস বিরত থেকেছে। কংগ্রেস-বিজেপি কেউই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি, এই অভিযোগ তুলে তারা ভোট দেয়নি।
রাজ্যসভায় নিজের আসনে বসছেন নবনির্বাচিত ডেপুটি চেয়ারম্যান। ছবি: পিটিআই
অথচ মঞ্চ প্রস্তুত ছিল শাসক জোটকে বেগ দেওয়ার। ২০১৯-এর আগে জোটবদ্ধ মোদী বিরোধী ঐক্যের চেহারা তুলে ধরার। সে ভাবে কাউকে উদ্যোগীই হতে দেখা গেল না। আঞ্চলিক ছোট দলগুলিকে সম্মান ও গুরুত্ব দেওয়ার বার্তা কেউ দিতে পারলেন না। রাহুল গাঁধীর গা ছাড়া মনোভাব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফেডারেল ফ্রন্ট নিয়ে উদ্যোগী হলেও সামনের সারিতে আসেননি। মায়াবতী, মুলায়ম বা কেউই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিলেন না।
আরও পড়ুন: ‘বিউটি উইথ ব্রেন’ খুঁজছে বিজেপি, ফর্মপূরণ চলছে!
রাজনৈতিক মহল মনে করছে, বিরোধীদের মধ্যে সমন্বয় তো নেই-ই, একে অন্যের প্রতি বিশ্বাসহীনতা, সংশয়, সন্দেহের মতো অনেক বিষয় রয়েছে। আবার অনেকেই মনে করছেন, সকলেই জল মাপছেন। একে অন্যকে সন্দেহের চোখে দেখছে। লোকসভা ভোটের এখনও অন্তত ৭-৮ মাস বাকি। তার মধ্যে রাজনৈতিক হাওয়া অনেক ঘুরে যেতে পারে, অনেক কিছু পট পরিবর্তন হতে পারে। তাই এখনই সামনে চলে এলে ভোটের আগে বা পরে হাওয়া বুঝে অবস্থান বদলালে সাধারণ মানুষের বিরাগভাজন হতে পারেন। সেই আশঙ্কাও ছিল। কিন্তু রাহুল গাঁধীর সেই সমস্যা ছিল না। কিন্তু তিনিই যখন উদ্যোগী হলেন না, তখন আগ বাড়িয়ে ছোট দলের নেতারা এগিয়ে আসতে চাননি।
আবার ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের লড়াই কেমন হতে পারে, তারও ইঙ্গিত মিলে গেল এই ভোটাভুটিতে। সারা দেশে একের বিরুদ্ধে একের লড়াইয়ের যে চেষ্টা চলছে, সেটা তা যে দূর অস্ত, তা কার্যত এখনই বলে দেওয়া যায়। কারণ লোকসভা বা রাজ্যসভায় বিরোধীরা কিছুটা একজোট হলেও নিজের নিজের রাজ্যে রাজনীতির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেই যেমন। কংগ্রেস, তৃণমূল এবং সিপিএম সাংসদরা বিরোধী প্রার্থীকে ভোট দিলেও এ রাজ্যে তিন দল এক ছাতার তলায় এসে লোকসভা ভোটে লড়াই করা কার্যত দিবাস্বপ্ন। অন্যান্য রাজ্যেও এই সমস্যা রয়েছে। সব মিলিয়ে রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচনে লোকসভা ভোটের মুখে আত্মবিশ্বাস আরও খানিকটা বাড়িয়ে নিল মোদী-অমিত শাহ জুটি। অন্যদিকে বিরোধীরা এখনও যে ছন্নছাড়াই, আস্থা ভোটের পর ফের তার প্রমাণ মিলল হাতে হাতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy