Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

এই এক মাস কথা নয়, বলছে সাপুরের দাঙ্গাপীড়িত শিবির

ক’দিন বাদেই অযোধ্যার বিতর্কিত জমি মামলার রায়। এই সন্ধিক্ষণে কী ভাবছেন উত্তরপ্রদেশের সংখ্যালঘুরা? ছ’বছর আগের সাম্প্রদায়িক অশান্তি, যার জেরে ৬২ জনের মৃত্যু এবং অসংখ্য মানুষ গ্রামছাড়া— এখন এই সাপুর, বসিকলা, গাঠওয়ালা নামক গ্রামগুলিতে কথ্য ইতিহাস।

সন্ত্রস্ত সংসার: মুজফ্ফরনগরের শিবিরে। —নিজস্ব চিত্র।

সন্ত্রস্ত সংসার: মুজফ্ফরনগরের শিবিরে। —নিজস্ব চিত্র।

অগ্নি রায়
মুজফ্ফরনগর শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৯ ০২:৩২
Share: Save:

শাহজাহানের সমসাময়িক প্রায় পৌনে চারশো বছরের প্রাচীন এই জনপদের ষাট কিলোমিটার দূরেই শুরু হচ্ছে শিবালিক পর্বতমালা। কিছুটা পাহাড়ি আবহাওয়া তাই এখানকার নিকটাত্মীয়। এই কার্তিক মাসে রোদ ঝলসানো দ্বিপ্রহরেও ঠান্ডা হাওয়ার শনশন মালুম দিচ্ছে।

“যখন শীতকালে খুব হাওয়া চলে, সবাই বাঁশের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। গেল বছরই তো কত তাঁবুর কুটোকাটা উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে।” কিছুটা অভিনয় করেই দেখালেন মহম্মদ সেলিম সিদ্দিক। উত্তরপ্রদেশের মুজফ্‌ফরনগরে ‘দাঙ্গাপীড়িত সংগঠন সমিতি’র হর্তাকর্তা। ডাকনামে যিনি এখানকার সবার ‘সেলিম ভাই’।

ছ’বছর আগের সাম্প্রদায়িক অশান্তি, যার জেরে ৬২ জনের মৃত্যু এবং অসংখ্য মানুষ গ্রামছাড়া— এখন এই সাপুর, বসিকলা, গাঠওয়ালা নামক গ্রামগুলিতে কথ্য ইতিহাস। বাইরে থেকে অপার শান্তি এবং ততোধিক বিনবিনে মাছি প্রবহমান এখানকার স্থায়ী-অস্থায়ী দাঙ্গাপীড়িত শিবিরগুলিতে। নিকাশির অভাবে জমে থাকা আবর্জনা, জল, কাদা, ঘুঁটের স্তূপে বাচ্চারা নেচেকুঁদে বেড়াচ্ছে প্রায় দিগম্বর হয়ে। বাইরে থেকে গাড়ি ঢোকার পর স্বাভাবিক ভাবেই তাদের কৌতূহলী ভিড়। পায়ে পায়ে বেড়ে ওঠা সেই ভিড়ে সামিল বয়স্করাও।

আরও পড়ুন: তিনমূর্তি ভবন থেকে ঘাড়ধাক্কা খেল কংগ্রেস

একটু রয়ে সয়ে, দু’এক গ্লাস চা-পানি শেষ করার পর বোঝা যাচ্ছে, এই আপাত শান্তির মধ্যে চোরা আতঙ্ক এমন ভাবে মিশে রয়েছে যে, এক নজরে তাদের আলাদা করে বোঝা মুশকিল। ২০১৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাত থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল মুজফ্‌ফরনগরের গ্রামগুলিতে। যার সূত্রপাত, তার দিন দশেক আগে মালিকপাড়া গ্রামের একটি হিন্দু মেয়েকে পাশের কাওয়াল গ্রামের শাহনাওয়াজ নামের এক যুবকের শ্লীলতাহানি করা সংক্রান্ত অভিযোগ ঘিরে। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে তার কী প্রভাব পড়েছিল, বা জাঠ, দলিত, ঠাকুর, ব্রাহ্মণ সবাই রাতারাতি নিজেদের প্রজন্মবাহিত ঝগড়া স্থগিত রেখে একই হিন্দুত্বের ছাতার তলায় এসে কী ভাবে সে সময় গোটা দেশে মেরুকরণের প্রতীকী সলতে পাকিয়েছিলেন, তা বহু আলোচিত এবং বিতর্কিতও বটে। তৎকালীন অখিলেশ যাদব সরকার এর পর তড়িঘড়ি অশান্তিপীড়িত গ্রামগুলি থেকে সংখ্যালঘুদের এনে এই সাপুরের ভুট্টাখেত সংলগ্ন বিশাল ফাঁকা ভূখণ্ডে অস্থায়ী শিবির তৈরি করে দেয় চট, চাটাই, প্লাস্টিকের শিট আর বাঁশ দিয়ে।

এখন সেখানে কয়েকটা পাকা বাড়ি, কিছু অস্থায়ী বিপণি তৈরি হয়েছে। বাকি, তথৈবচ। বেশ কিছু পরিবারকে অখিলেশ সরকার পাঁচ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। কোনও কোনও পরিবারে চার-পাঁচ ভাই-এর যৌথ সংসার। ফলে, যাঁরা যেমন ভাবে পেরেছেন পারিবারিক রাজনীতি করে একে অন্যকে ফাঁকি দিয়েছেন। কেউ পাকা বাড়ি তুলতে পেরেছেন। যাঁরা পারেননি, তাঁদের হাল এই ছ’বছরেও ত্রাণ শিবিরের বেশি কিছু নয়। গাঁয়ে ফেলে আসা জমিও নামমাত্র দামে বিক্রি করেছেন অনেকে। যাঁরা অপেক্ষাকৃত লেখাপড়া জানা এবং চালাক চতুর, তাঁরা পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর ভাল দাম আদায় করেছেন। কিন্তু পুরনো গ্রামে কেউই ফিরে যাননি সেই আতঙ্কের জেরে এবং রক্তচক্ষুর ধারাবাহিক প্রদর্শনীতে।

“যোগী সরকারের কোনও নেতা বা বিধায়ক এই নরকে এসে ডাক-খোঁজ নেবেন, এটা আমরা আশাও করি না।” বললেন সেলিম ভাই। আসলে যোগী সরকার যেন খোঁজখবর একটু কমই নেয়, এটাই এখন চাইছেন এখানকার বাসিন্দারা! শিবির থেকে বেরিয়ে বেশি দূরে যেতেও যাঁদের আতঙ্ক। “বাড়ির বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানোর জন্য কয়েক কিলোমিটার দূরের পাল্লিগাঁও থেকে গাই কিনে নিয়ে আসছিল আমাদের এক দোস্ত সাজিদ। যার থেকে কিনেছে সে নিজেই গোরক্ষকদের ফোন করে জানায়, তার সন্দেহ জবাই করার জন্যই নাকি এই খরিদ্দারি! ফলস্বরূপ, বেধড়ক মারধর, গরু কেড়ে নিয়ে আবার বিক্রেতাকে ফেরত। গো বিক্রেতার পুরোটাই লাভ। আর প্রাণটুকু নিয়ে সে রাতে সাপুরে ফেরে সাজিদ।” বললেন উল্টো দিকে মোড়ায় উবু হয়ে বসা প্রবীণ কামাল তারিফ। তাঁর কথায়, “তার পর থেকে আমরা মুজফ্‌ফরনগরের সদরেও যাই সাবধানে। হাটে কাপড় বেচতে গেলেও চোর অপবাদ দিয়ে পেটাই করার ঘটনা অনেক রয়েছে।”

পায়ে পায়ে হেঁটে মহল্লার ভিতরে ঢুকে দেখা গেল আক্ষরিক অর্থেই দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘুপচিতে যেন পুতুলের সংসার। একটি তাঁবুতে একটিমাত্র খাটিয়া। তাতে কত জন শোয় তা হিসেব করতে চাওয়া বাতুলতা। এটা চাক্ষুষ করাই যথেষ্ট যে দিনের বেলায় খাটিয়াটি বের করে আনা হয় বাইরে। কারণ তখন ভিতরটা তখন হয়ে যায় রান্নাঘর! “এমনিতে আমাদের কোনও কিছুতে পরোয়া ছিল না, বুঝলেন। কারণ, দেখতেই পাচ্ছেন, এর থেকে আর কী খারাপ থাকব! তবে জানের ভয়টা তো থেকেই যাচ্ছে। শুধু বিজেপি কেন, সবাই আমাদের নিয়ে রাজনীতি করছে। এখন মুখে মুখে যত দূর পারছি, আশপাশের গাঁয়েও বলছি এই মাসটা একদম কোথাও মুখ না খুলতে। অযোধ্যায় মন্দির-মসজিদ যা-ই হোক, এখান থেকে কোনও আওয়াজ যেন না বেরোয়। আমরা ঘরপোড়া গরু।” বললেন কামরুল হুদা। তিনি আর তাঁর বিবি পাশের গ্রামের আলু-বেগুন খেতে ঠিকে কাজ করে দৈনিক মজুরি পান।

মসজিদের জমি নয় ওই আলু-বেগুন খেতের ছটাক জমিতে যেন আগুন না ধরে— এর চাইতে অধিক চাওয়াপাওয়া নেই আর মুজফফরনগরের এই গ্রামচরিতমানসে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE