Advertisement
E-Paper

‘চৌকিদারের’ ঘর থেকেই চুরি! উধাও রাফাল-চুক্তির নথি

রাফাল নিয়ে নতুন করে তদন্তের আর্জি ঠেকাতে আজ সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রের অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপাল দাবি করেন, রাফাল চুক্তি সংক্রান্ত ফাইল চুরি হয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৯ ০৩:৪৫
রাফাল চুক্তিতে নতুন করে তদন্তের দাবি ঠেকাতে গিয়ে দেশের শীর্ষ আদালতে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের তরফে যে দাবি করা হয়েছে তাতে কার্যত নতুন অস্ত্র এসে গেল বিরোধীদের হাতে। ছবি: এপি।

রাফাল চুক্তিতে নতুন করে তদন্তের দাবি ঠেকাতে গিয়ে দেশের শীর্ষ আদালতে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের তরফে যে দাবি করা হয়েছে তাতে কার্যত নতুন অস্ত্র এসে গেল বিরোধীদের হাতে। ছবি: এপি।

নরেন্দ্র মোদী নিজেকে বলেন, দেশের ‘চৌকিদার’। এ বার দেশের শীর্ষ কোর্টে দাঁড়িয়ে সেই চৌকিদারের সরকারই জানাল, রাফাল চুক্তির ফাইল ‘চুরি’ হয়ে গিয়েছে!

রাফাল চুক্তির ফাইল থাকার কথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে। যার দফতর সাউথ ব্লকে। ওই একই ভবনে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর এবং বিদেশ মন্ত্রকের অফিস। এমন সুরক্ষিত জায়গা থেকে রাফাল চুক্তির ফাইল চুরি মানে তো চৌকিদারের নাকের ডগা থেকে চুরি! যা শুনে বিস্মিত বিচারপতিরাও।

রাফাল চুক্তিতে নতুন করে তদন্তের দাবি ঠেকাতে গিয়ে দেশের শীর্ষ আদালতে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের তরফে এমন দাবি কার্যত নতুন অস্ত্র তুলে দিয়েছে বিরোধীদের হাতে। রাফাল চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করে গত বছর থেকেই সরব রাহুল স্লোগান তুলেছেন, ‘চৌকিদারই চোর’! এ দিন রাহুলের অভিযোগ, দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে, প্রমাণ লোপাট করতেই সরকার এই দাবি করছে। কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালার কথায়, ‘‘চৌকিদার তো চুরি করেছেন। এখন চৌকিদারের নাকের ডগা থেকেও চুরি হচ্ছে! এটি পুরোটাই ‘কভার আপ’ অপারেশন। যে ভাবে যাবতীয় আপত্তি উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী রাফাল নিয়ে অনিয়ম করেছেন, তা এখন স্পষ্ট। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রাথমিক অভিযোগ দেখা যাচ্ছে। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে অবিলম্বে তদন্ত শুরু হওয়া দরকার।’’ সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরিরও যুক্তি, এ বার মোদীর বিরুদ্ধে এফআইআর হতেই হবে।

রাফাল চুক্তি নিয়ে বিতর্কের আবহে চুক্তির ফাইলের বেশ কিছু অংশ সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে, রাহুল গাঁধী যেমন রাফাল চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তেমনই প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অন্দরমহল থেকেও আপত্তি উঠেছিল। রাফাল চুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নাক গলানো নিয়েও আপত্তি ওঠে। যে আপত্তির কথা জানতেন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকরও। কিন্তু সব আপত্তি নাকচ করে দেওয়া হয়। এই ফাইলকে অস্ত্র করেই সুপ্রিম কোর্টে দাবি ওঠে, রাফাল চুক্তিতে তদন্তের দাবিতে মামলায় আদালতের রায়ের পুনর্বিবেচনা হোক। কারণ এর আগে কোর্ট সেই দাবি নাকচ করে দেয়।

রাফাল নিয়ে নতুন করে তদন্তের আর্জি ঠেকাতে আজ সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রের অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপাল দাবি করেন, রাফাল চুক্তি সংক্রান্ত ফাইল চুরি হয়েছে। এর পরেই রাহুল গাঁধী দাবি তোলেন, ‘‘এ বার প্রধানমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় তোলার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। দুর্নীতি তাঁকে দিয়েই শুরু হচ্ছে, তাঁকে দিয়েই শেষ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে দোষারোপ করা গুরুত্বপূর্ণ রাফাল ফাইল এখন চুরি হয়ে গিয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। এটা আসলে প্রমাণ লোপাট ও কভার-আপ।’’ রাহুলের দাবিকে সমর্থন জানান তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন এবং সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি।

সাউথ ব্লকের মতো সুরক্ষিত জায়গা থেকে রাফাল ফাইল চুরি গিয়েছে শুনে বিচারপতিরাই চমকে যান। এক মাস আগে ওই ফাইলের তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ প্রশ্ন তোলেন, ‘‘কবে, এক মাস আগে? কী করেছেন?’’ বেণুগোপাল জানান, তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতি জানতে চান, তার পরে কী হয়েছে! বিচারপতি সঞ্জয় কিষেণ কউল মন্তব্য করেন, নথি চুরি হয়ে গেলে সরকারের নিজের ঘর সামলানো উচিত। ইয়েচুরির মন্তব্য, যে সরকার প্রতিরক্ষা চুক্তির ফাইল সুরক্ষিত রাখতে পারে না, তার হাতে দেশের সুরক্ষা কী ভাবে ছেড়ে দেওয়া যায়!

কেন্দ্রের দাবি, চুরি যাওয়া ‘গোপন ফাইল’ প্রকাশ করে সরকারি গোপনীয়তা আইন বা ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ লঙ্ঘন করেছে ‘দ্য হিন্দু’ সংবাদপত্র। কেন্দ্রের আইনজীবীর এই মন্তব্যকে কার্যত হুঁশিয়ারি হিসেবেই দেখছেন বিরোধীরা। তাঁদের যুক্তি, সরকার বোঝাতে চাইছে, সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনও তথ্য ফাঁস হলেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারের আরও যুক্তি, প্রতিবারই শুনানির আগে একটি খবর প্রকাশ করে আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হচ্ছে। এটা আদালত অবমাননার সামিল।

‘হিন্দু পাবলিশিং গ্রুপ’-এর চেয়ারম্যান এন রাম জানিয়ে দিয়েছেন, সরকার একে চুরি বলতেই পারে। কিন্তু কোন সূত্র থেকে ওই নথি মিলেছে, তা জানানো হবে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইটারে বলেন, ‘‘গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের প্রবীণ এবং শ্রদ্ধেয় সম্পাদকদের অন্যতম এন রামকে ভয় দেখানোর জন্য বিজেপি সরকারের তীব্র নিন্দা করছি। সাংবাদিকদের ভয় দেখাতে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’-এর ব্যবহার লজ্জাজনক।’’

রাফাল রায়ের পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়ে প্রশান্ত ভূষণ, অরুণ শৌরি, যশবন্ত সিন্হারা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। প্রশান্ত ভূষণ সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হওয়া তথ্য বিচারপতিদের দিতে গেলে আপত্তি তোলেন এজি। তিনি বলেন, ‘দ্য হিন্দু’ সংবাদপত্র ফাইলের উপরে ‘সিক্রেট’ লেখা অংশ বাদ দিয়ে তা ছেপে আইন ভেঙেছে। এখনও এফআইআর করা হয়নি। কারণ ওই এফআইআর-এ তিন মামলাকারী, অর্থাৎ যশবন্ত, অরুণ ও প্রশান্ত ভূষণেরও নাম থাকবে।

রাফাল নিয়ে মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে তুলে ধরতে চেয়ে বেণুগোপালের বক্তব্য, আদালতের প্রতিটি মন্তব্যকে ব্যবহার করা হবে সরকারকে অস্থির করার জন্য। তাতে কোর্ট কেন অংশ নেবে? সেই জন্যই কোর্টকে এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ রাখতে আর্জি জানান তিনি।
বেণুগোপালের দাবি, এই সব নথিতে সুপ্রিম কোর্টের নজর দেওয়াই উচিত নয়। কারণ এই সব নথির সূত্র জানানো হয়নি। নথির প্রাসঙ্গিকতা একমাত্র বিচার্য বিষয় হতে পারে না। প্রধান বিচারপতি পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, যদি কোনও অভিযুক্ত তাঁর সততা প্রমাণে নথি চুরি করে কোর্টকে দেয়, তা হলে কি আদালত তা দেখবে না?

বেণুগোপাল দাবি করেন, মামলাকারীদের জানাতে হবে, অবসরপ্রাপ্ত না কর্মরত— কোন অফিসার এই নথি ফাঁস করেছেন। ভূষণ যুক্তি দেন, এর আগে দুর্নীতি মামলায় তিনি প্রাক্তন সিবিআই ডিরেক্টর রঞ্জিত সিন্হার বাড়ির রেজিস্ট্রার ও টু-জি সংক্রান্ত নথি আদালতে দিয়েছেন। দুর্নীতি ফাঁস করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের থেকেই তিনি সে সব পেয়েছিলেন। আদালত সেই নথির উপরে ভিত্তি করে রায়ও দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ নথিই তিনি সংবাদমাধ্যম থেকে পেয়েছেন একটি মাত্র নথি প্রতিরক্ষা মন্ত্রক থেকে পেয়েছেন বলে জানান ভূষণ। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, ১৪ মার্চ এ বিষয়ে ফের শুনানি হবে।

Rafale Rafale Documents Supreme Court
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy