ইন্ডিগো সংস্থার একের পর এক উড়ান বাতিল। শুক্রবারের পরে শনিবারও একই পরিস্থিতি দেশ জুড়ে। যাত্রীদের ভোগান্তি অব্যাহত। অবস্থা বুঝে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায়ের অভিযোগ উঠেছে দেশের অন্য বিমান সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে। এই পরিস্থিতিতে কড়া পদক্ষেপ করল কেন্দ্র। শনিবার ইন্ডিগো সংস্থাকে তারা নির্দেশ দিয়ে জানাল, রবিবার রাত ৮টার মধ্যেই বাতিল হওয়া উড়ানের টিকিটের টাকা ফেরাতে হবে যাত্রীদের। অন্য সংস্থাগুলি যাতে ইচ্ছামতো ভাড়া নিতে না-পারে, সেই নিয়েও তৎপর কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না-হওয়া পর্যন্ত বিমানের ভাড়া বেঁধে দিয়েছে তারা। সূত্রের খবর, ইন্ডিগো সংস্থার সিইও পিটার এলবার্সের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর।
শুক্রবার সারা দেশে ইন্ডিগো সংস্থার অন্তত এক হাজার উড়ান বাতিল হয়েছিল। শনিবার সেই সংখ্যাটা কমছে। ইন্ডিগো সংস্থার তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, শনিবার রাত পর্যন্ত প্রায় ৮৫০টি উড়ান বাতিল হয়েছে। বিপাকে পড়ে দিশাহারা অবস্থা যাত্রীদের। বিশেষত যাঁদের চিকিৎসা বা পড়াশোনার জন্য ভিন্রাজ্যে যাওয়ার কথা, তাঁদের অবস্থা শোচনীয়। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ইচ্ছামতো ভাড়া হাঁকিয়েছে অন্য বিমান সংস্থাগুলি। বাধ্য হয়ে কিছু যাত্রী দ্বিগুণ, তিন গুণ দামে সেই টিকিট কেটে পৌঁছেছেন গন্তব্যে। কেউ আবার গিয়েছেন ট্রেনে বা বাসে। সময়ে গন্তব্যে পৌঁছোতে পারেননি তাঁরা। যাত্রীদের সুবিধার জন্য অতিরিক্ত ট্রেন চালাচ্ছে ভারতীয় রেল। তবে যাত্রীদের একাংশের অসন্তোষ, এত দেরিতে কেন করা হচ্ছে পদক্ষেপ।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত যতগুলি উড়ান বাতিল হয়েছে, সেগুলির টিকিটের টাকা রবিবার রাত ৮টার মধ্যে ফেরাতে হবে যাত্রীদের। এ জন্য যাত্রীদের যেন তাগাদা দিতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। যত দিন না পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হচ্ছে, তত দিন ‘অটোমেটিক রিফান্ড’ ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে।
মন্ত্রকের তরফে বিবৃতিতে আরও জানানো হয়েছে, যে যাত্রীরা এই বিভ্রাটের কারণে যাত্রার দিন বদলাতে বাধ্য হয়েছেন (রিসিডিউল), তাঁদের থেকে বাড়তি টাকা আদায় করতে পারবে না ইন্ডিগো সংস্থা। অনেক সময়েই যাত্রীরা মালপত্র ইন্ডিগো কর্মীদের কাছে জমা দিয়েছেন। তার পরে দেখা গিয়েছে, সেই উড়ান বাতিল হয়েছে বা অনেক দেরিতে ছাড়ছে। এ সব ক্ষেত্রে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যাত্রীদের কাছে মাল ফেরানোর নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রক। যত দিন এই অব্যবস্থা চলবে, তত দিন যাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কথাও সংস্থাকে বলা হয়েছে। অন্য দিকে, সূত্রের খবর, ইন্ডিগোর সিইও এলবার্সের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর। দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কথা বলা হয়েছে। তিনি এ জন্য ১০ দিন সময় চেয়ে নিয়েছেন বলে খবর।
কড়া অবস্থান
শনিবার ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কড়া পদক্ষেপ করেছে কেন্দ্র। অতিমারির পরে এই প্রথম বার। কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক বিমান ভাড়া বেঁধে দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, যাত্রীদের স্বার্থেই এই পদক্ষেপ করা হয়েছে। যত দিন না ইন্ডিগো সংস্থার বিমান পরিষেবা পুরোপুরি স্বাভাবিক হচ্ছে, তত দিন এই ব্যবস্থা থাকবে। ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বে সর্বোচ্চ ৭,৫০০ টাকা, ৫০০ থেকে ১০০০ কিলোমিটার দূরত্বে সর্বোচ্চ ১২ হাজার টাকা ভাড়া বাবদ নিতে পারবে বিমান সংস্থাগুলি। ১০০০-১৫০০ কিলোমিটার দূরত্বে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা, ১৫০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার টাকা ভাড়া নিতে পারবে। যদিও যাত্রীদের একাংশের প্রশ্ন, এত দেরিতে কেন এই পদক্ষেপ করা হল।
আরও পড়ুন:
পাইলটদের একাংশের প্রশ্ন
ইন্ডিগো-বিভ্রাটে লাগাম পরাতে শুক্রবার পাইলট এবং বিমানকর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট শ্রমবিধি আংশিক শিথিল করেছে কেন্দ্র। কিন্তু কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পাইলটদের একটি সংগঠন। এয়ারলাইন্স পাইলটস অ্যাসোসিয়েশন (আলপা) নামের ওই সংগঠন প্রশ্ন তুলেছে যে, কেন শুধুমাত্র ইন্ডিগোর সুবিধা করে দিতেই নিয়মবিধি শিথিল করা হল? এর ফলে লক্ষ লক্ষ যাত্রীকে ঝুঁকির মুখে ফেলা হচ্ছে বলে দাবি করেছে ওই সংগঠনটি। প্রসঙ্গত, এর আগে পাইলটদের এই সংগঠনটিই অভিযোগ করেছিল যে, বিধি শিথিল করতে কেন্দ্রকে বাধ্য করার কৌশল নিয়েছিল ইন্ডিগো। সেই কারণেই বিমান পরিষেবা ব্যাহত হলেও ইন্ডিগো কোনও কার্যকর পদক্ষেপ করেনি বলে দাবি করে তারা।
বিমানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
শনিবার দিল্লির বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের তরফে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছে, ইন্ডিগোর বিমান পরিষেবা ধীরে ধীরে সচল হচ্ছে এবং স্বাভাবিক হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। বিমান যাত্রীদের অসুবিধা লাঘব করতে দেশ জুড়ে ৩৭টি ট্রেনে অতিরিক্ত ১১৬টি কামরা যুক্ত করেছে রেল। কী কারণে এই বিভ্রাট, তা অনুসন্ধান করতে ইতিমধ্যেই উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে দেশের উড়ান নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিজিসিএ। অন্য দিকে কেন্দ্রের অসামরিক বিমান পরিবহণমন্ত্রী কে রামমোহন নায়ডু রীতিমতো হুঁশিয়ারির সুরে জানিয়েছেন, যাঁরা এই বিভ্রাটের জন্য দায়ী, তাঁদের মূল্য চোকাতে হবে।
প্রতি দিন দেশে প্রায় ২,২০০ বিমান চালায় ইন্ডিগো। শুক্রবার অন্তত হাজারটি বিমান বাতিল হয়েছে। ইন্ডিগোর বিমান পরিষেবা ব্যাহত হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে কেন্দ্রের একটি বিধি। ‘ফ্লাইট ডিউটি টাইম লিমিটেশন্স’ নামের ওই বিধিতে বলা হয়েছিল, প্রতি সপ্তাহে পাইলট এবং বিমানকর্মীদের বিশ্রামের জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় দিতে হবে। প্রতি সপ্তাহে মাত্র ২টি বিমান রাতে অবতরণ করাতে পারবেন এক জন পাইলট (আগে সংখ্যাটা ছিল ৬)। তা ছাড়া ওই বিধিতে বলা হয়, পাইলট এবং বিমানকর্মীদের পর পর দু’দিন নাইট ডিউটি দেওয়া যাবে সপ্তাহে এক বারই। ২০২৪ সালের জুনেই এই বিধি কার্যকর করার কথা ছিল। কিন্তু বিমানসংস্থাগুলির অনুরোধে তা বার বার পিছিয়ে যায়। সম্প্রতি নতুন বিধি কার্যকর করার জন্য ডিজিসিএ-কে নির্দেশ দেয় দিল্লি হাই কোর্ট। জুন এবং নভেম্বরে দুই দফায় ধাপে ধাপে নির্দেশিকায় থাকা নিয়মাবলি কার্যকর করার পথে হাঁটে ডিজিসিএ।
ইন্ডিগো তুলনায় সস্তায় বিমান পরিষেবা দিয়ে থাকে যাত্রীদের। পরিষেবা দেওয়ার সংখ্যা বিচার করলে এয়ার ইন্ডিয়ার তুলনায় অনেক এগিয়ে রয়েছে ইন্ডিগো। দেশের ৯০টি এবং বিদেশের ৪৫টি বিমানবন্দরে পরিষেবা দিয়ে থাকে তারা। ইন্ডিগোর অনেক বিমানই রাতে অবতরণ করে। তাই নয়া বিধিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে এই বিমানসংস্থাই। নয়া বিধি মেনে পরিষেবা স্বাভাবিক রাখতে যত সংখ্যক কর্মী এবং পাইলট প্রয়োজন, বর্তমানে তা ইন্ডিগোর নেই। পাইলট এবং কর্মী অপ্রতুলতার কথা স্বীকার করে ইতিমধ্যেই যাত্রীদের কাছে একাধিক বার ক্ষমাও চেয়েছে ইন্ডিগো।