‘পথের পাঁচালী’ সিনেমায় ‘দুর্গা’
বিএ পাশ করার পর কিছু দিন শিক্ষকতা করেছিলেন।
এ দিকে ঠায় এক জায়গায় বসে কোনও কাজ করা তো তাঁর ধাতে নেই।
ভেতরে ভেতরে নতুন কোনও জায়গা দেখার ইচ্ছেটা বরাবরই তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
তিনি যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়!
হয়তো’বা অনেকটা সেই কারণেই এক জমিদারের সেরেস্তায় চাকরি নিলেন।
আসলে সেই জমিদারির একটি বিস্তীর্ণ অংশ ছিল ভাগলপুরের বনাঞ্চল। বিভূতিভূষণের কাজ ছিল ওই বনভূমিরই জমি-জিরেত তদারকি।
ভেবেছিলেন, এমন চাকরি নিলে দেশও দেখা হবে, প্রকৃতির মধ্যেও থাকা যাবে।
অথচ তা আর হচ্ছে কই!
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ওই পাথুরে বনাঞ্চলের রুখা-সুখা প্রকৃতিতে কাটাতে কাটাতে মাঝে মাঝেই হাঁফিয়ে উঠছিলেন।
অনেকটা একঘেয়েমি কাটাতেই শুরু করলেন লেখালেখি। লেখা যত এগোচ্ছিল ততই ভেতরে ভেতরে কী যেন বদল অনুভব করছিলেন তিনি! ওই রুক্ষ প্রকৃতিই ধীরে ধীরে তাঁর মধ্যে মায়া-সুর ছড়াল।
পরে বিহারের এই পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে তিনি তাঁর ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে লিখেছিলেন, ‘‘দিন যতই যাইতে লাগিল এই জঙ্গলের মোহ ততই আমাকে ক্রমে পাইয়া বসিল। এই নির্জনতা ও অপরাহ্ণের সিঁদুর ছড়ানো বন-ঝাউয়ের জঙ্গলের কী আকর্ষণ আছে, বলতে পারি না।’’
একঘেয়েমি কাটাতে লিখতে বসেছিলেন। পাঁচশো পাতা লিখে শেষও করলেন। নাম দিলেন ‘পথের পাঁচালী’।
স্থির করলেন ছাপার আগে একবার পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে যাবেন। আশীর্বাদ নেবেন তাঁর।
সেইমতো সেরেস্তা থেকে ছুটি নিয়ে ভাগলপুরে এলেন। তার পর কলকাতা যাবেন। কলকাতা থেকে সোজা গুরুদেবের কাছে। হাতে অঢেল সময়।
স্থির করলেন ভাগলপুরে একদিন থেকে পরের দিন ট্রেন ধরবেন। বিকেলে একা একাই জনবিরল রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
হঠাৎ দেখলেন সেই নির্জন পথে দাঁড়িয়ে একটি আট-দশ বছরের মেয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে। বিভূতিভূষণও দেখছেন কিশোরী কন্যাটিকে।
বন্ধু যোগেন্দ্রনাথ সিংহকে পরে বলেছিলেন, ‘‘মাথার চুল উস্কো-খুস্কো, চোখে উদ্দেশহীন চাহনি, অথচ মুখে দুষ্টুমির চিহ্ন। মনে হয় স্কুল থেকে পালিয়েছে, নয়তো বাড়ি থেকে মেরে তাড়িয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে নতুন কিছু দুষ্টুমির মতলব আঁটছে।’’
তাঁর মনে হয়েছিল ওই কিশোরী কন্যার দু’চোখের ভেতর এক ব্যথাভরা জগৎ লুকিয়ে।
আর গেলেন না রবিঠাকুরের কাছে। সে দিনই ফিরে এলেন জমিদারির সেরেস্তায়। মনে হয়েছিল, এই মেয়েটিকে তিনি যদি তাঁর উপন্যাসে ঠাঁই না দেন, সে লেখা হবে ব্যর্থ এবং নিষ্প্রাণ। পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে ফেললেন।
ডায়েরিতে তাঁর বর্ণনা পাওয়া যায়—
‘‘মেয়েটিকে নিয়ে নতুন করে আবার লিখতে বসলাম। সেই মেয়েটিই পথের পাঁচালি-র দুর্গা।’’
•
অনাড়ম্বর প্রকৃতির মধ্যে প্রান্তিক মানুষজন তাঁকে খুব টানত।
সে বার যোগেন্দ্রনাথ সিংহের ডাকে সারান্ডার জঙ্গলে গিয়েছেন। পথে থলকোবাদ ক্যাম্পে থাকলেন। তার পর সারান্ডা।
ফিরতি পথে একটি অত্যন্ত দুর্গম রাস্তা পার করতে হবে। যেখানে বাঘ, হাতির নিত্য আনাগোনা। গভীর জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ দেখেন একটি হো বালক দাঁড়িয়ে পাতার ঝুপড়ি পাহারা দিচ্ছে।
তার সঙ্গে কথা বলে বিভূতিভূষণ এতটাই মুগ্ধ, বিহ্বল, উদাস হয়ে পড়লেন যে, আচমকা বনের মধ্যে একা একা হাঁটতে শুরু করে দিলেন।
সঙ্গী যোগেন্দ্রনাথ যত বলেন এমন ঘন জঙ্গলে যে কোনও সময় বিপদ হামলে পড়তে পারে, বিভূতিভূষণের একটাই কথা, ‘‘হাতি আমাকে ও আপনাকে সকলকে মেরে ফেলুক; সমস্ত পৃথিবী জনশূন্য হয়ে যাক। কিন্তু যত দিন পর্যন্ত এই পৃথিবীতে একটি হো-ও বেঁচে থাকবে, তত দিন পর্যন্ত মানুষ অমর থাকবে।’’
প্রকৃতিকে চেটেপুটে নিতে গিয়ে কত বার যে বিপদে পড়েছেন!
তবু তাঁর অভিযান থামেনি।
কুড়ে, কেজো, ছকে ফেলা বাঙালি তরুণদের তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না।
চাঁদের পাহাড়-এর শংকরকে দেখুন। কী ভাবে গেঁথেছিলেন তাঁকে!
অজ গাঁয়ের অত্যন্ত নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে হয়েও বিভূতিভূষণ তাঁর মধ্যে বুনে দিয়েছিলেন পৃথিবীকে দু’চোখ ভরে দেখার নাছোড় স্বপ্ন।
বলেছিলেন,‘‘অন্য দেশের ছেলেদের পক্ষে যা ঘটতে পারে, বাঙালির ছেলের পক্ষে তা ঘটা অসম্ভব। তারা তৈরি হয়েছে কেরানি, স্কুলমাস্টার, ডাক্তার বা উকিল হবার জন্য। অজ্ঞাত অঞ্চলের অজ্ঞাত পথে পাড়ি দেওয়ার আশা তাদের পক্ষে নিতান্তই দুরাশা।’’
কিন্তু শংকর পেরেছিল।
বিভূতিভূষণ পারিয়েছিলেন।
সে কেজো বাঙালির সমস্ত মধ্যবিত্ত ভয়-দ্বিধাকে সরিয়ে চলে গিয়েছিল সুদূর আফ্রিকার ভয়াল অরণ্যে।
প্রাগৈতিহাসিক কালে সেই জায়গাটির নাম ছিল জিম্বারি; সেখানে টাঙ্গানিয়াকা, মেওয়ানজা হ্রদ, ট্যাবারো, কঙ্গো নদী, রিখ্টারসভেল্ড পর্বতমালা, আর সীমাহীন ট্রপিকাল অরণ্য। সেই গভীর অরণ্য ঢাকা এলিফ্যান্ট ঘাসে।
আর সারা বন জুড়ে ইউকা, ফার্ন আর বাবলা গাছ। তারই মাঝে বিচিত্র বর্ণের অর্কিড, টকটকে লাল ইরিথ্রিনা লতার ফুল।
আর ছিল নরখাদক বাঘ, সিংহ, হায়না, ভীষণ রোডেশিয়ান মনস্টার এবং অরণ্যের অজ্ঞাত বিভীষিকা অতিকায় বুনিপ।
অরণ্যের গভীরে সূর্যাস্তের রং, জ্যোৎস্না রাত্রির মায়া দু’চোখে মেখে সত্যিই একদিন শংকরের মনে হয়েছিল জীবনে হিরে, অর্থ সব মিথ্যে এই অসীম প্রকৃতির কাছে!
•
ঘরকুনো মানুষদের রবীন্দ্রনাথ নিতান্তই জড়প্রকৃতির মনে করতেন। আর বিভূতিভূষণ মনে করতেন, এর জন্য দায়ী অশিক্ষা। গ্রামজীবনের দূরত্ব, তার উপরে ধর্ম, অনুশাসন, অজ্ঞতার সংকীর্ণ গন্ডিতে থাকতে থাকতে চলমান জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে, এই-ই হয়। বলতেন, অতি বৈষয়িক মানুষ কোনও দিন কোনও অনন্ত যাত্রাপথের সঙ্গী হতে পারে না।
এই অনন্ত যাত্রাপথ যে তাঁর কাছে কী বিচিত্র হয়ে এক-এক সময় দেখা দিয়েছে!
বাংলাদেশ। কক্সবাজার। সেখানে কাউখালি নামের ছোট্ট একটি নদী। সে নদী যেখানে সমুদ্রে এসে মিশেছে, বিভূতিভূষণের ইচ্ছে হল সেখানে যাবেন।
একটি নৌকো বা সাম্পান ভাড়া করলেন। মাঝি বলল, ‘‘কত দূর যাবেন বাবু?’’
‘‘অনেক দূর, চলো সমুদ্রের মধ্যে, সন্ধের পর ফিরব।’’
দূরে সমুদ্রের ভেতরে একটি খাড়া পাহাড়। মাঝির কাছে শুনলেন, পাহাড়ের মাথায় আদিনাথ শিবের মন্দির। বিখ্যাত তীর্থস্থান।
তীর্থ তাঁকে টানল না।
ঘাটশিলায় গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য ও বিভূতি দত্তর মাঝে
বরং আদিনাথ পাহাড়ের কিছু দূরে একটা বড় চড়ার মতো কী যেন!
চোখ গেল সে দিকে।
মাঝির কাছে শুনলেন, ওখানে একটি দ্বীপ আছে। সোনাদিয়া। ভাঁটার পরে ওখানে নাকি অনেক কড়ি, শাঁখ, ঝিনুক পড়ে থাকে।
শুনে খুব লোভ হল।
‘‘চলো সোনাদিয়া।’’
মাঝি কিছুতেই যাবে না। বিভূতিও সহজে ছাড়ার পাত্র নন। তখন প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। ওখানে গিয়ে শেষ বিকেলে জোয়ার এলে বিপদ আছে।
কে শোনে কার কথা!
যেতেই হল শেষে।
তিনি তখন যেন আর শুধুই বিভূতি নন, তাঁর ‘অপু’ও! মাধবপুরের গ্রামের বাঁশবাগানের মাথায় তুঁতে রঙের মেঘের পাহাড় দেখে যে অপু খালি ভাবত ওই মেঘের ভেতরে অজানা ডুবোপাহাড়ের গায়ে লাগা গুগলি, শামুক খেতে খেতে সেও একদিন কোনও নাবিকের মতো অকূল দরিয়ায় পাড়ি দেবে, সেই অপু!
নয় কি?
ভাসাও পানসি চলো সোনাদিয়া!
বর্ণানায় বিভূতিভূষণ লিখছেন, ‘‘সাম্পান সাগর বেয়ে চলেছে। বিকেল পাঁচটা। সমুদ্রের বুকে সূর্য ডুবুডুবু, হুহু খোলা হাওয়া কাউখালির মোহনা দিয়ে ভেসে আসছে, আদিনাথ পাহাড়ের মাথায় অস্তসূর্যের সোনা রোদ। মনে হয় যেন কত কাল ধরে সমুদ্রের বুকে ভাসছি, দূরে সাউথ সি দ্বীপপুঞ্জের অর্ধচন্দ্রাকৃতি সাগরবেলা, যা ছবিতে ছাড়া কখনও দেখিনি— তাও যেন অনেক নিকটে এসে পৌঁছেছে...।’’
দ্বীপে গিয়ে বসে আছেন, তো বসেই আছেন। চারপাশে টলটলে জল। রাঙা আকাশে মেঘের সারি। গাছগাছালির ফাঁকে আলোআঁধারির মায়া। সব মিলিয়ে তাঁকে যেন অবশ করে দিয়েছে।
প্রায় ঘন্টা খানেক বাদে বিপদ শিয়রে বুঝে মাঝি আর থাকতে না পেরে বলল, ‘‘বাবু, শিগগির নৌকোয় উঠে বসুন। জোয়ার আসছে। জোয়ারে সোনাদিয়া দ্বীপ পুরো ডুবে যায়। তখন হাজার সাঁতার জেনেও লাভ নেই।’’
এবার যেন একটু ভয় পেলেন। এই দু-হাত ডিঙির কতই বা জোর! মাঝপথে সমুদ্র কুয়াশায় ছেয়ে গেল। তারপর সে এক ভয়ানক যাত্রা। উথালপাথাল ঢেউ। গর্জন। খ্যাপা হাওয়ার পাকদণ্ডি। ওই একরত্তি ডিঙির সাধ্য কি সামলায়! প্রায় লাট খেতে খেতে কোনও ক্রমে প্রাণ নিয়ে ফিরেছিলেন বিভূতিভূষণ।
যোগেন্দ্রনাথ বলতেন, প্রকৃতি নিয়ে বিভূতিভূষণের বাড়াবাড়ি রকমের মুগ্ধতা ছিল। তাঁর এই ভ্রমণস্পৃহাকে কেউ কেউ আবার আদিখ্যেতা বলেও কটাক্ষ করেছেন। কিন্তু বিভূতি আমৃত্যু নিজের ভাবনায়, ভালবাসায় বিশ্বাসী থেকে টহল দিয়ে বেড়িয়েছেন পথে পথে, অরণ্যে অরণ্যে।
সেই বিশ্বাসে অল্প ঘা দিলেও সহ্য করতেন না। সে যত তুচ্ছই হোক। ছোট্ট একটি ঘটনা বলা যাক।
একটি দলের সঙ্গে পিকনিকে গেছেন। ছোটনাগপুরের রাখা-মাইনাস বলে একটি জায়গায়। দলের সবাই-ই পরিচিত।
ভিড়ের মাঝেও আলাদা হয়ে মুগ্ধ চোখে প্রকৃতি দেখছেন বিভূতি। তাঁর এই মুগ্ধতা দেখে দলের এক মহিলা কিঞ্চিৎ বিরক্ত। হঠাৎ তিনি বিভূতিভূষণকে বলে দিলেন, এর চেয়ে কাশ্মীর অনেক সুন্দর।
শুনে বিভূতিভষণের প্রকৃতি দেখার তো ছন্দ পতন হলই, উপরন্তু রাগও হল খুব।
ভদ্রমহিলাকে বললেন, দেখুন কাশ্মীর সুন্দর, রাখা-মাইনাসও সুন্দর। কেউ যদি কাশ্মীরের সৌন্দর্যে অন্ধ হয়ে অন্য জায়গার সৌন্দর্য দেখতে না পান, তাহলে তার কাশ্মীর না যাওয়াই ছিল ভাল।
প্রকৃতির অন্তরাত্মাকে এ ভাবেই তিনি ভেতরে ভেতরে লালন করতেন।
‘পথের পাঁচালী’ লেখা শেষ হল। পড়ে রবীন্দ্রনাথও মুগ্ধ। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় কবি লিখেছিলেন, ‘‘তাঁর লেখায় পাড়াগাঁয়ের কথা, সে’ও অচেনা রাস্তায় নতুন করে দেখতে হয়।’’
পথে পথে ছড়িয়ে থাকা ঝোপঝাড়, উলুখড়, বনকলমি, সোঁদাল-এর মধ্যেও আদুল প্রকৃতির এক আশ্চর্য আকরকে তিনি দেখতে পেতেন। নৈঃশব্দের ভাষা তিনি চিনতেন।। নইলে অমন করে কেউ বলতে পারেন! —আরণ্যক-এ যেমন!— লিখছেন, ‘‘চাঁদের কলা যখন বাড়ে কমে, তখন জ্যোৎস্নায় ঝিম ঝিম শব্দ হয়।’’
ঘাটশিলার পুরনো বাড়িটি যেমন ছিল
•
গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ইছামতী নদী ঘুরে ফিরে তাঁকে কাছে ডাকত।
বারবার ইছামতীর কথা লিখেছেন।
ইছামতী তাঁর যে কী প্রাণের ছিল, বোঝা যায় তাঁর ডায়েরি পড়ে। ১৯২৮-এর ১ মার্চ বিভূতিভূষণ ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘‘আমি একটা ছবি বেশ মনে করতে পারি— এই রকম ধূ ধূ বালিয়াড়ি, পাহাড় নয়, শান্ত, ছোট, স্নিগ্ধ ইচ্ছামতীর দু-পাড় ধরে বনকুসুম, কত ফুলে ভরা ঘেঁটু বন, গাছপালা, গাঙশালিখের বাসা, সবুজ তৃণাচ্ছাদিত মাঠ। গাঁয়ে গাঁয়ে গ্রামের ঘাট, আকন্দ ফুল, এই নদীঘেরা গ্রাম বাংলার মানুষ-মানুষি প্রকৃতি নিয়ে একটি গল্প লিখব। নাম দেব ‘ইচ্ছামতী’।’’
তবে শুধু অনুভব দিয়ে নয়, সে যুগেও বসে তন্ন তন্ন করে তিনি প্রকৃতি নিয়ে রীতিমতো চর্চা করে গেছেন। নিয়মিত ডাকে আসা ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ও Wide World পড়তেন। এই চর্চা কি তাঁকে দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক করে দিয়েছিল?
সেই কারণেই কি পশ্চিম বিহারে রুক্ষ, পাথুরে বনাঞ্চলকে তিনি আমেরিকার পেটেন্ড ডেজার্ট ও আরিজোনার নাভাহো মরুভূমির সঙ্গে তুলনা করেছেন?
হবেও বা!
•
ভাগলপুরের বন-জঙ্গলে জমিদারের জমি-জিরেত মাপার অবসরে মাঝে মাঝেই ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে পড়তেন।
বিভূতিভূষণের ভ্রাতৃবধূ যমুনা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ভাশুরের প্রকৃতি প্রেম সম্পর্কে বলতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছেন, উন্মুক্ত, দিগন্তপ্রসারী প্রান্তরের বুকে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি দারুণ আনন্দ পেতেন। ঘোড়ায় যেতে যেতে হুঁশ থাকত না। বেশির ভাগ দিনই রাত হয়ে যেত। তখন নাকি ধ্রুবতারাটি দেখে পথ চিনে ফিরে আসতেন সেরেস্তায়।
ওঁর প্রকৃতি প্রেমের আরও একটি গল্পও বেশ মজার। তার সঙ্গেও চাকরি নেওয়ার ব্যাপারটি জুড়ে।
সে কেমন? বলা যাক।
বেকার অবস্থায় কোনও দিন খাওয়া জুটল তো এক ঠোঙা চানা, এক ঘটি জল, কোনও দিন তাও নয়।
এই সময় মধ্য কলকাতায় কেশোয়ারি পোদ্দার বলে এক মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ী গো-রক্ষা সমাজ বলে একটি সংস্থা চালাতেন। বিভূতিভূষণ সেখানে গিয়ে চাকরি নিলেন।
তখন তাঁর কাজ ছিল সারাদেশে গো-হত্যার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ানো। এই কাজটি তিনি খুব ভালবেসে করতেন। কারণ তিনি বলতেন, এই কাজটির সঙ্গে তাঁর উপরি পাওনা ছিল নিখরচায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরা!
এই ভ্রমণের নেশাটি তিনি কোথায় পেয়েছিলেন?
অনেকেই বলেন, তাঁর বাবার থেকে। বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় একবার নাকি তাঁর গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে পেশোয়ার চলে গিয়েছিলেন! ভ্রমণের প্রতি এমনই মহানন্দ-টান!
এতটা না হলেও নিজের দ্বিতীয় বিয়ের পর বিভূতিভূষণেরও কাছাকাছি এমনই একটি গল্প আছে।
স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছেন সকাল-সকাল। যাওয়ার সময় ভাইয়ের বউকে ডেকে বললেন, ‘‘চা বসিয়ো তো, এসে খাব।’’
তিনি বিভূতিভূষণ
অথচ হাঁটতে হাঁটতে বিভূতিভূষণ চলে গেলেন অনেকটা দূর পথ। একেবারে পাহাড়ের দিকে।
দুপুর গড়িয়ে গেল।
স্ত্রী খিদেয় অস্থির। সদ্য বিবাহিতা লজ্জায় স্বামীকে সে কথা বলতেও পারছেন না। কিছু ক্ষণ পর বিভূতিভূষণ নিজেই বললেন, ‘‘তোমার খুব খিদে পেয়েছে তো? চলো, গাছ থেকে আমলকী পেড়ে খাই।’’
তিন-চারটে করে আমলকী খেয়ে ওঁরা যখন ফিরলেন তখন সন্ধে নেমে গেছে। তবু বাড়িতে ঢুকে ভ্রাতৃবধূকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘বৌমা, চা করেছ তো?’’
•
প্রকৃতির সঙ্গে কোথায় যেন আত্মীয়তাও পাতিয়ে বেড়াতেন তিনি!
একবারের ঘটনা যেমন।
চাইবাসা থেকে ঘাটশিলায় যাচ্ছেন। সে বারও সঙ্গী বন্ধু যোগেন্দ্রনাথ সিংহ। আর আছেন ভাগ্নে তিনু। পথে একটি ঝর্নার শব্দ পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ চোখ বুজে ঝর্নার সেই কুলকুল ধ্বনি শুনলেন। তারপর চোখ খুলে ভাগ্নে তিনুকে বললেন, ‘‘আজ থেকে এই ঝর্নাটা তোর। নাম দিলাম তিনু ঝর্না।’’
প্রাবন্ধিক প্রসাদরঞ্জন রায় ছিলেন বিভূতিভূষণের লেখার খুব ভক্ত।
প্রসাদরঞ্জনের মতে, বিভূতিভূষণের প্রকৃতি-প্রেমের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ তাঁর ‘আরণ্যক’। তিনি আরও বলছেন, এই উপন্যাসে সত্যচরণ কথক মাত্র, আসল নায়িকা প্রকৃতি। রাজু পাঁড়ে, ধাওতাল সাহু, কুন্তা, রাজা, দোবরু পান্না সকলেই ওই প্রকৃতির গর্ভজাত সন্তান যেন!
চাইবাসার অদূরে বামিয়াবুরু দেখে বিভূতিভূষণের মনে হয়েছিল যেন পুনর্জন্ম হল!
পাহাড়ের পর পাহাড়। মাঝখানে অতল খাদ। পাঁচ-সাত মাইলের মধ্যে জনবসতির চিহ্ন নেই। পাহাড়ের মাথায় বন বিভাগের বিশ্রামাগার। সেটি বিভূতির কাছে ধরা দিল ‘নোয়ার জাহাজ’ হয়ে।
নোয়া। জাহাজ। বাইবেলের সেই গল্পটা। পাপে পূর্ণ পৃথিবীকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে ঈশ্বর প্লাবনে ভাসিয়ে দিলেন। বাঁচিয়ে রেখেছিলেন শুধু নোয়াকে। তাঁর জাহাজকে। সেই জাহাজ ভর্তি জোড়ায় জোড়ায় এক একটি পশুপাখি।
বামিয়াবুরুকে বিভূতিভূষণ খুব প্রাণে ধরেছিলেন। স্ত্রী কল্যাণীও তাই। কিন্তু বিভূতির ভাল লাগার মধ্যে কোথায় যেন এক নৈর্ব্যক্তিক, নিরলম্ব, নিখাদ কাতরতা! যে কাতরতা, যে ভাল লাগার কোনও তল হয় না।
যোগেন্দ্রনাথ বর্ণনায় বলেছেন, বিভূতিভূষণ ছেলেমানুষের মতো করছিলেন। দু-পা হাঁটছেন আর বলছেন, এখানেই একটা বাড়ি করব। এখানেই।
বহুকাল ধরে বিভূতিভূষণ ছিলেন ‘অজ্ঞেয়বাদ’-এ বিশ্বাসী। দিন যত গেছে প্রকৃতির মধ্যে তিনি যেন ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রকৃতির কোলে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছেন নির্দ্বিধায়।
‘দৃষ্টি প্রদীপ’ উপন্যাসে তিনি জিতুর মুখে লিখছেন— ‘‘নীল আকাশের দেবতা, যাঁর ছবি এই বিশাল মাঠের মধ্যে সন্ধ্যার মেঘে, কালবৈশাখীর ঝোড়ো হাওয়ায়...।’’
সেই দেবতাকে তিনি বলেছিলেন, সমস্ত দেশ-কাল-ধর্মের অতীত। এমনকী জীবনের শেষের দিকে তিনি নিজেকে ‘ঈশ্বরের সন্তান’ মনে করছেন।
অনেকে তাঁকে দীক্ষা নেওয়ার জন্য বলেছিলেন। কিছুতেই রাজি হননি। বলতেন, ‘‘আমি কেন কারও মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে যাব? যেতে হলে সরাসরিই যাব।’’
•
কলকাতায় এসেছেন।
কলেজ স্ট্রিটে এক প্রকাশনা দফতরে বসে আড্ডা দিচ্ছেন।
আড্ডায় তাঁর সমসাময়িক অনেক সাহিত্যিকও আছেন। এমন সময় উত্তরবঙ্গ থেকে দু’জন এলেন হন্তদন্ত হয়ে। তাঁরা জনৈক সাহিত্যিককে ধরলেন।
উত্তরবঙ্গে সাহিত্যসভায় তাঁরা সেই সাহিত্যিককে নিয়ে যেতে চান। সেই খ্যাতনামা সাহিত্যিককে তাঁদের সভায় সভাপতিত্ব করতে হবে। কিন্তু লেখকমশাই যাওয়ার জন্য নানারকম শর্ত আরোপ করেই চলেছেন।
শুনে ছেলে দু’টির কাঁচুমাচু দশা।
তাঁরা বারবার বলছেন, তিনি না গেলে তাঁদের সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। সে কথা বিবেচনা করেও যদি একটি বারের জন্য তিনি যান।
কিন্তু সাহিত্যিক তাঁর শর্তে অনড়। শেষে ছেলে দুটি নিরুপায় হয়ে ফিরতে যাবেন, হঠাৎ পিছন থেকে বিভূতিভূষণ তাঁদের ডাক পাড়লেন। বললেন, তিনি গেলে কি তাদের কাজ হবে? একটা দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট হলেই চলবে।
ওঁদের কাছে বিভূতিভূষণের চেহারাটি একেবারে অচেনা। তাই প্রস্তাব শুনে অতি সাধারণ পোশাক পরা ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে তাঁদের থতমত অবস্থা।
ইনি আবার কে?
তাঁদের কিন্তু-কিন্তু ভাব দেখে বিভূতিভূষণ বললেন, ‘‘আমার একটা বই আছে। হয়তো শুনে থাকবে, ‘পথের পাঁচালী’।’’
শুনে ছেলে দুটির চোখ বিস্ফারিত। তাঁরা বললেন, ‘‘আপনি বিভূতিভূষণ!’’
ওঁকে প্রণাম করে আড়ালে গিয়ে তাঁরা বললেন, উনি রাজি না হয়ে ভালই হয়েছে। আপনাকে পাওয়া গেল!
বিভূতিভূষণের এই বলার মধ্যে ছেলে দুটির প্রতি যেমন তাঁর মায়া ধরা পড়ে, তেমন কোথাও বোধ হয় ওঁর স্থান থেকে স্থানান্তরে উড়তে থাকা ডানাও ছায়া ফেলে যায়!
যায় না কি?
এমনকী তাঁর মৃত্যুকালের কথাতেও কেমন যেন প্রকৃতির গন্ধ হামাগুড়ি দেয়।
প্রান্তবেলায় ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘‘ভয় নেই, ব্যাঙ্কে টাকা জমিয়ো না।...পৃথিবীতে কোনও শান্ত, গ্রাম্য নদীর কূলের চিতায় তোমার হুঁশিয়ার জীবন যখন শেষ হয়ে যাবে, সেদিন থেকে এই অসীম,অনন্ত রহস্য তোমার সম্পত্তি হয়ে দাঁড়াবে।’’
এ বার্তা বোধহয় শুধু আরণ্যক-এরই মানায়!
ঋণ: পথের পাঁচালী, আরণ্যক, ‘দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকা (বিভূতিভূষণ সংখ্যা),
পথের পাঁচালী কে বিভূতিবাবু (যোগেন্দ্রনাথ সিংহ)
ছবি: পরিমল গোস্বামী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy