কোলে এল সন্তান
বহু চেষ্টার পর আইভিএফ পদ্ধতির সাহায্যে ছেলের জন্ম দিয়েছিলেন বেহালা শকুন্তলা পার্কের বাসিন্দা শ্রীময়ী চৌধুরী। কিন্তু অবাক কাণ্ড, ডেলিভারির পর কিছুতেই তিনি বাচ্চাকে কাছে নিচ্ছিলেন না, এমনকী দেখতে পর্যন্ত চাইছিলেন না। তাঁর ধারণা, প্রেগন্যান্সির জন্য এত্ত এত্ত ওষুধ খেয়েছেন, আর ভ্রূণ যেহেতু শরীরের বাইরে তৈরি হয়েছে, তাই বাচ্চা সুস্থ নয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে অনেক বোঝানোর পর বিফল হয়ে মা আর বাচ্চাকে আলাদা আলাদা ডিসচার্জ করতে বাধ্য হন চিকিৎসকরা। শুধু প্রেগন্যান্সিতেই নয়, সন্তান জন্মানোর পরও মানসিক সমস্যায় ভোগেন অনেক নতুন মা। সহজে যাঁদের প্রেগন্যান্সি আসে, তাঁরা তো বটেই, শ্রীময়ীর মতো পরিকল্পনা আর চেষ্টার পর সন্তানের জন্ম দিয়েও হতাশায় ডুবে যান অনেকে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গৌতম খাস্তগীর বলছিলেন, ‘‘ভীষণ রকম কাঙ্খিত সন্তান নিয়েও কেউ যে হতাশায় ডুবতে পারেন, তা অনেকেই মাথায় রাখেন না। ফলে প্রেগন্যান্সিতে ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দেওয়ায় ডেলিভারির পর সেটাই অনেক বেড়ে যায়।’’
মানসিক সমস্যার নেপথ্যে
মনোচিকিৎসক অয়নাংশু নায়কের কথায়, ‘‘সন্তান জন্মের পর হঠাৎ একরাশ দায়িত্বের মাঝে পড়া, সাধারণ জীবন থেকে অনেকখানি সরে যাওয়া এ ধরনের সমস্যার কারণ। তা ছাড়া শরীরে হরমোনের পরিবর্তন তো আছেই।’’ এগুলিই মানসিক ভাবে বিষন্ন করে তোলে। সদ্য নয় মাস সন্তান বহনের কষ্ট পেরিয়ে এ এক অন্য জীবন। রাতের ঘুম হাওয়া। ক্লান্ত শরীরে বিশ্রামের অবকাশ নেই। ক্ষণে ক্ষণে খুদের চিল চিৎকার, অথচ খাওয়াতে গেলে ঠিক মতো খাচ্ছে না, বা বার বার খাইয়েও খিদে মিটছে না, হিসু-পটি-ন্যাপির মধ্যে জীবনটা বাধা পড়ে গেল! ডা নায়ক জানালেন, ‘‘ডেলিভারির সপ্তাহখানেকের মধ্যেই টের পেয়ে যাবেন আপনার এ রকম কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না। প্রথম দিকে সামান্য ব্লুজ বা মন খারাপ হয়। অল্প স্বল্প উদ্বিগ্ন ভাব আর মুড সুইং হতে পারে। এর কোনও চিকিৎসা দরকার হয় না। ব্যাপারটা আপনা আপনিই কেটে যায়।’’ কিন্তু যদি দেখা যায়, যে এই মন খারাপ আবার ফিরে এসেছে, তখন সেটাকে ব্লুজ বলে ভুল করবেন না। সেটা পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশন। ১০-১৫% নতুন মা এই সমস্যায় ভোগেন। বাচ্চার জন্মের ১ মাসের মধ্যে এমনটা শুরু হতে পারে। ২-৩ মাসে এটা খুব বেশি হয়। ছয় মাস পরেও এমনটা হতে পারে। আবার এই প্রথম দিকের অল্প স্বল্প মন খারাপই যদি দশ দিনের বেশি চলতে থাকে, তখনও নড়েচড়ে বসতে হবে। কারণ সেটাও আর ব্লুজ নয়, পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশন। আমার বেবি কেন দিনে তিন বার পটি করছে, ঠিক মতো কেন খাচ্ছে না— এত সব চিন্তাভাবনা পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশন বাড়িয়ে দেয়। তার থেকে মা বাচ্চাকে যত্ন করেন না, ব্রেস্ট ফিড করাতে চান না, বাচ্চাকে ভালবাসতে পারে না। সব থেকে বড় কথা, মনে কোনও আনন্দ নেই। মাঝে মাঝেই কান্না পায়। কখনও কখনও মনের এই অবস্থার জন্য মা বাচ্চাকে দোষ দেন। বাচ্চার জন্যই তাঁর জীবনটা বদলে গেল। যাঁর সমস্যা হচ্ছে, তিনি নিজেই বুঝতে পারেন। কিন্তু বলতে পারে না। বাচ্চা হল, কোথায় আনন্দ হবে, তা নয়। উল্টে মন খারাপ। তাই অনেকে ব্যাপারটা লুকিয়ে যান। সমস্যা কিন্তু উত্তোরতত্তোর বাড়তে থাকে। এমনকী মা’র মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে ডা. খাস্তগীর জানালেন, ‘‘অনেকের ধারণা এমনটা কেবল হরমোন জনিত কারণে হয়। এটা সব সময় সত্যি নয়। কারণ হরমোনের পরিবর্তন সবার শরীরেই হচ্ছে। তাই বলে কিছু মহিলা কেন মানসিক সমস্যায় ভুগবেন? মেয়েদের শরীরে ইস্ট্রোজেন আর প্রোজেস্টেরন মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত। এই দুই হরমোনের হঠাৎ হঠাৎ ওঠা-নামা মানসিক অসুস্থতায় প্রভাব ফেলে ঠিকই। কিন্তু এটা তাঁদেরই মানসিক অসুস্থতা বাড়িয়ে দেয়, যাঁদের আগেই কোনও রকম মানসিক অসুস্থতা ছিল।’’ এ ক্ষেত্রে পরামর্শ, প্রেগন্যান্সিতেই খেয়াল করুন কোনও রকম মানসিক সমস্যা হচ্ছে কি না। তা হলে তখনই আটঘাট বেধে নামতে হবে। নইলে সমস্যা বহু দূর গড়িয়ে যাবে। আগে কোনও মানসিক অসুস্থতা থাকলেও তার যেন পুরোপুরি চিকিৎসা হয়। যদি মনে হয় কোনও রকম সমস্যা হচ্ছে তবে সাহায্য নিতে বা কাউকে সেই সমস্যার কথা বলতে দু’বার ভাববেন না। ডা. খাস্তগীরের পরামর্শ, ‘‘প্রেগন্যান্সির সময় ডাক্তার দেখাতে গিয়ে অন্য যাঁরা মা হতে চলেছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলুন, ডেলিভারির সময় আপনার সঙ্গে অন্য যাঁরা সে দিন সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন তাঁদের ফোন নম্বর নিয়ে নিন। পরে তাঁদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলুন। কখনও নিজেকে আলাদা ভাববেন না।’’ তাতে সুবিধে হল, সেই মহিলা নিজের সমস্যা বুঝতে না পারলে বা সমস্যা হচ্ছে, সেটা বুঝেও মানতে না চাইলে অন্য আর এক জন ব্যাপারটাকে ধরে ফেলেন। এ ধরনের সমস্যায় এটা খুব জরুরি। অবসাদকে বাড়তে দেবেন না। নতুবা পোস্ট ন্যাটাল সাইকোসিস হতে পারে।
পোস্ট ন্যাটাল সাইকোসিস
সন্তান জন্মানোর পর এটাই গভীরতম মানসিক সমস্যা। সাইকোসিস মানে বাস্তব থেকে সরে আসা। এতে হয়, ডিলিউশন, হ্যালুসিনেশন আর ঘন ঘন মুড সুইং। মনে বিভ্রান্তি আর ভ্রান্ত বদ্মমূল বিশ্বাস তৈরি হয়ে যায়। সেই মহিলা মনে মনে বিশ্বাস করে বসেন কোনও প্রতিবেশী হয়তো তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে বা কেউ তাঁর নামে খারাপ কথা বলছে। ডেলিভারির ১-২ সপ্তাহের মধ্যে এমনটা হয়। পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশন আর পোস্ট ন্যাটাল সাইকোসিস দুটো আলাদা। সাইকোসিস হলে বাচ্চা আর মা’কে এক সঙ্গে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করতে হয়। যদিও এখানে এ ধরনের পরিকাঠামোর সুযোগ কম। তাই অনেক ক্ষেত্রেই মা বাড়িতেই থাকে। বাচ্চার ক্ষতিও করে ফেলেন। লন্ডনে এক জন ভারতীয় মহিলা ড. দাকসা এমসন এই রকম মানসিক সমস্যার কবলে পড়েছিলেন। শেষমেশ ব্যাপারটা এই জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল যে সেই মহিলা নিজের তিন মাসের কন্যা ফ্রেয়াকে ছুরি দিয়ে মেরে বাচ্চা ও নিজেকে জ্বালিয়ে দেয়। যে ঘটনা সেখানকার চিকিৎসামহলকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশন আর সাইকোসিসের গুরুত্ব।
সমাধান
মায়েরা চান হান্ড্রেট পারসেন্ট পারফেক্ট হব। সব আমিই সামলে নেব। এই ধরনের চাহিদা তৈরি হলে মুশকিল। কারণ সেখান থেকেই ডিপ্রেশন শুরু হয়। তাই কখনও সুপার মা হওয়ার চেষ্টা করবেন না। সন্তান জন্মের পর তাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিন। নিজের পেশাগত জীবন নিয়ে সে সময় বেশি ভাববেন না। মনে রাখবেন কেউ-ই অপরিহার্য নয়। এই মুহূর্তে আপনি আর আপনার সন্তান সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মন ভাল রাখতে নিয়মিত এক্সারসাইজ করবেন। মানসিক সমস্যার জন্য কোনও ওষুধ খেলে হুট করে সেটা বন্ধ করবেন না। নিয়মিত ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। আপনার মতো যাঁরা নতুন মা হয়েছেন, এমন কারও সঙ্গে কথা বললে আর একাকীত্ব আসবে না। আর মন খারাপ লাগলে ডা. নায়কের পরামর্শ, নিজেকে তিনটি প্রশ্ন করুন। বিষন্ন বা আশাহত লাগছে কি না? কোনও কিছুই ভাল লাগছে না, এমন বোধ হচ্ছে কি? কোনও সাহায্য দরকার বলে মনে হচ্ছে? প্রশ্নগুলোর উত্তর হ্যাঁ হলে সাইকিয়াট্রিস্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
ডা. গৌতম খাস্তগীর: যোগাযোগ: ৯৮৩০৬৬৬৬০৬
অয়নাংশু নায়ক: যোগাযোগ: ৯৮৩০০৫৭৩২৪
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy