মঞ্চে ফুলমালায় সজ্জিত তিনটি ছবি— শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, সারদাদেবী আর স্বামী বিবেকানন্দের। ভক্তিপথের প্রণম্য সেই ত্রয়ীর ছবির পাদদেশ-পরিসরে শিল্পীরা প্রস্তুত তাঁদের বাদন পরিবেশনার জন্য। অনুষ্ঠান শুরুর আগে সরোদিয়া আমান আলি খান জানালেন— এই ধর্মীয় পরিবেশে অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেয়ে তিনি কৃতজ্ঞ। অনুষ্ঠানের পুরো পরিসর জুড়ে পরিবেশনার অধ্যাত্ম-ভাবটিকেই অনুসরণ করে গেলেন শিল্পী। পিনপতনের শব্দ শোনা যায়, এমন নিবিড় নীরবতায় আচ্ছন্ন পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে শিল্পীর রাগ নির্বাচনের ভাবনা, পরিবেশনার ভক্তিমার্গ আর স্থিরনিবদ্ধ তন্ময়তা আরাধনার আবহ নির্মাণ করল। কলকাতার গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের বিবেকানন্দ সভাগৃহে রামকৃষ্ণ সারদা মিশন মাতৃ ভবনের ৭৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিল্পী আমান আলি খান যে চারটি রাগের পরিবেশনা বেছে নিলেন, তার সব ক’টির নামের সঙ্গেই দেবী-অনুষঙ্গ যুক্ত, সংযুক্ত মাতৃশক্তির আবেশ। শিল্পী বেছে নিয়েছিলেন রাগ গৌরী, ললিতা-গৌরী, সরস্বতী, দুর্গা।
গ্বালিয়রের বঙ্গাশ ঘরানার সপ্তম প্রজন্মের শিল্পী আমান আলি খানের সঙ্গে এ সন্ধ্যায় তবলা সঙ্গতে ছিলেন আজরারা ঘরানার ওজস আধ্যা। আমান কার্যত তাঁর অনুষ্ঠানটিকে দু’টি ভাগে গ্রন্থিত করেছিলেন। প্রথম ভাগে গৌরী আর ললিতা-গৌরী। পরের অংশে সরস্বতী আর দুর্গা। দু’টি পর্বেই এক রাগ থেকে অন্য রাগে যাওয়ার জন্য আলাদা ভাবে কোনও আনুষ্ঠানিক প্রারম্ভের আয়োজন রাখেননি শিল্পী। রাগান্তরে গিয়েছেন কার্যত অলক্ষ্যে, সাবলীল মাধুর্যপথে। ধীর মেজাজে আমান ধরলেন গৌরী। উত্তর ভারতীয় সুপ্রাচীন রাগ। গুরু গ্রন্থ সাহিবে উল্লিখিত, খ্রিস্টাব্দ-পত্তনেরও বহু শতাব্দী আগের রাগটি নানা বিবর্তনপথে হাঁটতে হাঁটতে বর্তমানে মূলত দু’টি ঠাট-কাঠামোয় চর্চিত— ভৈরব আর পূরবী। আমান বেছে নিয়েছিলেন ভৈরব ঠাটের পূর্বাঙ্গ গৌরী। বক্র চলনের সান্ধ্য রাগ। এ রাগের হৃদ্কাঠামোয় বাঁধা সহিষ্ণুতার আবেশ আর প্রত্যয়ের মন্ত্র আমানের অনবদ্য আলাপে মুহূর্তে সজীব হয়ে উঠল। এই পর্বটি আমান প্রধানত মিড়-মাধুর্যে গেঁথে তুললেন ধীরে ধীরে। ক্রমে শিল্পীর সুচিন্তিত প্রলম্বিত ‘স্ট্রোক’, ধীর গতির সুরক্ষেপণ আচ্ছন্ন করে তুলল শ্রোতাদের এবং মিনিট-পনেরোর মধ্যে তা দশ মাত্রার ঝাঁপতাল গতের মোহনায় এসে পৌঁছল। তথাকথিত জোড়-ঝালা অংশকে প্রকট না করে শিল্পী তাঁর ধৈর্যের প্রতিমা গড়তে গড়তে এগিয়ে চললেন, যা ভিন্ন মাত্রার প্রাপ্তি।
এ সন্ধ্যায় রাগ নির্বাচনের সময়েই আমান যাত্রাপথটি এঁকে নিয়েছিলেন। সেই পথেই গৌরী থেকে পৌঁছে গেলেন ললিতা-গৌরীতে। ললিতাঙ্গের এই রাগে গৌরী এবং ললিতের অনুপম দাম্পত্য। এই সঙ্কর রাগটি উপমহাদেশের কণ্ঠশিল্পী এবং বাদ্যযন্ত্র শিল্পীদের বিশেষ প্রিয় তার চলনগুণ আর মিশ্র প্রকরণের সুবাদে। ললিত ভোরের রাগ। সেখানে দুই মধ্যমের নিরন্তর লীলাখেলা। সে খেলায় কখনও মারোয়া ঠাটের বসন্ত-সুবাস, কখনও পূরবী ঠাটের হাহাকার। আর ভৈরব ঠাটের গৌরীর প্রকৃতি আগেই উল্লিখিত— চলন বাঁকা। এই দুই রাগের, দুই অঙ্গের মাধুর্য মিশিয়ে নিজেকে গড়ে তোলে ললিতা-গৌরী। সেখানেও দুই মধ্যমের মুখর আলাপচারিতা। আলাপন সেখানে গান্ধার, মন্দ্র নিষাদের। আর পথ ঘুরে আসার পরে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য নিমন্ত্রণপত্র পাঠায় পঞ্চম। আমান রাগরূপ প্রতিষ্ঠার পরে ১৪ মাত্রার আড়া চৌতালে এলেন। যে কম্পোজ়িশনটি পেশ করলেন, তা তাঁর বাবা আমজাদ আলি খানের তৈরি। অনবদ্য উপস্থাপনা। তারে আঙুলের স্পর্শকম্পন, মিড়, ভারী থেকে মৃদু ‘স্ট্রোক’, দ্রুতগতির তান— আমান জাদুবিশ্ব তৈরি করলেন। এই পরিবেশনায় আমান সান্দ্র ঝড় তুললেন। ওজসের সঙ্গে আমানের আদানপ্রদান ও বোঝাপড়া এ দিন প্রথম থেকেই পরম সূক্ষ্মতায় বাঁধা ছিল। ওজসের ঘরানার বন্ধ্-বাজ গোটা উপস্থাপনায় আলাদা মাত্রা তৈরি করেছিল।
আমান আলি খানের পরিবেশনার পরবর্তী পর্বে ছিল রাগ সরস্বতী আর দুর্গা। গোটা উপমহাদেশে আদৃত হলেও দু’টিরই দক্ষিণ ভারতীয় সাঙ্গীতিক শিকড় রয়েছে। সরস্বতী রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরের মিষ্টি, শান্ত, খানিক করুণ আবহের নিবেদন-আর্তির রাগ। মিনিট পাঁচেকের ছোট অথচ চুম্বক আলাপের পরে আমান এলেন একতালে। সরাসরি মধ্যলয়ে। এখানেও ওজসের চাপা ঠেকার মাধুর্য-সঙ্গতে অতুলনীয় পরিবেশ তৈরি হল। আমান সরস্বতী-নিবদ্ধ পুরো বাদনটিই ছোট ছোট কাঠামোয় ভেঙে বাজাচ্ছিলেন। সেখান থেকে যখন দুর্গায় এলেন, তখন বাদনশৈলী বদলে বহমান অনুরণনে এলেন। সেখানে মিড় প্রাধান্য পেল। রাগ দুর্গায় বীররস আর ভক্তিরসের সহাবস্থান। মূলত বিলাবল ঠাটের দুর্গাই বেশি প্রচলিত। আমান তিনতালে দুটো গৎ বাজালেন। চরম দ্রুতিতেও সুস্পষ্ট বাদনের যে উত্তরাধিকার তিনি বহন করে চলেছেন এবং নিজেও স্বয়ং যে শৈলীর জাদুকর, তার পরিচয় রাখলেন। এখানেও সঙ্গতে অনবদ্য ওজসের মাপা এবং চাপা বাদন।
এ সন্ধ্যার গোটা উপস্থাপনায় নিবেদনকে পেশকারির ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন আমান। তাই গোটা পরিবেশনা বস্তুত এক সুরে বাঁধা— নম্রতায়, স্নিগ্ধতায়। চারটি রাগরূপ পরিবেশনার পরে সে নিবেদনেরই রেশ বয়ে নিয়ে গেলেন শিল্পী অন্য এক আচম্বিতের আলিম্পনে। ঘোষণা করলেন— আরও একটি উপস্থাপনা অপেক্ষা করছে। মঞ্চে আহ্বান করলেন তাঁর বাবা আমজাদ আলি খানের কলকাতার প্রথম-পর্বের শিক্ষার্থী অসিত ঘটককে। প্রবীণ অসিত ঘটক মঞ্চে আসার পরে আমান শ্রোতাদের অনুরোধ করলেন— এখন যা উপস্থাপিত হবে, তার সঙ্গে যেন সবাই যোগ দেন। কিন্তু কী উপস্থাপিত হবে? প্রশ্ন গোটা প্রেক্ষাগৃহের মনে। আমানের সরোদে যেন কল্যাণ ঠাটের কিছু বেজে উঠল! প্রশ্ন জাগল— শিল্পী কি এ বার ইমন বা ওই জাতীয় কিছু বাজাবেন? বেশ কয়েক আবর্ত বাজানোর পরে অসিত ঘটক ধরলেন ‘খণ্ডন ভব-বন্ধন, জগ-বন্দন বন্দি তোমায়’— তালফেরতায় বাঁধা শ্রীরামকৃষ্ণ-আরাত্রিক ভজন। যত-মত তত-পথের দিশারি শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে উৎসর্গ করে ধ্রুপদ-ধামারে পারদর্শী স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৮ সালে বেঁধেছিলেন এই ঐতিহাসিক প্রার্থনাসঙ্গীত। আমান-অসিতের সঙ্গে গোটা প্রেক্ষাগৃহ কণ্ঠ মেলাল আরাত্রিকে। শ্রোতার আসনে উপবিষ্ট সন্ন্যাসিনী-সন্ন্যাসীরা প্রার্থনা-মুদ্রায় হাত জোড় করলেন। উপস্থিত বাকি শ্রোতাদের অনেকেরই চোখ চিকচিক করে উঠল। মুহূর্তে অপার্থিব পরিবেশ তৈরি হল রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের বিবেকানন্দ সভাগৃহে। মঠের প্রার্থনাগানের সঙ্গে আমান আলি খানের অনুপম বাদন আর ওজস আধ্যার পাখোয়াজ-ভঙ্গিমার শ্রীসঙ্গত হৃদয়ের মণিকোঠায় সযত্ন-সঞ্চয় হিসেবে নিশ্চিত রেখে দেবে কলকাতা।
এ সন্ধ্যার সামগ্রিক পরিবেশনা সেই আর্ষেরই প্রতিফলন যেন— সঙ্গীত সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনপথ। নিবেদন-আর্তিকে আমান আলি খান উপাসনার অভিন্ন ঐতিহ্যের আবহে প্রতিষ্ঠা করলেন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)