E-Paper

নদীর কাছে ফেরা

প্রদর্শনীর সূচনা আকস্মিক নয়, বহু বছরের এক ধারাবাহিক প্রয়াস। ১৯৬৯ সালে গবেষক ও অভিযাত্রী পিনাকীরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সি এক্সপ্লোরার্স ইনস্টিটিউট’।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:২৮
গতিধারা: চারুবাসনায় আয়োজিত যৌথ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

গতিধারা: চারুবাসনায় আয়োজিত যৌথ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

চারুবাসনার সুনয়নী গ্যালারিতে সম্প্রতি আয়োজন করা হয়েছিল ‘আ ট্রিস্ট উইথ দ্য রিভার’ শীর্ষক এক প্রদর্শনী। নামের মধ্যেই লুকোনো এক কাব্যিক প্রতিশ্রুতি। ‘নদীর সঙ্গে দেখা’— এখানে নদী শুধু প্রকৃতির প্রতীক নয়, সময়, স্মৃতি ও জীবনের প্রতিধ্বনি। নামকরণটির নেপথ্যে রয়েছেন যোগেন চৌধুরী, সন্দীপ রায়, তপন মিত্র প্রমুখ ব্যক্তিত্ব।

প্রদর্শনীর সূচনা আকস্মিক নয়, বহু বছরের এক ধারাবাহিক প্রয়াস। ১৯৬৯ সালে গবেষক ও অভিযাত্রী পিনাকীরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সি এক্সপ্লোরার্স ইনস্টিটিউট’। পিনাকীরঞ্জনের স্বপ্ন ছিল, এক দিকে সমুদ্র ও নদী সংক্রান্ত গবেষণা, অন্য দিকে এক্সপ্লোরেশন ও ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্টের প্রশিক্ষণ। ডিঙি নৌকায় করে আন্দামান পৌঁছনো এই নৌযাত্রী পরবর্তী কালে নিজেই জলে হারিয়ে যান। সেই শূন্যতা থেকে তাঁর স্ত্রী শিউলি চট্টোপাধ্যায় এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁর হাত ধরে কাজের পরিধি বেড়ে যায়।

গতিধারা: চারুবাসনায় আয়োজিত যৌথ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

গতিধারা: চারুবাসনায় আয়োজিত যৌথ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

সেই ভাবনা থেকেই শিউলি চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে প্রথম শুরু হয়েছিল ‘গঙ্গোৎসব’। সাল ২০০০। নানা শিল্পকর্মের মাধ্যমে একত্র হন শিল্পীবৃন্দ। নদীকে কেন্দ্র করে নতুন শিল্পভাবনার সূত্রপাত হয়। এ বারের প্রদর্শনীর পরিকল্পনাও ছিল সেই রকম। জলের আবহে সৃষ্টিকে গড়ে তোলা। প্রতি বছর এক-একটি থিম অনুযায়ী কর্মশালার আয়োজন হয়ে থাকে।

এ বারের নিবেদনটি উৎসর্গ করা হয় প্রয়াত শিউলি চট্টোপাধ্যায়ের নামে। একদিনের কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন ১৩ জন শিল্পী। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে বিষয়টিকে রং-রেখায় অনুবাদ করেছেন।

গতিধারা: চারুবাসনায় আয়োজিত যৌথ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

গতিধারা: চারুবাসনায় আয়োজিত যৌথ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

প্রদর্শনীর কিছু কাজে মূল অনুভবের স্রোত অনুপস্থিত। আবার কিছু কাজে নিজস্ব সত্তাকে মেলে ধরার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। যেমন বিরাজ কুমার পালের কাজে শীর্ণ আকারে প্রবাহিত জলাশয়। তাকে ঘিরে রয়েছে সুন্দর আসমানি ও সবুজ রঙের প্রকৃতি। ছবিটি নিঃসন্দেহে মনোমুগ্ধকর ও যত্নশীল শৈলীর পরিচায়ক। সংস্থার সদস্য ও শিল্পী তপন মিত্রের কাজও সেই অর্থে নয়নাভিরাম। আল্ট্রামেরিন ব্লু এবং ক্রোম ইয়েলোর পটে বিশ্রামরত নৌকার ক্লান্ত ফর্ম।

ভাল লাগে শিল্পী স্বপন কুমার সাহার নারী ও প্রকৃতির গোপন আলাপ। হলুদাভ প্রেক্ষাপটের অন্দরমহলে এক স্বপ্নিল নারী। তারই মধ্যে যেটি ছবির সৌন্দর্য ও ধারণার জন্ম দেয়, সেটি হল একটি ছোট নৌকা। ছবিটিকে দু’ভাবে দেখা যায়। এক, শৈশবে ফেলে আসা নৌকার সুখস্মৃতি। অথবা নদীতীরে জন্ম নেওয়া বৃক্ষদেবীর আলাপন। সুস্পষ্ট এবং হালকা আবেশে, ফুটে ওঠে অজন্তার ক্লাসিক সুর। মিল্টন ভট্টাচার্যের ফর্ম সেমি-অ্যাবস্ট্রাক্ট গঠনে তৈরি। বেলাভূমির একটি গোধূলি চিত্র। আকাশের কমলা রং ও মিশ্র নীলের ফাঁকে ফাঁকে নদীর তট ক্রমশ বিলীয়মান।

গতিধারা: চারুবাসনায় আয়োজিত যৌথ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

গতিধারা: চারুবাসনায় আয়োজিত যৌথ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

ব্যতিক্রমী চিন্তার ছায়া মলয়চন্দন সাহার কাজে। সাদা পটভূমিতে জমির আলপথ মিশেছে নদীর প্রান্তে। রেখার নির্মাণে খণ্ড খণ্ড খেত। মনে হয় ভাঙনের রূপ। তবে নদীর জল শুধু ভাঙনই নয়, উর্বরতার কথাও বলে। শিল্পী বিশ্বজিৎ সাহা সাধারণত দেব-দেবীর দ্বৈত রূপ নিয়ে কাজ করেন। মূলত রূপক হিসেবে আখ্যায়িত হয়। নির্ধারিত বিষয় ‘শিউলি’ ফুলের ডালে উপবিষ্ট এক পাখি, যার মুখ একটি নারীর আদলে গড়া। ক্যানভাসে এক দিকে সাদা ফুল, অন্য দিকে পূর্ণিমার হলুদ চাঁদ। ছবির নাম ‘চকোরি’। গোলাপি রঙের আধিপত্যে এটি একটি প্রেমের ছবি।

প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য ছবি ছিল শিল্পী অশোক মল্লিকের। নদীর চলমান জীবনের দুই পারে দু’টি মানুষ। মুখোমুখি নারী ও পুরুষের বাসনার এক বিদগ্ধ ছবি। রং-রেখার যথোচিত ব্যবহারে অসাধারণ কম্পোজ়িশন। দেবাশিস দাস মানবজাতির সুপ্ত আবেগ নিয়ে কাজ করেন। কমলা পটে, চমৎকার স্ট্রাকচারে এক বনদেবী। বাহন ডোরাকাটা বাঘ। পিছনে ছাতার মতো একটি বৃক্ষ। গোটা পরিবেশনে শিল্পীর সুললিত রেখার ডিজ়াইন সুষমা বাড়িয়ে তোলে।

মৌমিতা ঘোষ সমসাময়িক শিল্পী। তাঁর কাজের বেসিক অস্ত্র, প্রুশিয়ান ব্লু-র মোনোক্রমিক পর্দা। ফলে এক ধরনের রহস্য তৈরি হয়। এখানেও সেই রঙের আশ্রয়। তারই মধ্যে আলো-আঁধারির মায়ায় একটি কাগজের নৌকা, যা ক্ষণস্থায়ী। সঙ্গে ঘোলা জল থেকে উঠে আসা পদ্মপাতা ও কুঁড়ি একটি রূপকধর্মী নির্দেশ। অর্থাৎ ভঙ্গুর জীবনেও জ্ঞানবৃদ্ধির মাধ্যমে আলোকিত হওয়া যায়। সুন্দর কম্পোজ়িশন। সৌরভ নন্দীর ক্যানভাস জুড়ে একটি নিশাচর পাখি, মাথার উপরে অর্ধচন্দ্র। যারা রাতে সক্রিয়, পেঁচা তারই প্রতিনিধি। মূল বিষয়ের বাইরে হলেও, পেঁচার আকৃতি মন্দ লাগে না।

‘গঙ্গাফড়িং’ শিরোনামে বাপ্পা ভৌমিকের কাজটি সুপ্ত আবেগ নিয়ে তৈরি। স্নানরত যুবতীর আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা। ঝরে পড়া শিউলি ফুল, ভাসমান কাগজের নৌকা এবং জৈবিক চাহিদার রূপান্তরে গঙ্গাফড়িং। রৈখিক ঢেউয়ের আবেদনে কাজটির মধ্যে আরও সম্ভাবনা থাকে, যা এক দিনের কর্মশালায় করা মুশকিল হয়ে ওঠে। বাকি দুই শিল্পী অরুণিমা দাশগুপ্ত এবং প্রত্যুষা মুখোপাধ্যায়ের কাজ বিষয়ী হয়েও, প্রকরণের ক্ষেত্রে বেশ দুর্বল।

‘নদীর সঙ্গে দেখা’র অর্থ নিজের ভিতরের স্রোতকে চিনে নেওয়া। এই প্রদর্শনী সেই প্রচেষ্টারই এক উদাহরণ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Art exhibition Art Gallery Artists

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy