Advertisement
E-Paper

অর্ধেক আকাশ

সত্যিই কি তিনি নারীবাদী? ঘরোয়া জীবন যে অন্য কথা বলে! আশাপূর্ণা দেবীর চলে যাওয়ার কুড়ি বছরে লিখছেন সর্বাণী মুখোপাধ্যায়আর মেয়ে না। মেয়ের স্বাদ মিটেছে। তাই আশাপূর্ণা! নামটি তাঁর ঠাকুমার দেওয়া। হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ও সরলাসুন্দরীর ন’টি সন্তানের পঞ্চম এবং কন্যা হিসেবে তৃতীয় হওয়ায় ঠাকুমা অমনটাই চেয়েছিলেন। কালে কালে এই কন্যাই কিনা স্বয়ং রবিঠকুরের স্বীকৃতি আদায় করলেন।— ‘আশাপূর্ণা তুমি সম্পূর্ণা’! অবহেলা নিয়ে জন্ম। অক্ষর-পরিচয়ও সেই অবহেলা দিয়েই। বাড়ির পড়ুয়া ছেলেদের, দাদা আর ভাইয়ের উল্টো দিকে বসে তাদের পাঠ্য বইয়ের পড়া দেখতে দেখতে।

শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩

আর মেয়ে না। মেয়ের স্বাদ মিটেছে। তাই আশাপূর্ণা!
নামটি তাঁর ঠাকুমার দেওয়া। হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ও সরলাসুন্দরীর ন’টি সন্তানের পঞ্চম এবং কন্যা হিসেবে তৃতীয় হওয়ায় ঠাকুমা অমনটাই চেয়েছিলেন।
কালে কালে এই কন্যাই কিনা স্বয়ং রবিঠকুরের স্বীকৃতি আদায় করলেন।— ‘আশাপূর্ণা তুমি সম্পূর্ণা’!
অবহেলা নিয়ে জন্ম। অক্ষর-পরিচয়ও সেই অবহেলা দিয়েই। বাড়ির পড়ুয়া ছেলেদের, দাদা আর ভাইয়ের উল্টো দিকে বসে তাদের পাঠ্য বইয়ের পড়া দেখতে দেখতে।
ঘোর রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ইস্কুলের ভেতর যাওয়া দূরে থাক, চৌকাঠেও পা রাখতে পারেননি। কিন্তু পরে তিনিই আবার তিন হাজার ছোট গল্প, আড়াইশো উপন্যাস, ষাটেরও বেশি ছোটদের কাহিনি, অসংখ্য প্রবন্ধ লিখে গেলেন।
বিশ্বভারতীর শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘দেশিকোত্তম’ থেকে অজস্র সম্মানিক ডক্টরেট আর সোনার মেডেল পেলেন। এমনকী সর্বভারতীয় স্বীকৃতি ‘জ্ঞানপীঠ’ও হাতে নিলেন। এমন মানুষই বোধ হয়, নিজেকে অনায়াসে আখ্যা দিতে পারেন—‘‘আমি মা সরস্বতীর স্টেনোগ্রাফার।’’
বহু জায়গায় বলে গেছেন, মায়ের কারণেই তাঁর সাহিত্যর নেশাটা পেয়ে বসেছিল। সরলাসুন্দরীর ছিল বই পড়ার প্রবল নেশা। তাই বাড়িতে প্রচুর বই আসত। তখনকার দিনের প্রায় সমস্ত গ্রন্থাবলী, যত পত্র-পত্রিকা, প্রায় সব। এ ছাড়াও ছিল তিনটি গ্রন্থাগার, সেখান থেকেও নিয়মিত বই-এর জোগান ছিল।
আশাপূর্ণা লিখছেন, ‘‘মায়ের বই পড়া মানে সে প্রায় কুম্ভকর্ণের খিদের মতোই। আর আমাদেরও স্কুলের বালাই নেই। সেইসব বইগুলো আমরা তিন বোনে নির্বিচারে পড়ে ফেলতাম অতি বাল্য থেকেই... বই পড়াটা ভাতের মতোই অপরিহার্য ছিল।’’
বই পড়তে পড়তেই লেখার সাধ। তেরো বছর বয়েসে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলেন তাঁর প্রথম কবিতা ‘বাইরের ডাক’। পত্রিকার সম্পাদক রাজনারায়ণ চক্রবর্তী। তিনি সে কবিতা তো নিলেনই, জানতে চাইলেন আরও অনেক কিছু। — ‘‘আরও লেখা দিতে পারবে? গল্প লিখতে জানো।’’
প্রথম লেখা। প্রথম স্বীকৃতিও। রাজনারায়ণ চক্রবর্তীর কাছে আজীবন কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না আশাপূর্ণার। এক জায়গায় লিখেছেন, ‘‘সেই প্রথম কালে উৎসাহে ঘৃৎসি়ঞ্চন না করে যদি বরফজল ঢালতেন, সুনিশ্চিত আমার লেখিকা হওয়া হত না।’’

নিজের জীবনস্মৃতির ঝাঁপ খুলতে বসে তিনি বলছেন এক্কেবারে এক সাধারণ মেয়ের গল্প। —‘‘ছিল অত্যন্ত সাধারণ জীবন... মনে হয় যদি খুব গরিব ঘরের মেয়ে হতাম বা বিশিষ্ট কোনও বড়লোকের মেয়ে... তাহলেও বা তা নিয়ে কিছু বলার মতো উপাদান পাওয়া যেত। দুঃখ দুর্দশা অভাব অথবা ঐশ্বর্যের ঝলক। সে দিক দিয়ে তো কিছু বলার নেই। স্রেফ মধ্যবিত্ত ব্যাপার। মধ্যচিত্তও। শুধু বাবা ছবি আঁকতেন আর মার ছিল অত্যধিক সাহিত্যপ্রীতি। সেই হেতুই হয়তো অন্যান্য আত্মীয়জনের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের মানসিকতার কিছু তফাত ছিল।’’

ওই তফাতটুকুর কারণে ছোট থেকে চাওয়া-পাওয়ার ভাবনাগুলো যেন বয়স ধরে পাশাপাশি হাঁটেনি। কিশোরীবেলায় যেমন আশাপূর্ণা ভেবেছে, আহা, তার বরটা যদি লাইব্রেরিয়ান হয়, বেশ হয়। অনেক বই পড়তে পাবে সে। আবার মনে হয়েছে, যদি রেলে কাজ করে তবেও মন্দ হয় না। খুব বেড়াতে পারবে।

কোনওটাই হয়নি। স্বামী ছিলেন ব্যাঙ্কের কর্মচারী। সাধ থাকলেও সাধ্য কম ছিল। ফলে শুধু লেখা আর পড়ার ওপরই ছিল একমাত্র নির্ভর। —‘‘সব সময় চেষ্টা করেছি আমার এই শখটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। এবং অবশ্য সফলও হয়েছি। অন্য কোনও কিছুর ওপর আর তেমন আকর্ষণ ছিল না।’’

বলতেন, বড়দের ছোটগল্প লেখাটা তাঁর প্রেম। উপন্যাসটা তাঁর কাজ। কিন্তু যাই-ই লিখেছেন, সবটাতেই মনে হয়েছে, তিনি যেন একজন অসামান্য ফটোগ্রাফার। তাঁর কলম আদর্শের কথা হয়তো তেমন করে বলে না। বলে না, এমনটা হওয়া উচিত। কিন্তু তাঁর কলম জীবনের ছবি তুলে তুলে কেবল দেখিয়ে দিয়েছে, এমনটা হয়। বারবার বলেছেন, ‘‘যা হয় আমি তাই লিখি, কী হয় সেটাই বলবার, উচিত বলার আমি কে?’’

তাঁর কলমে ছবির মতো উঠে আসে, ‘চিরদিনের সত্য সহসাই কী অদ্ভুতভাবে মিথ্যে হয়ে যেতে পারে। আবার বর্ণহীন একটা মাটির ঢেলাও সহসা হীরকখণ্ডের দ্যুতির চমক দিয়ে বসে।’

গায়ে কাঁটা দেয় তাঁর ‘ছিন্নমস্তা’ গল্পটি। যেখানে নতুন যুবতী বউয়ের ছেলেকে ক্রমশ দখল করে নেওয়ার আক্রোশে একমাত্র সন্তানের মৃত্যুকামনা করে বসে বিধবা মা জয়াবতী। সেটিই ফলে গেলে কী ভয়ঙ্কর চাপা উল্লাসে আর নিষ্ঠুরতায় ‘চকচকে কালো পাথরের বড়ো থালায় পরিপাটি করিয়া সাদা ধবধবে আতপ চালের অন্ন বাড়িয়া রাখিয়া জয়াবতী ডাকেন— বৌমা, অ বৌমা, নেবে এসো মা, দুটো মুখে দিয়ে যাও।’ কিংবা, ‘পাখা হাতে করিয়া কল্পিত মাছি তাড়াইতে তাড়াইতে বলেন— খেতে পারছি না বললে চলবে কেন মা?... ভালো জিনিস খাওয়ার বরাত তো ঘুচিয়েছেন ভগবান, পোড়া বিধবার গুচ্ছির শাক-পাতা-ডাল-চচ্চড়ি না খেয়ে উপায় কি?’

মর্মমূল ধরে টান মারে ‘স্থিরচিত্র’ গল্পটি। প্লেনক্র্যাশে সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়া একমাত্র ছেলের মৃত্যুসংবাদে শোকে পাথর মা। নাড়িছেঁড়া যন্ত্রণা আর যত্নে জননী সতী সেন তিল তিল করে বানায় মৃত সন্তান দিব্যকুমারের ‘স্মৃতিমন্দির’। সেখানে নতুন বিছানা-বালিশে ঠেস দেওয়া ছেলের দৃপ্ত উজ্জ্বল ছবির সামনে ভেঙে পড়েন তিনি— ‘খোকা, খোকা রে, তুই ওপর থেকে দ্যাখ... তোর বোকা হাবা মা তোর জন্য কী করে তুলেছে... এ সব তোর! খোকা সব তোর। আমরা শুধু মন্দিরের সেবাইত।’

কিন্তু যখন ছেলের চিঠি আসে, ‘তার একদা বলিষ্ঠ চারখানা হাতপায়ের তিন-তিনখানাই হারিয়ে ফেলে অবশিষ্ট অপটু হাতটা দিয়ে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লিখে জানিয়েছে বহুদিনের আপ্রাণ চেষ্টায় এই চিঠিটা পোস্ট করতে পেরেছে সে...যেন তাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয়’— তখন সতী সেন যেন মনশ্চক্ষে দেখতে পান ‘অথৈ সমুদ্রের তলা থেকে উঠে আসা একটা অপরিচিত অদ্ভুত জীব, নির্মল শুভ্র ‘দিব্যস্মৃতি’র মন্দির-ঘরের মাঝখানে পাতা সরু খাটের ওপর থেকে তার ঝকঝকে টগবগে খোকার ছবিখানাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজের জায়গাটা দখল করে নিতে চাইছে।’ ... ‘আলোটা নিভিয়ে দিল সতী। গেটের যে আলোটা সারা রাত জ্বালিয়ে রাখার কথা ছিল’— এক ফুঁয়ে এ কোন আলো নিভিয়ে দেন আশাপূর্ণা?

তেমনই জর্জরিত করে ‘পরাজিত হৃদয়’ গল্পটি। বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে বাইরে বেড়াতে যাওয়া একমাত্র আদরের মেয়ে গণধর্ষণের শিকার। বাঁচতে চেয়ে বাড়ি ফেরার জন্য মা অমলাকে লেখা তার প্রথম চিঠি মা তক্ষুনি চুপিচুপি ‘জ্বলন্ত উনুনের আগুনে গুঁজে দেয়’। বাবা সোমেশ্বর তার অফিসের ঠিকানায় আসা দ্বিতীয় চিঠিটি নিয়ে মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে গিয়েও পারে না। চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে উদ্ধারের ঠিকানা দেওয়া শেষ হদিশটুকু টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে, মেয়েকে বরাবরের মতো নিশ্চিহ্ন করে বাড়ি ফিরে আসে অপরাধীর মতো। কারণ ‘যে মেয়ে বন্ধুদের দলে জুটে জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে ‘দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়ে’ এখন ফুলের মালা গলায় দুলিয়ে দেওয়ালে ঝুলে আছে, সেই মেয়েকে হঠাৎ আবার রক্তমাংসের আধারে ভরে ফেলে নিয়ে এসে কোথায় জায়গা দেবে?...’ এমনি করেই আশাপূর্ণা তাঁর ‘কসাই’, ‘পদাতিক’, ‘ভয়’, ‘ইজিচেয়ার’... নামের ছোটগল্পগুলোতে অতি চেনা সম্পর্কের ওপরে সাঁটা অদৃশ্য মুখোশগুলোয় যেন এক হ্যাঁচকায় টান মারেন। চারপাশকে নিয়ে, হাজারটা সম্পর্ক নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন তুলে দিতে থাকেন।

আশাপূর্ণাদেবীর এই পরিচয়টা তাঁর লেখালেখি থেকেই পাওয়া। কিন্তু আরেকজন আশাপূর্ণাকে আমি চিনি।

যে আশাপূর্ণাকে আমি ‘পিসিমা’ ডাকতাম। ওঁর স্বামী আমার কালিদাস পিসেমশাই। আমার সাহিত্যিক বাবা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যাঁকে ‘দিদি’ বলে ডাকত। আর বাবাকে উনি বলতেন, ‘আশুতোষ আপনি’।

পিসেমশাইকে নিয়ে তিনি মাঝে মাঝেই আমাদের প্রতাপাদিত্য রোডের গরগরে ইটরঙা ‘লালবাড়ি’-তে আসতেন কালরোগে ধরা আমার ভাইকে দেখতে।

প্রত্যেক বার সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে উঠতে হেসে বলতেন, ‘‘বাব্বা! বাড়ি তো নয়, যেন রেডফোর্ট!’’

আশাপূর্ণা পিসিমা এলেই বাবা তাঁর হাতে নিজের এক খানা বই দিয়ে তাতে লিখে দিত—‘শ্রদ্ধেয়া দিদিকে, আশুতোষ’।

কাঁচা বয়েসের দুষ্টুমিতে সে সময় এক দিন যে কাণ্ড করেছিলাম, তাতে আজও যেমন লজ্জা হয়, তেমন হাসিও পায়।

সে দিন বাবা তাঁর লেটেস্ট বইখানা এনে ধরলে তিনি হাসি হাসি মুখে বলেছিলেন, ‘‘আজ আমাকে বই দেবে জয়।’’ জয়, আমার ভাই। বাবার থেকে বইটি নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘‘জয়ের নাম দিয়ে তুমি লিখে দাও।’’ উনি জানতেন, অসুস্থ ছেলের আঙুল তখন আর নড়ে না। ছেলেমানুষি রাগ আর অভিমানে কী যে দুর্বুদ্ধি আমার মাথায় চাপল! — ওঃ, শুধু জয়ই বাবার বই দেবে? আমি কেউ না?

লিখলাম, ‘আশাপূর্ণা পিষিমাকে, জয়।’

ইচ্ছে করেই ‘পিসিমা’ বানানটির ওই দুর্দশা করেছিলাম। তিনি মন দিয়ে সেটি দেখলেন। মুখভরা চাপা কৌতুকের হাসি। কাছে ডেকে আমায় চুপি চুপি বললেন, ‘‘এই পিষিমা বানানটা তো তোমার আবিষ্কার, এমনটি তো আর কোত্থাও পাব না, তো এর তলায় তোমার নামটাও লিখে দাও...।’’

আমি পালাতে চেয়েছিলাম। উনি জোর করে ধরে লিখিয়ে নিয়েছিলেন। তখনই টের পেয়েছিলাম ওই তুলতুলে নরম হাতে কী বজ্রকঠিন শক্তি!

ছোট গল্পের আশাপূর্ণা বড় আখ্যানে গিয়ে কিছুটা হলেও কি ভিন্ন গোত্রের? নারীর পক্ষ নিয়ে, তাঁর অধিকারের দাবি নিয়ে এখানেই কি তিনি বেশি সোচ্চার?

বলছেন, ‘‘মেয়েদের কথাই বেশি করে ভেবেছি। কারণ তাদের অসহায় অবস্থা চোখে পড়েছে বেশি... তাদের অবরোধ সমস্যাই আমাকে সবচেয়ে বেশি পীড়িত করত। ছোটবেলা থেকে দেখছি তো সেই বন্ধনদশাগ্রস্ত অবস্থা। তাছাড়া মেয়েদের সর্ববিষয়েই তো ছিল অনধিকার।’’

এই অনধিকারের প্রশ্ন থেকেই তিনি লেখেন ট্রিলজি— ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’, ‘বকুলকথা’।

প্রথমটির নায়িকা সত্যবতী। যে মেয়ে ছোটবেলা থেকেই ‘মেয়েমানুষের’ দাবি নিয়ে কথা বলে। —‘এত যদি না দরকারের কথা তো মেয়েমানুষের জন্মাবারই বা দরকার কি...?’ কিংবা ‘বলি স্বয়ং মা সরস্বতী নিজে মেয়েমানুষ নয়? সকল শাস্তরের সার শাস্তর চার বেদ মা সরস্বতীর হাতে থাকে না?’

‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’-র পরের বিন্যাস ‘সুবর্ণলতা’। সত্যবতীর মেয়ে সুবর্ণলতা। সুবর্ণলতা সোচ্চার, সুবর্ণলতা অলজ্জ, সুবর্ণলতা তীব্র। মেয়েমানুষের অসম্মানের লাঞ্ছনায় সে এই হতভাগা দেশের মেয়েদের জন্য ‘মড়ক’ প্রার্থনা করে—‘বাংলাদেশের মেয়েদের ওপর এমন কোনো মড়ক আসে না গো, যাতে দেশ মেয়ে-শুন্যি হয়ে যায়? তখন দেখি তোমরা মহানুভব পুরুষসমাজ কোন সিংহাসনে বসে ক্রীতদাসী সংগ্রহ কর? এ অহঙ্কার, ফুরোবে তোমাদের। তোমাদেরই জুতোর শুকতলা ক্ষয়াতে হবে, এই আমি অভিশাপ দিচ্ছি।’’

‘বকুলকথা’ আশাপূর্ণার নিজের কথায়, ‘সুবর্ণলতা’র পরিপূরক। সুবর্ণলতার এই সবচেয়ে ছোট মেয়ে তার মা ও দিদিমার অদ্ভুত কনট্রাস্ট। সে মুখচোরা, চুপচাপ, নিজের মধ্যে গোটানো। অথচ এই বকুলই একদিন হয়ে ওঠে খ্যাতনামা লেখিকা ‘অনামিকাদেবী’। সত্যবতী ও সুবর্ণলতার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় তারই মধ্যে দিয়ে।

বকুল রাস্তায়ও নামে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে—‘মা, মা গো! তোমার পুড়ে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া লেখা, না-লেখা সব কথা আমি খুঁজে বার করবো। সব কথা আমি নতুন করে লিখবো। দিনের আলোর পৃথিবীকে জানিয়ে যাবো অন্ধকারের বোবা যন্ত্রণার ইতিহাস।’’

আশ্চর্য, এই আশাপূর্ণাই আবার ‘মেয়েমানুষী’-কে রেয়াত করেননি। এক জায়গায় লিখছেন, ‘‘মেয়েরা সবের প্রতিই বড় বেশি আসক্ত। তুচ্ছ বস্তুর প্রতিও আসক্তি। আবার মানুষের প্রতিও এক ধরনের তীব্র আসক্তি। স্বামী-সন্তান এরা একান্তই ‘আমার হোক’। ...যত দিন না তারা এই ‘আসক্তি’ ত্যাগ করতে পারবে, ততোদিন মুক্তি আসবে না।’’

নারীকে এমন শাসন করে আবার সোহাগ করেছেন তিনি। বলছেন, ‘‘পুরুষেরা ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারে। মেয়েরা কি তা পারে?... পুরুষরা যখন সংসার উপেক্ষা করে লেখেন তখন তিনি মহান ব্যক্তি। মেয়ে যদি তাই করে তখন সে অপরাধিনী’’... তিনি প্রশ্ন করছেন, ‘‘এমন কোনও লেখিকা আছেন কি যিনি বলেন ‘আমি সংসারের কিছু জানি না, সব উনি জানেন।’ কিন্তু পুরুষরা সেটা সর্বদাই বলেন।’’ তাঁর বড়ই আক্ষেপ যে মেয়েরা ‘সময়ের গণ্ডিতে বড্ড বেশি বন্দী’। তিনি চান সেই অচলায়তনের ভাঙতে।

এই প্রতিবেদন লেখার মাঝে এক দিন হঠাৎই চলে গিয়েছিলাম গড়িয়ার কানুনগো পার্কে ওঁর বাড়ি। যে দোতলা বাড়ি ওঁর নিজেরই তৈরি। ’৬৯ সাল থেকে আমৃত্যু থেকেওছেন ওখানে।

দোতলার দরজা পেরিয়ে ঢুকতেই হল ঘর। বাঁ ধারে বসার ঘর। ওই ঘরে বসেই কথা হচ্ছিল আশাপূর্ণাদেবীর পুত্রবধূ নূপুর গুপ্তর সঙ্গে। ঘরের চার পাশে অজস্র স্মারক, পুরস্কার, ট্রফি, ছবি। সামনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর কা‌ছ থেকে নেওয়া ‘পদ্মশ্রী’। রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডির হাত থেকে ‘জ্ঞানপীঠ’ ও প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর থেকে বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ পাওয়ার ছবি দু’খানি পাশাপাশি।

তার সামনে বসেই নূপুরদেবী বলছিলেন শাশুড়ি-মায়ের ঘরোয়া কথা, ‘‘ব্যবহার বরাবর একরকম। নিজের মাও বোধ হয় এ রকম করেননি। কোনও কিছুই শাশুড়িজনোচিত নয়। পুরোটাই বন্ধুর মতো।’’

তিনিই ঠিক করে দিয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে বউয়ের বিএ পড়া। দূরত্বের কারণে ট্র্যাডিশনাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন কাছাকাছি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়তে। সেই সময় নিজের হেফাজতে নিতেন তিন মাসের শিশু ছোট নাতনিকে। কোনও আয়াও ছিল না দেখভাল করার।

‘‘কোনও দিন রাগতে দেখিনি। খুবই মিষ্টি স্বভাব। অথচ সব সময়ই যে আদর দিয়ে গেছেন, এমনটাও নয়। কখন কী করতে হবে, সবই বোঝাতেন সংযত হয়ে। এ দিকে নিজে কিন্তু তাঁর শাশুড়ির যত রকম কঠোর নিয়ম-নির্দেশ আজীবন পালন করেছেন। নির্বিবাদে। শাশুড়ির নির্দেশেই স্বামীর সঙ্গে কাশীর যোগাশ্রমে দীক্ষা নেন তিনি। সেখানে খুব কড়াকড়ি।

দীক্ষার পর থেকে দু’জনেই নিরামিষ খেয়ে গেছেন বরাবর,’’ বলছিলেন নুপূরদেবী।

স্ত্রীর লেখালেখির জন্য সব সময় অবশ্য পাশে থাকতেন স্বামী। সব জায়গায় স্ত্রীকে সঙ্গ দেন, বলে তাঁকে বিদ্রুপ শুনতে হত। জবাব দিতেন, ‘‘স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে সব জায়গায় যেতে পারে, উল্টোটা হলে ক্ষতি কী, সম্পর্কটা তো একই!’’

নুপূরদেবী বলছিলেন, ‘‘বাইরে যেমন নরম, ভেতরে ততটাই শক্ত ছিলেন উনি। এক মেয়ে দুই ছেলের মা। সবার বড়, মেয়ে পুষ্পরেণু। পর পর দুই ছেলে প্রশান্তকুমার, সুশান্তকুমার। আর্ট কলেজে পড়া তেইশ-চব্বিশ বছরের অতি গুণী ছেলে প্রশান্তকুমারের আকস্মিক মৃত্যুতে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন, কিন্তু সেখানেও কতটা যে শান্ত, সংযত ছিলেন, সে ওঁর কাছের লোকেরাই শুধু জানেন।’’

অসম্ভব সরল। সাদাসিদে। কিন্তু ‘টিপটপ’ বলতে যা বোঝায়, ঘরের আশাপূর্ণা ছিলেন তেমন। বিকেলে চুল বেঁধে গা ধুয়ে পাটভাঙা শাড়ি পরা। সুগন্ধি চন্দন সাবান মাখা। মাথায় জবাকুসুম, নয়তো মহাভৃঙ্গরাজ তেল দেওয়া। মুখে হিমানী স্নো, ওটিন ক্রিম।

খুব পছন্দ ছিল তাঁতের শাড়ি। তাতে হালকা কমলা বা হালকা সবুজ বা হালকা নীল পাড়। — ‘‘বাইরে বেরনোর সময় আমিই কাপড় পরিয়ে দিতাম। কোনও দিন কিন্তু রঙিন শাড়ি পরতে দেখিনি,’’ বললেন নুপূরদেবী।

ঘরোয়া আশাপূর্ণার এই রূপটা আমিও অবশ্য কিছুটা দেখেছি।

আমাদের মুখার্জি বাড়ির একটা রেওয়াজ ছিল। যখনই কোনও সধবা মহিলা বাড়িতে আসতেন, যাওয়ার সময় ঠাকুমা নিজের অতি প্রাচীন রুপোর কৌটো থেকে তার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিত। কপালে দিত বড় করে টিপ। এ রীতি ঠাকুমারই চালু করা। এই বিদায়-সম্ভাষণটি বড় পছন্দের ছিল আশাপূর্ণা পিসিমার।

আমার ঠাকুর্দা-ঠাকুমার মাত্র এক দিনের তফাতে অদ্ভুত ভাবে মৃত্যু হল। খবর পেয়ে উনি বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। মনে আছে, যাওয়ার সময় ঠাকুমার পুরনো ছোপ-ধরা বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না বসানো বিশাল মেহগনি কাঠের ড্রেসিং টেবিলের সামনে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। যেখানে রাখা থাকত ওই সিঁদুর কৌটো।

আরেকটি মৃত্যুর খবরে ছুটে এসেছিলেন তিনি। আমার ষোলো বছরের একমাত্র ভাই যখন চলে গেল। সারাক্ষণ স্তব্ধ হয়ে আমার পাষাণ-মূর্তি মায়ের পিঠে হাত রেখে নিঃশব্দে বসেছিলেন। পুত্রশোক কী উনি যে তা নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করেছেন।

কিন্তু আমার বাবার দুম করে চলে যাওয়ার পরে আর কখনও আসেননি। যাঁরা খবর দিয়েছিল, শেষ বারের মতো দেখার জন্য, তাঁদের বলেছিলেন, ‘‘আশুতোষের এ ভাবে চলে যাওয়া মানে সকালের আলোর মতো একটি প্রাণখোলা হাসি চলে যাওয়া। এত ব়ড় লোকসান আমি দেখতে যেতে পারব না।’’

ফোন করেছিলেন। এ পারে দাঁড়িয়েও বুঝতে পারছিলাম নিঃশব্দে কাঁদছেন। ভাঙা স্বরে ধীরে ধীরে বলেছিলেন, ‘‘ছোট ভাই হারানোর কষ্ট তো তুমি জানো, সেই কষ্ট এই বুড়ো বয়েসে আশুতোষ আমায় দিয়ে গেলেন। তোমার মাকে আমার এই কথা জানিয়ো...।’’

’৯৫-এর ১৩ জুলাই। ঘোর রাতে নিজেও তো চলে গেলেন তিনি!

ঋণ: সৌজন্য ‘সমকালের জিয়নকাঠি’ ২০০৯, ‘শতবর্ষের আলোকে আশাপূর্ণাদেবী’

ashapurna devi sarbani mukhopadhyay ashapurna devi personal life ashapurna devi death anniversary ashapurna devi life and work
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy