E-Paper

কেন্দ্রীভূত শিক্ষা

খুঁটিয়ে দেখলে বুঝতে অসুবিধা নেই, উচ্চশিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ কমিয়ে ছাত্রছাত্রীদের থেকে টাকা নেওয়ার জন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর চাপ তৈরি করবে সরকার।

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:১৯

বিকশিত ভারত শিক্ষা অধিষ্ঠান বিল, ২০২৫ যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হল এবং কমিটির মতামত জানা যাবে বাজেট অধিবেশনে— অর্থাৎ মাঝের কয়েক মাস রয়েছে নাগরিকের হাতে, সতর্ক হয়ে বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য। এই বিল অনুসারে, মেডিক্যাল আর আইনের শিক্ষা বাদে উচ্চশিক্ষার প্রায় সব ক’টি বিভাগ একটিই স‌ংস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), সর্বভারতীয় কারিগরি শিক্ষা পর্ষদ (এআইসিটিই), জাতীয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ পর্ষদ (এনসিটিই), এই তিনটির পরিবর্তে কাজ করবে একটি মাত্র সংস্থা, শিক্ষা কমিশন (অধিষ্ঠান)। তার অধীনে থাকবে তিনটি কাউন্সিল বা পরিষদ, একটি হবে উচ্চশিক্ষার নিয়ামক পরিষদ, একটির দায়িত্ব স্বীকৃতি দান, এবং তৃতীয়টি শিক্ষার মান নির্ধারণ করবে। লক্ষণীয়, খসড়া আইন অনুসারে মূল কমিশন এবং তিনটি কাউন্সিলের সব সদস্যকে নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি, কেন্দ্রীয় সরকারের সুপারিশ অনুসারে। নীতির প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা অনুসারেই কাজ করবে কমিশন এবং তিনটি কাউন্সিল, মতভেদ হলে কেন্দ্রের মতই বহাল থাকবে। এমনকি কাউন্সিল এবং কমিশনের সদস্যদের পদত্যাগ করতেও বলতে পারে কেন্দ্র। উপরন্তু, ইউজিসি-র যেমন বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে অর্থ মঞ্জুর করার ক্ষমতা ছিল, নতুন কাউন্সিলের তা থাকবে না। অপর কোনও ব্যবস্থার মাধ্যমে কেন্দ্র উচ্চশিক্ষার অনুদান দেবে প্রতিষ্ঠানগুলিকে। অর্থাৎ আইনের প্রস্তাব, আর্থিক অনুদান কোনও স্বতন্ত্র, স্বশাসিত সংস্থা থেকে না এসে, আসবে সরাসরি কেন্দ্রের থেকে।

ইঙ্গিত পরিষ্কার। উচ্চশিক্ষায় সর্বময় কর্তৃত্বের আসনে বসতে চাইছে কেন্দ্র, যদিও সংবিধানমতে শিক্ষা যৌথ তালিকার বিষয় হিসাবেই এত দিন চিহ্নিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো নস্যাৎ করে একের পর এক আইন এনে কেন্দ্র অবাধে নানা বিষয়ে রাজ্যের ভূমিকাকে খর্ব করে চলেছে। শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান শিক্ষায় কেন্দ্রীকরণের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনের নামকরণে ব্যবহৃত সংস্কৃত-সঙ্কুল হিন্দির ব্যবহারই যেন ইঙ্গিত করছে, কেন্দ্রের শাসক দল তার নিজস্ব বুলি, নিজস্ব ভাবধারা সারা দেশের উপর আরোপ করতে চায়। আইনের প্রস্তাবনায় কেন্দ্র অবশ্য কিছু উত্তম যুক্তি দেখিয়েছে। যেমন, জাতীয় শিক্ষা নীতি (২০২০) অনুসরণ করেই এই বিল আনা হয়েছে। নীতিতে বলা আছে, শিক্ষা-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পুনর্নির্মাণ প্রয়োজন যাতে উচ্চশিক্ষায় ফের শক্তির জোয়ার আসে। দাবি, উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রণে নানা নিয়ামক সংস্থা, নানা রীতিনীতি থাকায় জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ফাঁক গলে তৈরি হচ্ছে ভুয়ো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। একটিই নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা থাকলে বিভ্রান্তি কমবে। চাই সরল কিন্তু দৃঢ় আইন, যা শিক্ষাকে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী করবে, এবং শিক্ষার বরাদ্দ ব্যবহারে কুশল (‘রিসোর্স এফিশিয়েন্ট’) করবে।

কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে বুঝতে অসুবিধা নেই, উচ্চশিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ কমিয়ে ছাত্রছাত্রীদের থেকে টাকা নেওয়ার জন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর চাপ তৈরি করবে সরকার। বিরোধীরা তাই প্রশ্ন তুলেছেন, আইনের প্রস্তাবনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ‘স্বাতন্ত্র্যের সুরক্ষা’র কথা বলা হলেও, বাস্তবে তার সম্ভাবনা থাকবে কতটুকু? নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রের ছায়ায় কাজ করার অর্থ, অপছন্দের পাঠক্রম পড়ালে প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতিতে টান পড়বে। আর্থিক অনুদানে কাটছাঁটও হতে পারে। প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা যখন নিয়ন্ত্রকের মর্জির উপর নির্ভরশীল, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি স্বকীয় চিন্তার ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে চাইবে, যা উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যের পরিপন্থী। সাম্প্রতিক কালে ভারতের শিক্ষায় গৈরিকীকরণই এর দৃষ্টান্ত। ইতিহাসে মোগল যুগ, জীববিজ্ঞানে ডারউইনের তত্ত্ব কাটছাঁট থেকে শুরু করে ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’ তকমা দিয়ে পাঠ্যক্রমে যুক্তিহীন, অবৈজ্ঞানিক বিষয়ের অবতারণা, এগুলি নিয়ে এখন দেশ জুড়ে উদ্বেগ। এই বিল সেই ধারার উপর সিলমোহর।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Education system Indian Education System

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy