শিল্প কখনও আঘাত করে, কখনও মায়ার হাতছানি দেয়। কখনও প্রশ্ন তোলে, আবার নীরবে উত্তর খুঁজে নেয়। ইমামি আর্ট গ্যালারিতে সম্প্রতি দেখা গেল সে রকমই দু’টি ভিন্ন সুর। প্রকৃতি এবং খেলার সংলাপ। এক দিকে অরুণিমা চৌধুরীর ‘আরণ্যক’— সম্পর্ক নির্যাসের কবিতা। অন্য দিকে, পার্থপ্রতিম দেবের ‘প্লে-ফর্মস’— গাঢ় রঙে সময়ের ছাপ। প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে, একজন নীরব, অন্য জন উচ্ছ্বসিত। মননশীল দৃষ্টিতে বোঝা যায়, দু’জনেই নতুন পথের সন্ধানে মগ্ন। এক শিল্পী নিস্তরঙ্গ বনভূমিতে প্রাণের কথা বলেন। অন্য জন বর্জ্যের ভিতরে শিল্পের সম্ভাবনা গড়ে তোলেন।
প্রথমেই আসি বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী অরুণিমা চৌধুরীর জগতে। ইকো প্রিন্টিং ও প্রাকৃতিক রঙে সাজিয়েছেন তাঁর সাম্প্রতিক সিরিজ়। কাপড় ও কাগজের স্ক্রলে ফুটে উঠেছে গাছপালা, ফুলের ছাপ ও মাটির গন্ধ। তাঁর প্রকৃতি কেবল বাইরের দৃশ্য নয়। অরণ্যের গন্ধে ভেজা এক অন্তর্গত আত্মার নির্মাণ, যা দর্শককে থামতে শেখায়।
পুনরাবিষ্কার: ইমামি আর্ট গ্যালরিতে অরুণিমা চৌধুরী ও পার্থপ্রতিম দেবের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
অরুণিমার কাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য তাঁর উপকরণ। ইকো প্রিন্টিং কৌশলে পাতা, ফুল, শিকড়, সরাসরি কাপড় ও কাগজে ছাপ রাখা। সঙ্গে প্রাকৃতিক রং ও সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারির ব্যবহার। দীর্ঘ সময় ধরে ধীর প্রক্রিয়ায় গড়া। দৃশ্যত, কাজগুলি তৎক্ষণাৎ কোনও চমক সৃষ্টি করে না। বরং সময় নিয়ে গভীরে ডুবিয়ে দেয়, যেন কোনও গোপন ডায়েরির বিস্মৃত পাতা আবিষ্কারের মতো।
কৃত্রিম রঙের সীমা ভেঙে অরুণিমা প্রকৃতি থেকে উপাদান সংগ্রহ করেন। শিল্পী জানান, তাঁর এই ধরনের কাজের ইচ্ছে জাগে নন্দলাল বসুর শিল্পচর্চা পড়ে। ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে পড়ার সময়ে বিকাশ ভট্টাচার্য পথ দেখিয়েছিলেন। তার পরে অয়েল পেন্টিং শুরু করেন। করতে গিয়ে বোঝেন, যা চাইছেন, তা হচ্ছে না। শান্তিনিকেতনে বিশিষ্টদের কাজ দেখার সুযোগ হয়। কে জি সুব্রহ্মণ্যমের সহায়তা পান। শুরু করেন আর্থ কালার। পরে সঞ্জীব মণ্ডলের কাছ থেকে ইকো প্রিন্টিং শিখেছিলেন অরুণিমা।
পুনরাবিষ্কার: ইমামি আর্ট গ্যালরিতে অরুণিমা চৌধুরী ও পার্থপ্রতিম দেবের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
প্রদর্শনীতে ছিল শিল্পীর গত দু’-তিন বছরে করা রাইস পেপার ও কটন কাপড়ের এক্সপেরিমেন্ট। প্রতিটি রঙের উৎসে ছিল বিস্ময়। যেখানে যা পাতা, ফুল পেয়েছেন, কুড়িয়ে কাজে লাগিয়েছেন। যেমন ফার্ন পাতা, পেঁয়াজের খোসা, ডালিমের খোসা, গাঁদা, জবা, কাঠচাঁপা থেকে নানা প্রাকৃতিক রং। সেই রং স্থায়ী করতে কখনও ফটকিরির ব্যবহার।
ধৈর্যশীল প্রক্রিয়ায় অসাধারণ সব কাজ। ঝোলানো ইকো প্রিন্টের লম্বা স্ক্রল— ‘স্কাই, ল্যান্ড, ওয়াটার’। টানটান কাপড়ে সেগুন পাতা, হোগলা, অপরাজিতার মালায় আকাশের বিস্তার। আবার ‘অরণ্যের অধিকারী’-তে অস্তিত্ব সঙ্কটে দিন গুজরানের প্রতীকী আভাস। উপাদানে রয়েছে হরিতকী, চিটে গুড়, গোটা মুগ ডাল, পান পাতা, জং ধরা লোহার মিশ্রণ।
পুনরাবিষ্কার: ইমামি আর্ট গ্যালরিতে অরুণিমা চৌধুরী ও পার্থপ্রতিম দেবের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
শিল্পী অরুণিমার প্রকৃতি উজ্জ্বলতার বিপরীতে হাঁটে। ধ্যানীর মতো কোমল টোনে স্তরে স্তরে এগিয়ে চলে। এ রকমই টেক্সচারের ভিতর থেকে উঁকি দেয় বালক, বালিকা। কোথাও হরিণের আকার। ভূমিচিত্রে ফুটে ওঠেশিল্পীর জন্মসূত্রের উত্তরবঙ্গ। সূক্ষ্ম স্টিচে ধরা পড়ে রাতের পেঁচা বা মাকড়সার জাল। সব মিলিয়ে বিপন্ন পরিবেশের সংরক্ষণাগার। যেন ঠাকুরমা-দিদিমার গল্পের মতো অমূল্য স্মৃতি। উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি একই সঙ্গে জেগে ওঠে।
প্রদর্শনীর আর এক অন্যতম শিল্পী পার্থপ্রতিম দেব। সমসাময়িক শিল্পচর্চার এক উল্লেখযোগ্য নাম। যার শিকড় আগরতলায়, শৈলেশ দেববর্মণের কাছে শিক্ষালাভ। পরে কলাভবনে গিয়ে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিঙ্কর বেজ ও গৌরী ভঞ্জের সান্নিধ্য পাওয়া। বরোদায় পড়াশোনা তাঁকে বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। আগরতলায় ফিরে দেখেন, শিল্পের উপকরণের অভাব। বিকল্প খুঁজতে গিয়েই ফেলে দেওয়া জিনিসের সাহায্যে নতুন কিছু করা। এই ঘাটতি পূরণেই জন্ম নেয় পুনর্ব্যবহারের দর্শন। শুরু হয় বর্জ্য উপকরণ দিয়ে সৃষ্টির পরীক্ষা।
পুনরাবিষ্কার: ইমামি আর্ট গ্যালরিতে অরুণিমা চৌধুরী ও পার্থপ্রতিম দেবের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
প্রদর্শনীতে আয়োজিত পার্থপ্রতিমের ‘প্লে-ফর্মস’ সিরিজ় তারই ফল। কাপড়-জামা, খেলনা, পুতুল, ভাঙা প্লাস্টিক, কাঠ বা লোহা... সবই সৃষ্টির সহায়ক। পপ আর্টের মাধ্যমে সম্পর্কের রূপক। নিয়মও আছে, আবার হঠাৎ ভাঙনের সম্ভাবনাও। রং এখানে বর্ণিল ও জোরালো। ফলে দর্শককে মুহূর্তে টেনে নেয়। গভীরে গেলে বোঝা যায়, লুকিয়ে আছে সময়ের ক্ষতচিহ্ন। শিল্পীর কিছু কাজে এই দ্বৈতসত্তা স্পষ্ট। যেমন অ্যাক্রিলিকে লাল পটভূমির উপরে সবুজ, হলুদ, নীলের বিমূর্ত ছক। তারই নীচে ঝুলছে মানবসদৃশ অবয়ব। মানুষের অস্তিত্ব এখানে ক্ষুদ্র, আবার একই সঙ্গে প্রতীকী।
আর একটি কালো-সাদা কালির রেখাচিত্র— জ্যামিতির খোলসে দ্রুত লাইনের চাপা আর্তি। সব মিলে এক বিকট খোলস, যা সমাজের চাপা সুর তুলে ধরে। আর একটি রঙিন কোলাজের কাজ। মধ্যবর্তী কালো অবয়বগুলি তির্যক ভাবে দৌড়চ্ছে। সংঘর্ষজনিত উচ্ছ্বাসে মুক্তির গতি। আবার খেয়ালবশে নির্মিত হয় সরল ভাস্কর্য। উপকরণ, সেই ফেলে দেওয়া ছেঁড়া কাপড়ের বর্জ্য।
পুনরাবিষ্কার: ইমামি আর্ট গ্যালরিতে অরুণিমা চৌধুরী ও পার্থপ্রতিম দেবের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
পার্থপ্রতিমের কর্মজীবনে রবীন্দ্রভারতীর শিক্ষকতার দায়িত্ব এক বড় অধ্যায়। ১৯৭৪-এ প্রথম একক শোয়ে সাড়া ফেলে দেন। যদিও অবসর-পরবর্তী সময়ে শিল্পীর কাজ আরও প্রখর হয়ে ওঠে। শিল্পের পূর্ণ স্বাধীনতায় নিজেকে যেন পুনরাবিষ্কার করেন। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই সৃষ্টির দিকে ঝোঁকেন। তবুও স্ট্রাকচার আসে, ভাঙা উপাদানে রঙিন আখ্যান রচিত হয়।
পুনরাবিষ্কার: ইমামি আর্ট গ্যালরিতে অরুণিমা চৌধুরী ও পার্থপ্রতিম দেবের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
দুই শিল্পীর সৃষ্টি আলাদা সুরে এগোলেও দু’ক্ষেত্রেই উঠে আসে এক অভিন্ন দাবি— অবহেলিত জিনিসেরও আছে নতুন জন্মের অধিকার।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)