শিশুকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি প্রেমের পরিচয় ‘জীবনস্মৃতি’তে পাওয়া যায়। প্রকৃতির মধ্যে এক প্রচ্ছন্ন সত্তাকে কবি অনুভব করেছিলেন। তাঁর সেই অনুভূতির প্রতিফলন শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীতে অমর হয়ে আছে। সেই অর্থে সৃষ্টিশীল মানুষ নিঃসন্দেহে মুক্তমনা। বিশেষত প্রাকৃতিক ভূদৃশ্যের সৌন্দর্য-রহস্য লেন্সবন্দি করার নেশায় ছুটে চলে মানুষ। তার আস্বাদের স্মৃতি স্থাপন করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। এ রকমই একজন ভ্রমণপিপাসু মানুষ সৌম্যেন সরকার। সম্প্রতি ‘কালার্স অব ট্রাভেল’ শিরোনামে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সাউথ গ্যালারিতে ৫৫টি ছবির ডালি সাজালেন এই চিত্রী। একক প্রদর্শনী হিসেবে এটি তাঁর দ্বিতীয় প্রদর্শনী। সূচিপত্র দেখেই অনুমান করা যায়, শিল্পী প্রকৃত অর্থেই প্রকৃতি প্রেমিক।
পেশায় ট্যাক্স কনসালট্যান্ট হলেও সময় বার করে নেন ছবি আঁকার জন্য। স্কুলে স্কাউটিংয়ের লগ-বুক তৈরি করার সময়েই ছবির প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল তাঁর। সে ভাবেই স্কেচের কাজ করতে করতে এগিয়ে যাওয়া, শেখার সুযোগ সে অর্থে পাননি। কিন্তু ছবি আঁকা থেকে নিজেকে বিরত রাখতেও পারেননি। অন্য পেশায় থেকেও বহু শিল্পীই ছবি আঁকার দিকে ঝোঁকেন, এমন উদাহরণ একাধিক রয়েছে। হয়তো ভালবাসা থাকলেও অন্য পেশার কারণে অভাববোধ রয়ে যায় শিল্পীদের। পরবর্তী কালে সেই ইচ্ছে প্রস্ফুটিত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে সকলের কাজ সেই মান ছুঁতে না পারলেও অনেকের মধ্যেই সম্ভাবনার চিহ্ন থাকে। সৌম্যেন সরকার তেমনই একজন।
বর্ণময়: অ্যাকাডেমিতে সৌম্যেন সরকারের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
শিল্পকে পেশা হিসেবে গ্রহণ না করলেও, নিজেকে এবং ঘনিষ্ঠদের আনন্দ দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুত ছিলেন এই শিল্পী। জীবনের অন্যান্য প্রতিশ্রুতির আড়ালে লুকিয়ে ছিল রং, তুলি, ক্যানভাস ও কলম। প্রায় কুড়ি বছর আগে গণেশ পাইনের কিছু কথায় অত্যন্ত অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকলেও যে তাঁর একটি নিজস্ব স্টাইল আছে, তা চিহ্নিত করেছিলেন গণেশ পাইন এবং তাঁকে সেই স্টাইলটিই বজায় রাখতে বলেন। বরিষ্ঠ শিল্পীর কথা মেনে চলেছিলেন সৌম্যেন।
প্রিয় জাপানি কলমের ছোঁয়ায় এক-একটি জায়গার স্কেচ নথিভুক্ত করেছেন শিল্পী। কখনও স্পটে বসে সরাসরি স্কেচ করেন। কখনও আবার পরে মনের মধ্যে যে ইম্প্রেশনটা থাকে, তা বার করেন ক্যানভাসে। এ ভাবেই ভ্রমণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত হয়ে যায় এক-একটি নিশানার ছবি। ২০১৪ সালের একক প্রদর্শনীতে ছিল জলরং ও কালোসাদার উপরে স্কেচ। এ বারে রেখেছেন ১৫টি স্কেচ। বাকি ৪০টি কাজ অ্যাক্রিলিকের। এর মধ্যে দু’টি জলরংয়ের ছবি।
বর্ণময়: অ্যাকাডেমিতে সৌম্যেন সরকারের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
তবে অ্যাক্রিলিকে কোনও দিন ছবি আঁকবেন ভাবেননি তিনি। এর প্রেরণার মূলে রয়েছেন শিল্পীর বড় দাদা। তা ছাড়া লকডাউনের ইতিবাচক দিকটিও কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। কর্মহীন জীবনে শ্বাস নেওয়ার পরিসর তৈরি করে দিয়েছিল তাঁর ছবির রাজ্য। তাঁর যাত্রা শুরু হয় রেখা, ছায়া, রঙের মাধ্যমে। সম্প্রতি ঘুরে আসা লক্ষদ্বীপ, কাশ্মীর, মুর্শিদাবাদের স্থানচিত্র তুলে ধরেছেন বেশ বড় আকারে, যা প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে।
প্রদর্শনীতে অ্যাক্রিলিকের তিনটি বড় ছবি ছাড়াও ছিল বেশ কয়েকটি চোখে পড়ার মতো কাজ। যেমন ঘন নীল সমুদ্র তীরবর্তী লেমন ইয়েলো এবং ইয়েলো অকারের উজ্জ্বল লেপন। এবং আর একটি সবুজ- নীল জলাশয়ের নির্মল গভীরতা এবং লেমন অকারের ক্লাসিক আলো ছায়া। শীর্ণ খাল লাগোয়া খেয়া-সহ দূরের ছায়ায় পরিপ্রেক্ষিতের যথার্থ প্রতিচ্ছবি উঠে আসে। গাঢ় সবুজ বনানী, পলাশের হাতছানি— আদি, অকৃত্রিম সুখের ধারণা না দিলেও, শিল্পীর কাজে সরলতা এনে দেয়। দেশ-বিদেশের জল, পাহাড় ও জঙ্গল নিয়ে রঙের মুড ধরতে শিল্পীর তাৎক্ষণিক প্রয়াস প্রশংসনীয়। এ ছাড়া জলরঙের ভিন্ন আস্বাদ তৈরি হয় বেনারস ঘাটের স্কেচধর্মী কাজগুলিতে।
বর্ণময়: অ্যাকাডেমিতে সৌম্যেন সরকারের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
এই শিল্পকর্মগুলির সময়সীমা মোটামুটি ১৯৬৭ থেকে ২০২৫। প্রতিটি ছবির নিবেদনে বোঝা যায়, ছবির প্রতি শিল্পীর অবাধ সমর্পণ। রং নিয়ে উচ্ছ্বাসের পথে হাঁটা শিল্পীর স্বভাবজাত, পার্সপেক্টিভ যথাযথ। বিশেষত উপর থেকে দেখা নিম্নবর্তী পাহাড়ি বসতির স্কেচ। তবে ল্যান্ডস্কেপই হোক বা ফিগারেটিভ, তা যদি অনুসরণভিত্তিক হয়, তা হলে ড্রয়িংয়ের বেসিক পাঠ অবশ্যই দরকার। ফলে পুরুলিয়ার রাস্তায় দূরের মানুষ হলেও, চোখে পড়ে গাঠনিক দেখার অভাব। দু’-একটি ছবিতে এই দুর্বলতা দেখা গেলেও, সাধারণ দর্শকের প্রতিক্রিয়ায় শিল্পীর প্রশংসাই উঠে আসে।
আশা করা যায়, ভ্রমণবৃত্তান্তের পারদর্শিতা তাঁর কাজে আরও সতেজ হয়ে ফিরে আসুক, দৃষ্টিসুখ প্রসারিত হোক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)