গত ৩১ অক্টোবর অ্যাকাডেমির মঞ্চে উপস্থাপিত হল অশোকনগর নাট্যআননের ‘মেঘনাদ’। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন চন্দন সেন। সম্ভবত বাংলার রঙ্গমঞ্চে এই প্রথম মেঘনাদ সাহাকে নিয়ে কোনও নাটক পরিবেশিত হল। এই রকম একটি ব্যতিক্রমী বিষয়কে বেছে নেওয়ার জন্য নাট্যকার সুদীপ্ত ভৌমিককে বিশেষ সাধুবাদ জানাতেই হয় এবং চন্দন সেন যে এই নাটকটিকে একটি মেদহীন রূপদান করেছেন, তা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য।
যেহেতু বিষয়টি নতুন, তাই নাটকটিও সম্পূর্ণ রূপে মৌলিক। কোনও বিদেশি নাটকের প্রচ্ছায়া এর উপরে প্রলম্বিত হয়নি। নাটকটি সুলিখিত এবং অস্পষ্টতাবর্জিত। তথ্য ও তত্ত্বের ভারে পীড়িত নয়। তবে, একই সঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন যে আঙ্গিকের ক্ষেত্রে নাটকটি মোটামুটি চেনা একটা পরিধির মধ্যেই ঘোরাফেরা করেছে। সময়ের পট পরিবর্তন— অতীত ও বর্তমানের মধ্যে নিরন্তর দোদুল্যমানতা এই নাটকের কেন্দ্রে রয়েছে। আর চোখে পড়ে, মধ্যে মধ্যে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনতিদীর্ঘ বক্তব্য বা কমেন্টারি, যা ইদানীং অন্য নাটকেও দেখা যায়। এতে দর্শকের সঙ্গে নাটকটির যোগাযোগের মাত্রা বেড়ে যায়। মেঘনাদ সাহা সাবর্ণ হিন্দু সমাজের তলা থেকে উঠে এসেছেন। নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেছেন। ওঁর জীবনের এই সংগ্রামের ঠিক পাশেই যখন তুলে ধরা হয় রোহিত ভেমুলার মৃত্যুর কথা, তখন নাটকটির রাজনৈতিক দ্যোতনা স্বভাবতই বৃদ্ধি পায়।
মেঘনাদ সাহার মতো একজন বিজ্ঞানী ভাবালুতা-আক্রান্ত মানুষ নন। তিনি স্পষ্টবক্তা। সত্যদ্রষ্টা। জ্ঞানের প্রতি সমর্পিত। প্রতিবাদী। অনমনীয়। ‘মেঘনাদ’-এর নামভূমিকায় চন্দন সেন মধ্য ও প্রৌঢ় বয়সের মেঘনাদ সাহার ভিতরের সেই দৃঢ়চেতা তীক্ষ্ণ মানুষটিকে তাঁর অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমে বার করে এনেছেন। হোমি ভাবা ও জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে কথোপকথনের সময়ে বিক্ষুব্ধ মেঘনাদের ভূমিকায় তাঁর স্বরগ্রামের উত্থানপতন এই চরিত্রকে রক্তমাংসের করে তুলেছে। চন্দন সেনের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে যাঁর নাম জড়িয়ে যাবে, তিনি হলেন ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়। তরুণ মেঘনাদের ভূমিকায় ঋতব্রত উজ্জ্বল। অভিনয়ে তাঁর স্বরক্ষেপণের উচ্চাবচতা ভাল লেগেছে। তিনি এই বিজ্ঞানীর অন্তরে প্রজ্জ্বলিত সেই আগুনটি বার করে এনেছেন, যা তাঁকে মেঘনাথ থেকে মেঘনাদ করে তুলেছিল। স্বল্প পরিসরে রায়ান সেন বালক মেঘনাথের অনুভূতিগুলো যথাযথ ফুটিয়ে তুলেছেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ভূমিকায় পঞ্চানন মুখোপাধ্যায় চমৎকার কাজ করেছেন। তাঁর অভিনয়ের মধ্যে সহজ সাবলীল ভঙ্গিমা রয়েছে, যা মনকে শান্ত করে দেয়। তাঁর কণ্ঠস্বরে একটা মায়া রয়েছে। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর ভূমিকায় শান্তিলাল মুখোপাধ্যায় শান্ত ও শীতল। নেহরুর পরিশিলীত কুটিল রূপটি তিনি নিপুণতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। এ ছাড়া ধুরন্ধর বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার ভূমিকায় রজতশুভ্র ভট্টাচার্য শক্তিশালী। মেঘনাদের সঙ্গে তাঁর বাদানুবাদের দৃশ্যগুলো নাটকটিকে সমৃদ্ধ করেছে। মেঘনাদের স্ত্রী রাধারানীর ভূমিকায় অলকানন্দা দত্ত ও কন্যা চিত্রা সাহার ভূমিকায় মণীষা দাস যথাযথ।
ঋতব্রত।
কল্যাণ ঘোষের আলো, শুভদীপ গুহর সঙ্গীত এবং মদন হালদার ও বাসুদেব সাহার মঞ্চ পরিকল্পনা উল্লেখযোগ্য। তোর্সা বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপাঞ্জনা দাস, তনিকা রায় চৌধুরী, পৃথা দাস ও কৌশিকী সমাদ্দারের শিল্পনির্মাণ ভাল লেগেছে। বিশেষত সাইক্লোট্রন যন্ত্রের উপস্থাপনাটি ভাল লেগেছে। অসিতা সেন, রাই দে ও বৈদেহী নারায়ণের পোশাক পরিকল্পনা যথাযথ।
মেঘনাদ নাটকটি যত্ন নিয়ে নির্মাণ করেছেন নির্দেশক চন্দন সেন। আমাদের বাংলা সংস্কৃতিতে আমরা ধর্ম-সংস্কারক, কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকর প্রমুখের যতটা জায়গা দিয়ে থাকি, তার তুলনায় বিজ্ঞানীদের ততটা জায়গা দিই না বলেই মনে হয়। তাঁদের উদ্ভাবনের সঙ্গে মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের সরাসরি যোগ থাকে না বলেই কি? এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘মেঘনাদ’ নাটকটি বিষয়ের দিক থেকে নতুন পথে অগ্রসর হয়ে রইল। এই নাটক মেঘনাদ সাহার জীবন, সংগ্রাম ও স্বপ্নের ব্যাপারে দর্শককে আগ্রহী করে তুলবে। তবে এই নাটক শুধু একজন বিজ্ঞানীর জীবনের আখ্যানই নয়, এই নাটক সেকালের পাশে এ কালকে রেখে তৈরি করতে চেয়েছে এক গভীরতর বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক সংলাপ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)